বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [৭ম পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো সাঁওতাল। তাদের  ধর্মের নাম ‘সারি ধরম’, কেউ কেউ ‘সারনা ধরম’ বলে থাকেন। তবে তাদের অধিকাংশ এখন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।  ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। দেশের  রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও সিলেট  জেলায় দুই লাখের বেশি সাঁওতালের বসবাস। বহু শতাব্দী ধরে জাতিগত বৈষম্য ও সামন্ত ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাঁওতালরা তাদের আত্মপরিচয় সমুন্নত রেখেছে। তাদের সমাজ মূলত পিতৃতান্ত্রিক।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো সাঁওতালরাও নানাভাবে আগ্রাসনের শিকার। তাদের ভূমি, ভাষা, সম্পদ এমনকি সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। শিল্পায়ন-শহরায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, গান সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণে তারা মর্যাদাহীন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। তারা হারাতে বসেছে কৃষিজমি,বন এমনকি বসতভিটা পর্যন্ত। তাদের অঞ্চলের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে তারা তাদের পেশা পরিবর্তন করতে না পারায় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আয় তারা করতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে পুরো সমাজব্যবস্থায়। তবে শিক্ষার হার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।      

জনসংখ্যা:

চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা বাগানের বাসিন্দা ও আদিবাসী ফোরাম হবিগঞ্জ জেলার নেতা স্বপন সাঁওতাল বলেন, সাঁওতালরা এই উপমহাদেশের অন্যতম একটি সংখ্যাবহুল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বাংলাদেশে তাদের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র দুই লক্ষাধিক বাস করে। ১৮৫৫ সালে সংঘটিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। বিদ্রোহের পরাজয়ে বাংলা, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। ১৯৬১ সালে ভারতের আদমশুমারিতে দেখা যায় বিহারে ১৫,৪১,৩৪৫ জন, পশ্চিমবঙ্গে ১২,০০,০১৯ জন, উড়িষ্যায় ৪,১১,১৮১ জন এবং ত্রিপুরায় ১,৫৬২ জন সাঁওতালের বসবাস। একই সালে আদম শুমারি হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। দেখা যায় সাঁওতালদের সংখ্যা দিনাজপুরে ৪১,২৪২ জন, রংপুরে ৪,২৯২ জন, রাজশাহীতে ১৯,৩৭৬ জন, বগুড়ায় ১,৮৬১ জন এবং পাবনায় ১৭০ জন। ২০০১ সালের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে সাঁওতালদের মোট সংখ্যা ১,৫৭,৬৯৮ জন। বর্তমানে এই সংখ্যা ২ লাখ অতিক্রম করেছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।

সমাজ কাঠামো:

আদিবাসী মুক্তি মোর্চা চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগদীশ সরেন ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, বহু শতাব্দী ধরে জাতিগত বৈষম্য ও সামন্ত ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাঁওতালরা তাদের আত্মপরিচয় সমুন্নত রেখেছে। যুগ যুগ ধরে হিন্দু এবং মুসলিমদের সঙ্গে বসবাস করার পরেও তারা নিজেদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে। তাদের সামাজিক প্রথা খুবই শক্তিশালী ও কার্যকর। তাদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার বাস্তব রূপ রয়েছে। তাদের গ্রামের বিশেষ পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত  গ্রাম পঞ্চায়েত এর সদস্যরা হলেন মাঝি হাড়াম বা গ্রামপ্রধান, পরাণিক, জগমাঝি, গোডেৎ এবং নায়েকে। আবার কয়েকটি গ্রামের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় পরগণা পঞ্চায়েত। এর প্রধানকে বলা হয় পারগাণা। এর থেকেও বৃহত্তর ব্যবস্থা দেশ পঞ্চায়েত।

মাঝি হাড়াম বলতে গ্রামপ্রধানকেই বোঝানো হয়। শুধু বিচারিকভাবে না, সার্বিকভাবে গ্রামের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তার সহায়ক হিসেবে বাকি পদগুলো সৃষ্ট। পরাণিক পালন করে সহকারি গ্রামপ্রধানের দায়িত্ব। মাঝি হাড়াম অসুস্থ কিংবা অনুপস্থিত থাকলে তার দায়িত্ব বর্তায় পরাণিকের উপর।

জগমাঝি পালন করে উৎসব তদারকির ভার। সেই সাথে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা তার মাধ্যমেই নিজেদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। সে হিসেবে তিনি যুব প্রতিনিধি।

গোডেৎ এর কার্যাবলী অনেকটা চৌকিদারের অনুরূপ। আর নায়েকে বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজা উপলক্ষে বলি দেওয়ার মতো বিষয়ের দায়িত্ব পালন করে।  স্থানীয় সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হয় গ্রাম পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো পরগণা পঞ্চায়েতে উত্থাপিত হয়। দেশ পঞ্চায়েতে উঠে পরগণা পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত সমস্যা। সবার শেষে স্থিত ল’বীরের মুঠোতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

জীবনযাত্রা:

মুক্তি মোর্চা রাজশাহী মহানগরের সহ-সভাপতি প্রমিলা কিস্কু বলেন, সাঁওতালদের জীবনপ্রণালী খুবই বৈচিত্র্যময়। খাদ্য তালিকার বিষযে বলতে গেলে বাঙালি ও সাঁওতালদের খাদ্যতালিকার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।  ভাত, মাছ, মাংস নিরামিষ কিংবা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক পিঠা তাদের খাবার হিসেবে বিদ্যমান।

পোশাক পরিধানেও এসেছে পরিবর্তন। গরীব পুরুষদের প্রধান পরিধেয় ধুতি এবং পাগড়ি বেশ জনপ্রিয়। আধুনিক শিক্ষিত ও শহরমুখীরা  প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি ও পাজামা প্রভৃতি পরিধান করে। মেয়েদের পোশাক মোটা শাড়ি বা ফতা কাপড়। তবে এখন অধিকাংশ পরিবারের মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের মতোই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে।

সাঁওতাল রমণীরা সৌন্দর্য সচেতন। স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন না থাকলেও গলায় হাঁসুলি, মালা ও তাবিজের ব্যবহার দেখা যায়। এছাড়া কানে দুল, নাকে নথ ও মাকড়ী, সিঁথিতে সিঁথিপাটি, হাতে বালা, চুড়ি এবং বটফল, বাহুতে বাজু, কোমরে বিছা, হাতের আঙুলে অঙ্গুরী, পায়ের আঙুলে বটরী প্রভৃতি অলঙ্কার বেশ জনপ্রিয়। কখনো খোঁপায় ফুল গুঁজে, কখনো কাঁটা ও রঙিন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা হয়। দরিদ্র মেয়েরা বিশেষ প্রকার মাটি ব্যবহার করে শরীর মাজতে, যা নাড়কা হাসা নামে পরিচিত। ক্ষুদ্রাকার ঘরগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। ঘরের নিম্নাংশ রঙিন করা ছাড়াও দেয়ালে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি। বাসায় আসবাবপত্রের আধিক্য নেই। কাঠ, বাঁশ ও পাট ব্যবহারের প্রাচুর্য দেখা যায়। তীর ধনুক ও টোটা প্রায় সব সাঁওতাল বাড়িতেই আছে।তাদের সামাজিক জীবন খুবই প্রাণবন্ত ও সাদাসিধে। সহজ-সরল হওয়ায় অনেক সময় অন্য জাতিগোষ্ঠীর খারাপ লোকদের দ্বারা তারা সহজেই প্রতারণার শিকার হয়।

সামাজিক উৎসব ও বিয়ে:  

জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক সুভাশ হেমরণ বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি অব্যাহত থাকলেও সামাজিক উৎসবসমূহ পালনে উৎসহা উদ্দীপনার কমতি নেই। চলে একের পর এক সামাজিক উৎসব। নানান উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে সাঁওতালপল্লী। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মতো সাঁওতাল শিশু জন্মের পাঁচ কিংবা পনেরো দিনে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপ্রাশন। এছাড়া নামকরণ, কানে ছিদ্র করা এবং সিকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় উৎসব। সিকার বদলে মেয়েরা ব্যবহার করে খোদা চিহ্ন। বিয়ে শাদির ক্ষেত্রেও বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী থেকে তেমন আলাদা চিত্র দেখা যায় না। অভিভাবকদের সম্মতি, প্রেমঘটিত  ও কৌশলে বিয়ে শাদি সম্পন্ন হয়। অভিভাবকের পছন্দ মাফিক বিয়ে হলে তাকে বলা হয় ডাঙ্গুয়া বাপ্লা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে। আগে থেকে বিদ্যমান প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে সেই বিয়েকে বলা হয় আঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে। ইতুত বিয়ের ক্ষেত্রে তরুণ সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে সিঁদুর পাতা গ্রামপ্রধানের কাছে জমা দেয়। গ্রামপ্রধান যুবতীর মত জানতে চান। হ্যাঁ হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধরা হয়। বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তদের পুনর্বিবাহের অধিকার স্বীকৃত।

বিধবাকে সাঁওতাল সমাজে বলা হয় ‘রাণ্ডি’। অন্যদিকে তালাক প্রাপ্তা মেয়েদের বলা হয় ছাডউই। অন্যদিকে মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য পালিত হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। সাঁওতালর মৃতকে কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।  ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটা সাঁওতাল সমাজের জন্য আরো বেশি করে সত্য। বাংলা ফাল্গুন মাসে উদযাপিত হয় নববর্ষ। চৈত্রমাসে বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরোয়া, আষাঢ়ে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিকে নওয়াই এবং পৌষ মাসে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। ধর্ম-কর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছুকে ঘিরে থাকে নৃ্ত্য আর গান।এভাবে একের পর এক সামাজিক অনুষ্ঠানে সাঁওতাল এলাকায় সৃষ্টি হয় মিলনমেলা। এতে সব বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিজেদের সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন পাড়ার প্রত্যেক পরিবার  ও আত্মীয় স্বজনেরা।

ধর্ম:

সুভাশ হেমরণ বলেন, সাঁওতালদের ধর্মের নাম ‘সারি ধরম’, কেউ কেউ ‘সারনা ধরম’ বলে থাকেন। তবে তাদের অধিকাংশ এখন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।  সাঁওতাল বিশ্বাস মতে, আদি দেবতা নিরাকার। স্বর্গ-নরক কিংবা জন্মান্তরবাদের তেমন কোনও ধারণা তাদের মধ্যে নেই। ধর্ম-কর্ম আবর্তিত হয় পার্থিব জীবনের মঙ্গল অমঙ্গলকে কেন্দ্র করে।

আন্দোলন-সংগ্রাম:

ভারতীয় ইতিহাসের সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে ১৮৫৫-৫৬ সালে। ১৯৪৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহীদ ৩৫ জনের অনেকেই ছিলেন সাঁওতাল কৃষক। ১৯৫০ সালে নাচোলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সাঁওতাল যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতা খাটো করে দেখার জো নেই।

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস পালিত হয়  ৩০ জুন। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত জমিদার, সুদখোর, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী এবং দারোগা-পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব—এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ায় সাঁওতালরা।

ভাষা:

সাঁওতালি উইকিপিডিয়ার প্রশাসক মানিক সরেন বলেন, সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু ভাষা ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন হ্রাস পেয়ে চলেছে।  সাঁওতাল শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের মাতৃভাষায় পড়ার বা কথা বলার সুযোগ পায় না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও কোনো সুযোগ নেই। চাকরিসহ কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সাঁওতালি ভাষার কোনো ব্যবহার নেই। এমনকি নিজ বাড়ির বাইরে হাটে-বাজারে এখন একজন সাঁওতাল আরেক সাঁওতালের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। এই ভাষার ব্যবহারিক পরিসর বাড়ানোর জন্য সরকারেরও বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ নেই।  ইংরেজি ভাষা ও রোমান বর্ণমালার আগ্রাসীমূলক আচরণ, বর্ণমালা বিতর্ক, সরকারের উদ্যোগের অভাব, ভাষা ও সাহিত্য চর্চার অনুকূল পরিবেশ না থাকা ইত্যাদি কারণে সাঁওতালি ভাষা অনেক দিন ধরেই বিপন্ন হওয়ার পথে।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ভারতে অনেক সাঁওতালভাষী মানুষ রয়েছে। বাংলাদেশে এই সংখ্যা হবে দুই লাখের বেশি। ভারতে এখন সাঁওতালী ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হয় এবং বহু হিন্দি উপাদান এতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। ইংরেজ আমলে সাঁওতালীতে রোমান হরফ চালু হয়েছিল। বাংলাদেশে সাঁওতালী বই-পুস্তক নেই। খ্রিস্টান মিশনারিরা দু-একটি সাঁওতাল বিদ্যালয় স্থাপন করে ইংরেজি বর্ণমালায় সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষিত সাঁওতালরা বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরে সাঁওতালী লেখে; তবে ধ্বনিগত মিলের কারণে তারা বাংলা অক্ষরে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সাঁওতালী ভাষার প্রায় সব ধ্বনিই বাংলায় রয়েছে। অন্যান্য ব্যাকরণিক মিলও আছে। সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে, যার নাম অলচিকি লিপি। তবে বাংলা লিপি, ওড়িয়া লিপি, রোমান লিপি ও দেবনাগরীতেও এই ভাষার লিখন বহুল প্রচলিত। অলচিকি লিপিটি ময়ুরভঞ্জ জেলার কবি রঘুনাথ মুর্মূ ১৯২৫ সালে সৃষ্টি করেন এবং প্রথমবার ১৯৩৯ সালে প্রচারিত করেন। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষা এবং ঝাড়খন্ডের সাঁওতালি সম্প্রদায়ে অলচিকি লিপিটি সার্বজনীন ভাবে গৃহীত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে সাঁওতালি এখনও বাংলা লিপিতে লেখা হয়।সাঁওতালি ভাষা ভারতের ২২টি তফসিলভুক্ত ভাষার মধ্যে একটি।

পেশা:

গাইবান্ধার সাঁওতাল নেত্রী সুচিত্রা মুরমু তৃষ্ণা ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, আদিকাল থেকেই কৃষিকে তারা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নারী পুরুষ সবাই জমিতে কাজ করে। পুরুষেরা হাল চাষ এবং নারীরা বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজ করে। সাঁওতালরা কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নিজেরা তৈরি করে। শিকার করার ব্যাপারে এদের উৎসাহ খুব বেশি। বাংলাদেশে বন জঙ্গল কমে যাওয়ার কারণে তাদের এই পেশায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে অনেক সাঁওতাল নারী-পুরুষ কুলি, মজুর, মাটি কাটার শ্রমিক ও অন্যান্য কাজ করে। খ্রিস্টান মিশনারীদের সংস্পর্শে এসে শিক্ষার আলো পেয়েছে অনেক সাঁওতাল। অনেক শিক্ষিত সাঁওতাল নারী-পুরুষ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত সাঁওতালের সংখ্যাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে জমা-জমি ও ভিটেমাটি হারিয়ে শহরমুখী হয়েছে তাদের অনেকে। তারা  বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের কেউ কেউ হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী।  

আরো পড়ুন:

বর্ষবরণ উৎসবে সীমাহীন আনন্দে মেতে উঠে মুন্ডা জনগোষ্ঠী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *