জীবন ও পরিবার

বর্ষবরণ উৎসবে সীমাহীন আনন্দে মেতে উঠে মুন্ডা জনগোষ্ঠী

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [৬ষ্ঠ পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে একটি হলো মুন্ডা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও সাতক্ষীরা এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী জেলায় তাদের বসবাস। অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এই জাতি আজ অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দিনমজুরী দিয়ে চলে তাদের অধিকাংশ পরিবার। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি থাকলেও তা বিলুপ্ত হতে বসেছে। তারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী। প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করছে তারা।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, গত কয়েক যুগেও মুন্ডা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তেমন বাড়েনি। সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মুন্ডা পরিবারে জনসংখ্যা হবে প্রায় ৪ হাজার। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিপুর, সাপখালি, কচিখালি, তারানিপুর, ধুমঘাট, কালিঞ্চি, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, তালা উপজেলার বাগডাঙ্গা আড়ুয়াখালিসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের বসতি রয়েছে। এছাড়া খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তারা বাস করে। খুলনার কয়রা উপজেলার ৩২০ পরিবারে এক হাজার ৫৩০ জন মুন্ডার বসতি পাওয়া যায়। এসব বসতিতে তারা নিজেদের মতো করে বাড়িঘর তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে বলে জানান সঞ্জীব দ্রং। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে মুন্ডাদের জনসংখ্যা দশ হাজারের কম।

অর্থনীতি ও শিক্ষা

শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়েপড়া মুন্ডা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। নানা কারণে জমি হারিয়ে তাদের অনেকে আজ ভূমিহীন। অধিকাংশ পরিবার বসবাস করে খাসজমিতে, চলে দিনমজুরী দিয়ে। সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, মুন্ডা সম্প্রদায় আদিকাল থেকেই অবহেলিত। তারা সব ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার। এই সম্প্রদায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে। লেখাপড়া না থাকায় ভালো কোনো কাজে তাদের অনেকের প্রবেশাধিকার নেই। অনেকের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ, একদিন কাজ না করলে পরের দিন ঘরে খাবার থাকে না বলে জানান কৃষ্ণপদ মুন্ডা।

এলাকাবাসী জানায়, সাতক্ষীরার মুন্ডা পরিবারগুলোতে লেখাপড়ার সুযোগ কমই ছিল। জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের কৃষ্ণপদ মুন্ডাই ছিলেন প্রথম যুবক, যিনি উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পাস করেন। পরে সাতক্ষীরার বংশীপুরের গির্জার ফাদার লুই পাজ্জির সহায়তায় কৃষ্ণপদ মুন্ডা তার গ্রামে গড়ে তোলেন একটি প্রাথমিক শিক্ষালয়। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের একাই পড়াতেন তিনি। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার জন্য বইখাতা, কাগজ, কলম সরবরাহ করতেন ফাদার লুই পাজ্জি। শিক্ষক কৃষ্ণপদ মুন্ডার মাসিক বেতনও দিতেন লুই পাজ্জি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে মুন্ডা বসতি এলাকায় কমিউনিটি স্কুল তৈরি হয়েছে। সেখানে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিশুরা লেখাপড়া করে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া উপবৃত্তি পায় মুন্ডা শিশুরা। এমনকি বিনামূল্যে লেখাপড়া, স্কুলের খাদ্য সহায়তা, বই-খাতা থেকেও বঞ্চিত নয় বর্তমানের শিক্ষার্থীরা।

কৃষ্ণপদ মুন্ডা ও লুই পাজ্জি প্রথম শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিলেন মুন্ডা পাড়ায়। এছাড়াও লুই পাজ্জি শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কচিখালিতে, তালার বাগডাঙ্গা, আড়ুয়াডাঙ্গা, মুন্নাসহ বিভিন্ন এলাকার মুন্ডা বসতিতে নতুন নতুন ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। সাতক্ষীরার অধিকাংশ মুন্ডাদের বসবাস ছোট ছোট ভাঙাচোরা ঘরে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এসব বসতঘরের খানিকটা উন্নতিও হয়েছে। এছাড়া মুন্ডা সদস্যদের অনেকেই পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নতুন ঘর। মুন্ডা জনগোষ্ঠী সেখানে অনেকটাই আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। তবে অধিকাংশ মুন্ডাদের ঘরবাড়ি এখনও মাটির। গরান কাঠের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনির ঘরে তাদের বসবাস।

শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের বাহামনি মুন্ডা জানান, পূর্বপুরুষদের পেশা ছিল জঙ্গলের গাছ, গোলপাতা ও গরান কাঠ কাটা। বর্তমানে গাছকাটা বন্ধ করেছে সরকার। ফলে অনেকেই আদি পেশা ছেড়ে কৃষিকাজ ও নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ কেউ অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।

বাহামনি মুন্ডা আরও জানান, এক সময় মুন্ডারা সুন্দরবনের হরিণ, শুকর, সাপ, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রাণী শিকার করতো। সেসব প্রাণী নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতো। তবে বন্যপ্রাণি নিধন আইন প্রচলিত হওয়ার পর, সাতক্ষীরা অঞ্চলের মুন্ডারা সেসব পেশা থেকে সরে এসেছে। বর্তমানে তারা সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে, এমনকি বনবিভাগের অনুমতি পেলে মধু আহরণ ও জোংড়া খোটার কাজও করেন। মুন্ডা পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সমান তালে কাজ করে। ঘেরে মাছ ধরা, মাছ চাষ করাসহ কৃষিভিত্তিক নানা কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে মাঠেঘাটে তাদের কাজের দাম কম। তারা একদিন কাজ না করলে পরদিন সংসার চালাতে পারে না।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আদিবাসী মুন্ডাদের একটি সংগঠন রয়েছে ‘সামস’। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা মুন্ডা পরিবারগুলোকে নানাভাবে সহযোগিতা করে। মুন্ডাদের সামাজিক অধিকার আদায়ে সংগঠনটি আন্দোলন করে থাকে। সংগঠনটির সভাপতি কালিঞ্চী গ্রামের গোপাল মুন্ডা জানান, এখন আগের অবস্থায় নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও পাচ্ছে।

গোপাল মুন্ডা বলেন, সামাজিক বৈষম্যও অনেকটা দূর হয়েছে। তবুও মূল ধারার জনগোষ্ঠীদের সঙ্গে আমরা এখনও পুরোমাত্রায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারিনি।

ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতি ও উৎসব:  

পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে মুন্ডারা বলে সিরুয়া বিসুয়া। খুব ঘটা করে এ উৎসব পালন করে তারা। এ সময় কাজ-কর্ম একদম বন্ধ থাকে। কখনো কখনো মনে হবে তারা সমতলের অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই পয়লা বৈশাখ রীতি পালন করে। তবে ভিন্নতা আছে অনেক। যেমন ঋতুভিত্তিক ফসলি উৎসব ছাড়াও প্রতিদিন তাদের ধর্মীয় দেবতা সিং, বোঙ্গা বা সূর্যকে পূজা করে। মুন্ডারা সুর্য দেবতার পূজায় অভ্যস্ত। তাই সকালে স্নান করে এসে বোঙ্গা বা সূর্যের পূজা দিয়ে তারা সবাই মিলে পানতা ভাত খায়। তবে ভিন্নতা হলো দুপুরে তারা ভাতের সঙ্গে ১২ রকমের বেশি তরকারি খায়। ১২ সূচক, এজন্যে যে বারো মাসের সমাপ্তির পর এ উৎসব তারা করে। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে প্রণাম করে শুরু হয় নিজস্ব মদ চোলাই পান ও নৃত্যগীত আর ভক্তি দিয়ে চলে নাচগানের আসর।

বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিন বা সাকরাইনের দিনও মুন্ডা সম্প্রদায় আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। ওইদিন তারা শুদ্ধি অভিযান চালায় দলেবলে মিলে। তারা ঝেড়ে, মুছে লেপে বাড়ি ঘর পরিস্কার করে কাদা উৎসবে মেতে ওঠে। একে অপরকে কাদায় মাখায়। এটা তাদের দেবতার পছন্দ। বুঙ্গা দেবতার নামে এরা কাদা-মাটি ধুয়ে বছরের আবর্জনা দুঃখ-কষ্টকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। এটা তাদের পূর্বপুরুষদের রীতি। যে যাকে কাদা মেখে দেয় সে তাকে হাড়িয়া বা নিজের তৈরি মদ পরিবেশন করে। এভাবে তাকে সম্মানিত করার রেওয়াজ মুন্ডা সমাজে এখনও রয়েছে। তারা মনে করে এর মধ্য দিয়ে অন্তরের বাঁধন শক্ত হয়, বা ভালো আত্মীয় হয়। চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে মুন্ডারা বলে সিরুয়া বিসুয়া।

কয়রা উপজেলার শ্যামপদ মুণ্ডা বলেন, ধর্মীয় রীতিতে তারা সনাতন ধর্মাবলম্বী। চার বেদের মধ্যে ঋগবেদের অনুসারী। মুণ্ডাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পাহাড়িয়া পুজা ও শ্যামা কালী পুজা। পাহাড়িয়া পুজা হয় পারিবারিকভাবে এবং শ্যামা কালীপুজা হয় গোত্রগতভাবে। তিনি বলেন, ধর্মীয় রীতি পালনে কঠোর হওয়ার কারণে এক সময় তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। অন্যের বাড়িতে খেতেন না। এখন সেগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে। মুন্ডাদের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় আচার। তারা শারুল পূজা, কারামপূজা এবং মনসাপূজা করে থাকেন নিজেদের মন্দিরে।

আদিবাসী মুন্ডাদের একটি সংগঠন ‘সামস’ এর সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণপদ মুন্ডা জানান, মুন্ডাদের মরদেহ বেশিরভাগ সমাধিস্থ করা হয়। তবে জায়গার সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের শ্মশানে দাহ করা হয়ে থাকে। খাদ্য তালিকার বিষয়ে কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, বাঙালি খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে মুন্ডা সম্প্রদায়। বাড়তি খাদ্য তালিকায় রয়েছে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, কুচে, কচ্ছপ ইত্যাদি। তবে রুচিভেদে এসব খাবার খান মুন্ডারা।  

মুন্ডা জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, এই জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার। আদি কর্মসংস্থান ও জমি হারিয়ে তারা আজ অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। শিক্ষিত করে তোলা গেলে তারা আবার স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

আরো পড়ুন:

কোচদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি | সন্তানরা গ্রহণ করে মায়ের গোত্রনাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *