প্রচ্ছদ

শরণার্থী নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত আফগান চিকিৎসক সালিমা

ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু বাংলা: পাকিস্তানের শরণার্থীশিবিরে জন্ম হয়েছিল সালিমা রহমানের। পড়াশোনা শেষে চিকিৎসক হয়েছেন সালিমা। তিনিই প্রথম আফগান শরণার্থী নারী হিসেবে চিকিৎসক হয়ে নারীশিক্ষার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে ভূমিকা পালন করে এ বছর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া এশিয়া অঞ্চলের নানসেন পুরস্কারটি জিতেছেন। তার এ অর্জন শরণার্থী নারীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে।

গত বছর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গাইনি চিকিৎসক হিসেবে সালিমা রহমান ডিগ্রি নেন। কাজ করছেন সেখানে। ওই সময় পাকিস্তানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর হাসপাতালটিতে করোনা ইউনিট চালু হয়। তখন তিনি ছিলেন সেখানকার একমাত্র শরণার্থী চিকিৎসক। সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া। দিনরাত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি অনেক জটিল রোগীর জীবন বাঁচিয়েছেন। কোভিডে আক্রান্ত মায়েদের সেবায় তিনি কাজ করেছেন।

হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে শরণার্থী নারীদের চিকিৎসাসেবা দিতে নিজের আলাদা চেম্বারও খুলেছেন সালিমা রহমান। ২০১৫ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করলেও লাইসেন্স নিতে সময় লেগে যাওয়ায় নিজের চেম্বার খুলতে তাঁকে এ বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।

আফগান শরণার্থীদের মধ্যে নারীশিক্ষার বিকাশ ও পাকিস্তানে কোভিড মোকাবিলায় ভূমিকার জন্য নানসেন পুরস্কার বিজয়ী সালিমা রহমানের বন্ধুর যাত্রাটা কেমন ছিল? তাঁর সেই যাত্রার কথা জানতে সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ঢাকা দপ্তরের সহযোগিতায় সম্প্রতি সালিমা রহমানের সঙ্গে প্রথম আলোর ভিডিও কলের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল।

সালিমা জানান, আজ থেকে ২০ বছর আগে পাকিস্তানে আটক শহরের বারাকাট প্রাথমিক স্কুলে হাতে গোনা শরণার্থী বালিকা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। সালিমা রহমান তাদেরই একজন। আর এখন তিনি দেখেন, নিজের স্কুলের অন্তত ৩০ জন বালিকা স্কুলে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘ওদের দেখলেই চোখে পানি চলে আসে। কারণ, আমার সময়ে কোনো কোনো সময় আমি ছিলাম একমাত্র ছাত্রী।’

জন্ম, বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে

সোভিয়েত আগ্রাসন শুরুর পর ১৯৭৯ সালে স্বজনদের হাত ধরে পাকিস্তানে চলে আসেন ১৩ বছরের কিশোর আবদুল। এরপর অন্য আফগান শরণার্থীদের মতো তাঁর জীবনটাও আবদ্ধ হয়ে যায় শরণার্থীশিবিরে। ১৯৯১ সালে তাঁদের ঘরে জন্ম নেন সালিমা রহমান।

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন

বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সাফল্য অর্জন অথবা সমাজে অন্যদের আলো দেখানো মানুষদের সবার একটা গল্প থাকে। তেমন একটা গল্প রয়েছে সালিমা রহমানেরও। তাঁর জন্মের সময় মায়ের শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ হতে থাকে। সালিমার পৃথিবীর আলো দেখার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাকে হাসপাতালে না নিলে হবে না, এমন পরিস্থিতি দেখা দেয়। কিন্তু আবদুলের সংগতি ছিল না স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার। অন্য শরণার্থীদের মতো শিবিরের চিকিৎসাসেবা ছাড়া উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত সালিমা পৃথিবীর আলো দেখলেন। যদিও তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় ছিল। অবশ্য বেড়ে ওঠার সময় নানা রকম শারীরিক সমস্যা তাঁর ছিল। কিশোর বয়সে জন্মের জটিলতার কথা জেনে তিনি চিকিৎসক হওয়ার পণ করেছিলেন। শপথ নিয়েছিলেন, অন্য শরণার্থীদের জীবনে যেন না আসে তাঁর মা ও তাঁর জীবনে আসা সেই যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তা।

বাধার পাহাড়

সালিমা রহমান বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল, পাকিস্তানে চিকিৎসক হওয়ার পর নিজের কমিউনিটির জন্য বিশেষ কিছু করা। তা চ্যালেঞ্জ যদি বলি, এর শেষ নেই। কোথা থেকে শুরু করি! যেমন আমি যে শৈশব থেকে শরণার্থী, এটা আমার মাথায় ছিল না। ফলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা লাগে। কারণ পাকিস্তানের নাগরিকেরা যেভাবে স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে পারেন, আমি তো তাঁদের চেয়ে আলাদা। জানতে পেলাম, আমার জন্য প্রক্রিয়াটি অন্যদের চেয়ে আলাদা। ফলে আমাকে অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত পারব তো।’ তিনি জানান, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি এসেছিল পাকিস্তানে থাকা আফগান শরণার্থীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠরা মোটেই খুশি ছিলেন না। তাঁদের প্রশ্ন বাবার কাছে, ‘মেয়েকে এত পড়াচ্ছ কেন? মেয়েদের তো আমরা বাড়ির বাইরে যেতে দিই না। সেখানে স্কুল শেষ করে কলেজে পাঠাতে যাচ্ছ কেন? বিদেশে এসে কি আমাদের সংস্কৃতির সবকিছু বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ? কাজটা ঠিক করছ না।’

নিজের অতীতের বন্ধুর পথের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আফগান শরণার্থী চিকিৎসক। সালিমা রহমান বলেন, ‘মজার ব্যাপার কী জানেন! ভর্তি হতে গিয়ে কাঠখড় পোড়ানো, আফগান শরণার্থীদের প্রশ্নবাণ—কিছুই বাবাকে টলাতে পারেনি। বরং তিনিই আমাকে ভরসা দিতেন, “তুমি তোমার কাজ করে যাও।” শরণার্থীদের জন্য একটিমাত্র আসন বরাদ্দ ছিল। বাবার অনুপ্রেরণাতেই শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে আমি ভর্তির সুযোগ পেলাম। মজার বিষয় কী জানেন! আমার আগে কেউ চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পাইনি। ফলে অন্যদের অভিজ্ঞতাকে যে কাজে লাগাব, সেই সুযোগটিও আমার ছিল না। ফলে আমাকে সবকিছু শুরু করতে হয়েছিল একেবারে শূন্য থেকে। তবে সব সময় সঙ্গে ছিলেন বাবা। যেখানে যখন যেতে হয়েছে, তিনি ছিলেন আমার ছায়াসঙ্গী। এ জন্য বিধাতাও সহায় ছিলেন।’

সালিমা রহমান বলেন, ‘আফগান নারীদের থাকার কথা অন্দরমহলে। সেটা দেশেই হোক কিংবা পাকিস্তানের শরণার্থীশিবিরে। এই যখন অবস্থা, মাঝেমধ্যে কি মনে হয়নি, ডাক্তার হওয়ার চেষ্টাটা বিফলে গেলে পরিণতি কী হতে পারে? নিশ্চয় মনে হয়েছে। শিবিরের লোকজন আমার বাবার ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। “মেয়েকে কেন এত পড়াচ্ছ! বিয়ে থা দেবে, সংসার করবে, তা না। শুধু পড়িয়েই যাচ্ছ।” এসব ভাবতে গেলেই মনে হয়, আমার চেষ্টাটা বিফলে গেলে অন্য নারীদের পড়াশোনার পথটাই বন্ধ হয়ে যেত!’

মাত্র দুবার আফগানিস্তানে

সালিমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা—সবটাই পাকিস্তানে। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা দুবার। একবার খুব ছোটবেলায়। আর শেষবার গেলেন ২০১৩ সালে দুদিনের জন্য। তিনি জানান, মূলত মেডিকেল কলেজে ভর্তির কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড়ের জন্য তাঁকে যেতে হয়েছিল। ছোটবেলার সফরের কথা মনে নেই। তবে শেষবার গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন, নারীদের পড়াশোনার বিষয়টি বিবেচনায় নেয় না আফগান সমাজ। সেখানে শরণার্থীশিবিরে থেকে তিনি পড়াশোনা করছেন শুনে স্বজনেরা ভ্রু কুঁচকালেন। সালিমা বলেন, যেখানে মৌলিক সুবিধাগুলোই থেকে নারীরা বঞ্চিত, পড়াশোনা তো অনেক পরের বিষয় তাঁদের জন্য।

সালিমা রহমান মনে করেন, আফগান নারীদের যেমন সুযোগ কম, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপও তাঁদের পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হওয়ার অন্যতম কারণ। নারীরা কেন বাড়ির বাইরে পা রাখবে। এ জন্য আফগান নারীরা স্বপ্ন দেখলেও তা বাস্তবে রূপ দিতে ব্যর্থ হন। তাই অধিকাংশ সময় পুরুষের রক্তচক্ষুর কারণে তাঁরা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পান। তিনি বলেন, ‘যখন আমি শরণার্থীদের স্কুলে যাই, হাসপাতাল কিংবা চেম্বারে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব বুঝতে পারি। কেউ ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল, সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে বাধা এল। সেদিন থেকেই তার ইচ্ছার মৃত্যু হলো। এটা আসলেই মেনে নেওয়া যায় না।’ তিনি জানান, তার চলার পথেও বাধা এসেছে প্রবলভাবে। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁর বাবা আবদুলকে এটা-সেটা বলেছে। আবদুল হাল ছাড়েননি।

নানসেন পুরস্কার বিজয়ী এই চিকিৎসক বলেন, ‘বাবা হাল ছাড়েননি বলে আমিও সব সময় আশাবাদী ছিলাম। কেননা, এটা জানতাম, আমার চেষ্টা বিফলে গেলে আর কেউ এ পথে পা বাড়াবে না। তাই যে স্বপ্নটা ছোটবেলায় দেখেছিলাম, তা পূরণের জন্য সব সময় মরিয়া ছিলাম। হাল ছাড়িনি। আমার আগে কেউ চিকিৎসক হয়নি বলে আমাকে পদে পদে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবে সব সময় পাশে ছিলেন বাবা।

আফগানিস্তানে যা চান

তালেবান শাসনামলে নারীশিক্ষার বিষয়ে কী আশা করেন, এমনটা জানতে চাইলে সালিমা বলেন, ‘আমি আশা করব যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, আফগান নারীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। পুরুষের মতো নারীদের শিক্ষার সুযোগটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শান্তি আর উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সমাজের নানা ক্ষেত্রে আমি নারীদের দেখতে চাই।’

আরো পড়ুন:

চীনে ইরানি ফটোগ্রাফারদের পুরস্কার লাভ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *