বিনোদন

শর্মিলা ঠাকুর: সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক বহুমাত্রিক অভিনেত্রী

ধূমকেতু ডেস্ক: ১৯৭৫ সালের চলচ্চিত্র ‘আনাড়ি’র শেষদৃশ্যে নীল চেকের ব্লাউজ ও ঢিলেঢালা পাজামা পরিহিত দৃঢ়চিত্তের শর্মিলা ঠাকুরের উপস্থিতি নজর কেড়ে নেয় দর্শকদের।

চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যের মতোই বাস্তব জীবনেও তাকে রক্ষার জন্য কোনো রাজপুত্রের দরকার হয়নি, স্বাধীনচেতা এই অভিনেত্রী নিজেই নিজের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন নানা সময়ে। নিজের সম্মান রক্ষায় ও ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখতে যখন যা করার দরকার পড়েছে তাই করেছেন তিনি।

পরিচালক অসিত সেন হয়তো অভিনেত্রীর এ ব্যাপারটি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তার চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নে শর্মিলার চরিত্রায়নে তিনি হয়তো তাত্ত্বিকভাবে বাঁধাধরা নিয়ম ভাঙ্গার কাজ করেননি, শর্মিলাকেই তার নিজ রূপে আবির্ভাবের সুযোগ দিয়েছেন। শর্মিলার অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের পরিচালকদের মতো তিনিও জানতেন, শর্মিলা ১৯৬০ ও ৭০’র দশকেই নারী পুরুষের সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞায়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চলচ্চিত্রটিতে শেষ পর্যন্ত শর্মিলার চরিত্রের মৃত্যু হলেও তার দুর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা চরিত্রটির দৃঢ়তা এখনো দর্শকদের স্মৃতিতে অমলিন।

শর্মিলা ঠাকুরের বহুমাত্রিক চিত্রায়ন তার সমসাময়িক যে কোনো অভিনেত্রীর চেয়ে শক্তিশালী, তার অভিনয়ের ছাপ এখনো দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। তিনি নিজের আকাঙ্ক্ষিত সকল নারী চরিত্রই তার অভিনয়ের মাধ্যমে আরও নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। অভিনেত্রীদের থেকে সমাজের অলিখিত কিছু বাঁধাধরা গতানুগতিক প্রত্যাশার কারণে অসংখ্য হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও তার সফলতার পথে বাঁধা হতে পারেনি কিছুই। নারীবাদ ছিল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, চিন্তা ভাবনা করে বা পরিকল্পনা করে নারীবাদের পথচলা শুরু হয়নি তার। তার একান্ত নিজস্ব প্রকৃতিই ছিল এমন।

১৯৬০’র দশকে কোনো অভিনেত্রীর অভিনয় জীবনের শুরুতেই কোনো পাহারাদার ছাড়া একা হোটেলে থাকা, চলচ্চিত্রে নিজের চরিত্রের ব্যাপারে নিজস্ব চিন্তা নিয়ে পরিচালককে জানানো, ফিল্মফেয়ারের প্রচ্ছদে বিকিনি পরিহিত ছবি সেসময় স্বাভাবিক বিষয় ছিল না। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে একজন মুসলমানের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো ও সঙ্গীকে তার প্রথম মার্সিডিজ বেনজ উপহার দেয়া- তৎকালীন সময়েই এসব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। বিয়ের পর ও সন্তান জন্মদানের পরও তার অভিনয় জীবনে ভাটা পড়তে দেননি তিনি। পরবর্তীতে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন বেগম, আবার পরিবারের কর্তাও। নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই জীবনধারার নিজস্ব চিন্তায় অটুট ছিলেন তেজস্বিনী এই অভিনেত্রী।

শর্মিলা ঠাকুরের অনুভূতির ভাষা ঠিকই পড়তে পেরেছিলেন মনসুর আলী খান পতৌদি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নির্দিষ্ট কোনো গন্ডিতে আবদ্ধ থাকার মতো মানুষ নন শর্মিলা। সিমি গেরওয়ালকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নবাব পরিবারের এ ক্রিকেটার জানান, শর্মিলাকে দেখেই তিনি কাজের গুরূত্ব অনুধাবন করেন। ২০১১ সালে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার পর শর্মিলা বাস্তবিকভাবেই বেগমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পতৌদির মৃত্যুর পর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও জীবনের চরম দুঃখের অধ্যায়ে তার দৃঢ়চেতা বৈশিষ্ট্য আরেকবার সামনে আসে। সম্ভবত তিনি জানতেন যে অনুভূতির জয়ের জন্য আসলে জনসম্মুখে তা প্রদর্শনের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই।

শর্মিলার সবকিছুতেই ছিল সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ছাপ, তিনি অনন্য কিছু করেছেন বা নিজের বৈশিষ্ট্যের বাইরে গিয়ে কিছু করেছেন এমনও নয়। যে কোনো মানুষের জন্য যা স্বাভাবিক, তাই করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন সহজাত, অকৃত্তিম ও মুক্ত একজন মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়া, শুধু পুরুষদের জন্যই যেসব কাজ স্বাভাবিক বলে গণ্য হতো তা করতে পারা; সেসময় তার এসকল বৈশিষ্ট্যই নারীবাদী বৈশিষ্ট্য ছিল।

তার জীবন সমতার অনুসন্ধানের উত্তর এমনও নয়, বরঙ জীবনের নিরন্তর নিরব সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি তার জীবন। নিজের জীবন ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শর্মিলা দেখিয়েছেন নারীরা বুদ্ধিমত্তা বা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়ে নেই।

তার অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা একদিকে যেমন বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যের সমর্থনের পক্ষে তার কাজের অনুস্মারক, তেমনি তার নারীত্বকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রমাণও। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসারে’ একেবারেই নিষ্পাপ একটি চরিত্রে দেখা যায় তাকে। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে কুসংস্কারের বলী হওয়া নারী চরিত্রে দেখা যায় তাকে। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চ্যাটার্জির জাঁকজমক উপস্থিতির সাথে তার অভিনয়ই যেন প্রাণ এনে দেয় চিত্রনাট্যে। তবে শর্মিলা ঠাকুরের পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীর থেকেও আরও বিস্তৃত।

তার সমসাময়িক বেশিরভাগ অভিনেত্রীর মতো ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে চাকচিক্যময় ভূমিকায় আটকে থাকেননি তিনি, ৬০’র দশকেই অসংখ্যবার সাদাসিধে চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। সব ভূমিকাতেই তার স্বাচ্ছন্দ্য উপস্থিতি দেখা গেছে। এর কারণ হয়তোবা, তিনি ছিলেন একই সাথে আধুনিক এবং সংস্কৃতি সচেতন।

১৯৬০ ও ৭০’র দশকেও বিভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রে তার সাবলীল অভিনয়ের দক্ষতা তার নিজস্ব নারীবাদের চিন্তাকেই স্পষ্ট করে তোলে। ‘অনুপমা’ চলচ্চিত্রে নারীর দুর্বলতা ও বদ্ধ জীবনের চিত্র ফু্টিয়ে তোলা এক চরিত্রে তার অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় দেখা যায়। অন্যদিকে ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ ও ‘আমনে সামনে’ চলচ্চিত্রে স্বাধীন, বাস্তববাদী চরিত্রে দেখা যায় তাকে।

‘আরাধনা’ চলচ্চিত্রে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। চরিত্রটির নাটকীয় উদ্দীপনার সাথে নিজস্ব অভিব্যক্তির সংমিশ্রণে সঙ্গীর মৃত্যুর পর নিজের পরবর্তী সংগ্রামকে তুলে ধরেন। ২৪ বছর বয়সী শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে বয়স্ক নারীর এমন চরিত্রে অভিনয় করে আরেকবার নিজের অদম্যতার পরিচয় দেন তিনি।

‘সত্যকাম’ চলচ্চিত্রে নিঃসঙ্গতা ও নির্জনতাকে নানন্দিকভাবে উপস্থাপন করে অভিনয় দিয়ে। চোখের ভাষা দিয়েই তিনি চরিত্রটির না বলা নিগূঢ় অনুভূতি ফুটিয়ে তোলেন। রঞ্জনা নামের চরত্রটি শেষ পর্যন্ত সত্যপ্রিয়কে নিজের অনুযোগের কথায় জানায়। সত্যপ্রিয় যে রঞ্জনাকে রঞ্জনার মতো করে গ্রহণ করতে পারেনি, এমন কোনো ইচ্ছাও ছিলনা সত্যপ্রিয়র; সবকিছুই বুঝতে পারে সত্যপ্রিয় নিজেও। অন্য একটি দৃশ্যে রঞ্জনা তার ছেলেকে অকপটে জানিয়ে দেয় সে সত্যপ্রিয়র ছেলে নয়; একারণে তার চিতায় আগুন দিতে পারবে না সে। সত্যকাম ধর্মেন্দর চরিত্র কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র হলেও শর্মিলার অভিনয়ের দক্ষতায় দুইজনেই সমানভাবে প্রশংসিত হন।

‘ছোট বউ’ চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন শর্মিলা। নিজের জন্য নিজের খুশিমত সবকিছুই করতো এমন চরিত্রটি সাবলীল ভাবেই ফুটিয়ে তোলেন তিনি।

শর্মিলার অনেক চলচ্চিত্রই সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। দর্শকরা যখন তাকে নিজের জন্য লড়াই করা নারীর চরিত্রে পর্দায় দেখতো, তার অভিনয় দেখছেন এমনটা মনে হতো না তাদের। বরঙ তার বাস্তব প্রতিবিম্বই যেন দেখা যেত চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নে।

‘সফর’ চলচ্চিত্রে সফল চিকিৎসক হওয়ার পথে জীবনের কষ্টকর পরিস্থিতে থেমে যায় তার অভিনীত চরিত্রটি। ক্ষমতায়ন মানেই সবকিছু সঠিক হবে এমন নয়, বরঙ প্রতি পদক্ষেপের ফলাফলের উন্নতি এমনটাই ধারণা নীলা চরিত্রটির। ‘দুরিয়া’ চলচ্চিত্রে শুধু প্রেমের সম্পর্কের কারণে নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে অস্বীকৃতি জানানো এক চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।

তার ‘আবিষ্কার’ ও ‘গৃহপ্রবেশ’ চলচ্চিত্রে কোনো রকম সাজসজ্জা ছাড়া পর্দায় উপস্থিতি তৎকালীন অভিনেত্রীদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কোনো রকম সাজসজ্জা না থাকলেও তার সৌন্দর্য কম মনে হয়নি এতোটুকুও।

গৃহপ্রবেশে সঞ্জিব কুমারের বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেন তিনি। চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্যে সঞ্জিব কুমার যখন তার স্ত্রীকে জানায় তিনি তাকে আর ভালোবাসেন না, এতোটুকুও বিচলিত দেখা যায়নি মানসিকে। তার অভিনয় গুণে দিয়ে সঞ্জিব কুমারকে ছাপিয়ে নজরে আসে তার চরিত্রটি। আবিষ্কার চলচ্চিত্রেও দৃঢ়চেতা এক নারীর ভূমিকায় দেখা যায় তাকে।

শর্মিলার যুগান্তকারী অভিনয় দেখা যায় ‘নামকিন’ ও ‘মওসাম’ চলচ্চিত্রে। মওসাম চলচ্চিত্র দেখতে তার শাশুড়িকে সাথে নিয়ে হলে যান তিনি। চলচ্চিত্রটিতে বাগপটু চতুর যৌনকর্মীর চরিত্রে শর্মিলার অভিনয় দেখে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তার শাশুড়ি বেগম সাজিদা সুলতান।

‘বিরুদ্ধ’ চলচ্চিত্রে অমিতাভ বচ্চনকে ছাপিয়ে চোখে পড়ে শর্মিলার অভিনয়, কিছু কিছু দৃশ্যে অমিতাভকে ছাড়িয়ে যান তিনি।

প্রায় ছয় দশক সময় ধরে বিনোদন জগতে তার উপস্থিতি দেখা গেছে, এখনো তিনি সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি কখনোই চরমপন্থী নারীবাদী ছিলেন না। তার একান্ত নিজস্ব কাজকর্ম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রেই তার নারীবাদী চিন্তার নিরব প্রকাশ দেখা যায়।

নিজস্ব উপায়ে ভালোবাসা, সত্য ও নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজের মতোই কাজ করেছেন তিনি। তার সিদ্ধান্ত এবং নারীবাদী চিন্তার সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংঘাত থাকলেও কখনোই নিজ সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেননি তিনি।

তিনি পতৌদিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও তা বাবা-মাকে চিঠি দিয়ে এবং কল করে হুমকি দেয়া হয়, মৃত্যুহুমকিও দেয়া হয়। তখনও নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও পপ সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা শুরু হওয়ার সেসময় নিজের মতো করেই আধুনিকতা ও স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত হওয়ার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শেষ কথা নয় এবিষয়টিও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার ভাষায়, “আপনি নিজে প্রস্তুত থাকলে মাঝপথেই জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে যাবেন।”

অসংখ্য এওয়ার্ডজয়ী স্পষ্টভাষী এ অভিনেত্রী নিজের অভিজ্ঞতা ও অর্জিত জ্ঞান দিয়ে যেকোনো বিষয়েরই অসাধারণ ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যও সুপরিচিত।

মহামারির কঠিন বাঁধার এসময়েও দমে যাননি তিনি। চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় নিজ পরিসরেই আত্ম উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছেন। হতাশার এ সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে গ্রিক পুরাণের দীক্ষা নিচ্ছেন একজন অভিনেত্রী, সচরাচর কি কানে আসে এমন ঘটনা? মহামারির মধ্যেই আবার নতুন করে শর্মিলা ঠাকুরের চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা চর্চার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। অ্যান্ডি ওয়ারহোলের বর্ণিত ১৫ মিনিট খ্যাতির এ সময়ে সবসময়ই কালজয়ী হয়ে থাকবেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *