লেখালেখিসংস্কৃতি

আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যেভাবে উজ্জীবিত করেছে মুক্তিযুদ্ধকে

সাদিয়া মাহবুব সারা, ধূমকেতু বাংলা :

আজ ৫০ বছর হল আমরা স্বাধীন হয়েছি। মুক্ত হয়েছি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শোষণ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের মনোবল আর শক্তিতে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, ক্রীড়া, স্বাস্থ্যসেবা সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে আজকে স্বাধীনতার অর্ধশতক পর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে, আমরা কতটা ধারণ করছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে?

আমরা জানি সাহিত্য একটা সমাজের, একটা দেশের দর্পণ হিসেবে কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি আবেগ দিয়ে করা রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে যে দেশ আমরা পেয়েছি, এত বড় অর্জনের পর আমাদের সাহিত্যে যে পরিবর্তনের কথা ছিল, সেটা আমরা কতখানি করতে পেরেছি?

মুক্তিযুদ্ধ মানে যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত করা। এই মুক্তি একটি দেশের, একটি গোষ্ঠীর, একটি জাতির। বিশ্বে আজ অবধি যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সেটাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি যুদ্ধ হল রণাঙ্গনের, আরেকটি মনোজগতের। যুদ্ধ ময়দানের লড়াইকে উপজীব্য করে শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাদের মননশীলতা দিয়ে যুদ্ধ করে যান। বাংলায় আমরা যাদের ‘শব্দসৈনিক’ বলি। এই শব্দসৈনিকরা রণাঙ্গনের যুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগে থেকে তাঁদের শিল্প মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিবাদ করতে থাকেন। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ বলতে আমরা শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝি; কিন্তু সাহিত্যে বা মনোজগতে এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের ছাপ বহু আগে থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত; কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ যুদ্ধপূর্ব মননশীল প্রতিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।

ভাষার জন্য আমরা বাঙালিরা যখন রক্ত দিলাম, তখন পুরো পৃথিবীর সামনে বাঙালি জাতির জাতিসত্তার যে আকাঙ্ক্ষা তা মনোজগৎ থেকে সকলের সামনে চলে আসে।

বায়ান্নর লেখনীতে সেই চেতনার কথা ফুটিয়ে তাই কবি বলেছেন- ‘মায়ের ভাষার মান রাখতে জীবন দিল যারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম শহীদ তারা।’

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা পায় ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হলে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর। এর আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল উপমহাদেশের অন্যতম আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য। নিজের মুখের মায়ের ভাষাকে বাচিয়ে রাখতে আমাদের যে লড়াই ছিল, সেটা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ভাষা থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবার পর পূর্ণতা পায়। এ প্রাপ্তি ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের।

সাতচল্লিশের আগস্টের পর দৈনন্দিন জীবনে ভাব আদান-প্রদানের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠে বাংলা ভাষা। দেশভাগের পর বাংলা নতুন যে যাত্রা শুরু করল, দুই অঞ্চলে তা এক ছিল না।

পূর্বপাকিস্তান হওয়ার পর এখানে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী নিজস্ব আদর্শে সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে প্রথম আঘাত দেয় ভাষার ওপর, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর মাতৃভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়া হলো, তখন ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ, আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়; যার রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। এর বহিঃপ্রকাশ তৎকালীন সাহিত্য উপাদানের মাঝেও পাওয়া যায়। এজন্য ১৯৫২ সালকে বাংলাসাহিত্য বা রাজনৈতিক উত্থানের সূতিকাগৃহ বলা হয়ে থাকে।

রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলেও পাকিস্তনিরা বাংলাভাষাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিকৃত করতে চেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলাকে আলাদা করতে তারা বাংলা ভাষার মাঝে হরেক রকম আরবি ও ফারসি শব্দ ঢুকিয়ে দেয়ার কৌশল নেয়। এই কৌশলের জোরালো প্রতিবাদ ছিলো ‘তমদ্দুন মজলিশ’। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাভাষার বিকৃতি ঠেকাতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে।

এরপর বাংলাভাষার উন্নতি সাধন ও সাহিত্যচর্চার সর্বাত্মক কাঠামো তৈরিতে গঠিত হয় বাংলা একাডেমি। এটি ছিল ভাষা শহীদদের সংগ্রামী চেতনার দাবি। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মে ভীত না হয়ে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন এবং বাংলা একাডেমির বাৎসরিক কর্মসূচি বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন ও সাহিত্যচর্চার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে গেছে।

বাংলাদেশের বাঙালি সাহিত্যিকদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের মূল পার্থক্য হল, এ অঞ্চলের বাঙালিরা বরবরই শেকড় সন্ধানী। এর প্রমাণ পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকদের ছোটগল্প, কবিতা, বিশেষত প্রবন্ধের মাঝে উঠে এসেছে। এই প্রবন্ধসমূহতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মনজাগতিক যুদ্ধ করা হয়েছিল।

বায়ান্নর পর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটে। যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশেষভাবে বাংলা কথাসাহিত্যে একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠে।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানিদের অন্যায়গুলো না মানার প্রবণতা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনায়াসে ঢুকে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ-লড়াইয়ে একই বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে আমাদের সাহিত্যে। এ নিয়ে অনেক উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়া, গান রচিত হয়েছে। আজও হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সকল শ্লোগান, সকল গানে বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, যে ডাকে প্রতিটি ঘর থেকে মুক্তিকামী বাঙালিরা ঘর ছেড়েছিল, এই স্লোগান নেয়া হয় কাজী নজরুল রচিত ‘ভাঙারগান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ (১৯২২) কবিতা থেকে। এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধেও জয় বাংলা পাওয়া যায়। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।

বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে তা ফুটিয়ে তুলতে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ যা পরবর্তিতে ‘লেখক শিবির’ হয়ে যায়, সেখান থেকে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। গ্রন্থ তিনটি হল- ‘হে স্বদেশ’ (কবিতা), ‘হে স্বদেশ’ (প্রবন্ধ), ‘হে স্বদেশ’ (গল্প)।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থেই তৎকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনটি গ্রন্থই প্রকাশ করেছিলো বাংলা একাডেমী। যার প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর বাংলাদেশের সকল কিছু প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। তখন তরুণদের জন্য প্রথম বই ‘পুবের সূর্য’ লিখেন শাহরিয়ার কবির। এটি ১৯৭২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার শারদীয় সংখ্যাগুলোতে শওকত ওসমানের উপন্যাস প্রকাশিত হতো। শওকত ওসমানের বেশকিছু উপন্যাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত চারটি উপন্যাস- ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্যে’, ‘দুই সৈনিক’ ও ‘জলাঙ্গী’ । ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই প্রকাশ হয়। এ উপন্যাসে একদিকে পাকিস্তানিদের বর্বরতা যেমন চিত্রিত হয়েছে, তেমনি বাঙালির প্রতিরোধের অদম্য শক্তির কথাও অঙ্কিত হয়েছে। তার ‘নেকড়ে অরণ্যে’ উপন্যাসে পাকিস্তানিদের নারী নির্যাতনের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছেন।

৭১ সালের বিজয় পর্যন্ত কলকাতা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে সকল পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রতিটিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক লেখা প্রকাশিত হতো। এর অধিকাংশ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গিয়েছে। এরপর ৭২ সাল থেকে মূল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা শুরু হয়।

জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র পাঠ সবাইকে আজীবন স্মরণ করাবে একজন আত্মত্যাগী, মহীয়সী মায়ের কথা।

একাত্তরে ঢাকা শহর জুড়ে কীভাবে চলেছিল গেরিলা তৎপরতা, তার জলজ্যান্ত বিবরণ আছে এই দিনলিপির প্রতিটি পাতায়। ১৯৭১-এর ১মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার, দেশের ভেতরে এবং বাইরের প্রায় অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন জাহানারা ইমাম।

 ‘আশাবাদী না হয়ে আমাদের গত্যন্তর নেই। এখন আমাদের জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা’। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম নিয়ে যারা উপন্যাস লিখেছেন তাদের মধ্যে শওকত আলী অন্যতম। তার রচিত ‘যাত্রা’ উপন্যাসে একাত্তরের ২৫ মার্চের কালোরাত্রির বর্ণনা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ভীতু বাঙালির তকমা মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত হয়ে বাঙালির জেগে ওঠার বর্ণনা।

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’, ‘অন্ধকথামালা’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রশীদ করিমের ‘আমার যত গ্লানি’, রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারি সূর্য’, হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ অন্যতম। উপন্যাস ছাড়াও আমাদের কথাশিল্পীদের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অসংখ্য ছোটগল্প।

তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি অনুকম্পিত করেছিল কবিতাকে। যুদ্ধ জয়ের জন্য যেমন বন্দুক চাই, তেমনি কবিতাও চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্তের কবিতা মুক্তিবাহিনীর ভেতর সীমাহীন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলো। পাশপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর অনেক কবিতা রচিত হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। এসব কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা উঠে আসছে এবং উঠে আসছে বাঙালির বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের ইতিহাস।

শামসুর রাহমানের ‘সন্ত্রাস বন্দী বুলেট বিদ্ধ দিনরাত্রি’ কবিতায় হানাদারবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে।

হেলাল হাফিজের-

‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।

‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের এ কবিতাটি মুক্তিকামী মানুষের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিল দেশ মায়ের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃঢ়তা।

নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল’ শিরোনামের কবিতায় জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণকে কবিতা বলেছেন, বলেছেন অমর কবিতা।

কবিতা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা আরো অসংখ্য কবিতার মধ্যে জসীম উদ্দীনের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ , সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত বাংলা’, আহসান হাবীবের ‘স্বাধীনতা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘তোমার আপন পতাকা’, আবু জাফর ওবায়দুল্লার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’, মহাদেব সাহার ‘ফিরে আসা গ্রাম’, হুমায়ুন আজাদের ‘মুক্তিবাহনীর জন্যে’, আবিদ আজাদের ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, আবুল হাসানের ‘উচ্চারণ গুলি শোকের’ শিরোনামের কবিতা রয়েছে যা পাঠ করে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে পরিচিত।

কবি শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি কলকাতায় পাঠিয়েছেন সেই তখন, ‘ঢাকা যখন শত্রুপুরী ছিল’। বইটির কলকাতা সংস্করণের মুখবন্ধে তখনকার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তখন একদিন দুই মুক্তিযোদ্ধার হাতে এসে পৌঁছল গোপন কিছু পাণ্ডুলিপি। সেই পান্ডুলিপি হলো শামসুর রাহমানের নতুন কবিতা: সৈন্য শাসিত বাংলাদেশের ভিতর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া স্বর।’ আর শামসুর রাহমান নিজে বন্দী শিবির থেকে লেখার নেপথ্য- বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের ঠেলে দিয়েছিল হতাশার অতলখাদে। তখন পড়াশোনা, লেখালেখি, খাওয়া-না-খাওয়া সব কিছুই অর্থহীন ঠেকত।… একাত্তরের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামে এক দুপুরে লিখে ফেললাম “স্বাধীনতা তুমি” ও “তোমার জন্যে হে স্বাধীনতা” কবিতা দুটি।’ বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের জন্ম এভাবেই। কালক্রমে শামসুর রাহমান ভূষিত হয়েছেন আমাদের ‘স্বাধীনতার কবি’ হিসেবে।

গানে মুক্তিযুদ্ধ

লড়াকু মানুষকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করে কবিতা এবং গান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে উজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়!’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’-এর মতো মুক্তিযুদ্ধের এই গানগুলো এখন ইতিহাসের ধারক।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শিল্পীরা তাদের দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে, মানুষ্কে যুদ্ধে যাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে এই গানগুলোর জন্ম হয়েছে। শব্দ সৈনিকদের এই সমস্ত গানের কারণে, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, কল্যাণ মিত্রের নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ অনুষ্ঠানগুলো সেই সময়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জন্ম নেয়া প্রতিটি গান ছিল এক-একটি বুলেটের মত। এসব গানের মাঝে থাকা অনেক গান গেরিলা অপারেশনের সিগনাল হিসাবেও কাজ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কোনো দেশেই গণমাধ্যম একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। একেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সকলেই এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেউ কবিতা লিখেছেন, কেউ গান লিখে দিয়েছেন, কেউ স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছেন আবার কেউ কেউ তা পালন করেছেন।

গান, কবিতা, উপন্যাসের মত বাংলার মঞ্চনাটকও ধারণ করে আসছে তার গর্বের ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রথম সফল মঞ্চনাটক ‘কিংশুক যে মেরুতে’ যা রচনা করেছিলেন আহসান উল্লাহ। আমাদের মৌলিক নাট্যকারদের মধ্যে সেলিম আল দীন, মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ হেল মাহমুদ, মান্নান হীরা, মাসুম রেজা, সাঈদ আহমেদ, আল মনসুর, রনেশ দাসগুপ্ত, পংকজ বিভাস, এসএম সোলায়মান, জিয়া হায়দার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, নিলীমা ইব্রাহীম, নুরুল আম্বিয়া, কল্যাণ মিত্র প্রমুখ।

নাটকে মুক্তিযুদ্ধ

একাধিক প্রতিবাদী নাটকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উজ্জীবিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘এখনও ক্রীতদাস’, মামুনুর রশীদের ‘জয় জয়ন্তী’, সেলিম আল দীনের ‘কেরামত মঙ্গল’, মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ‘রাজা অনুস্বারের পালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তবে সবচেয়ে মঞ্চ সফল ও আলোচিত নাটক লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। তার কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ আজও সর্বস্তরে আলোচনার ঝড় তোলে। এছাড়া তিনি লিখেছেন ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ ও ‘এখানে এখন’।

মমতাজ উদ্দীন আহমেদ তার ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম’, ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং ‘বর্ণচোর’ এসব নাটকে পাকিস্তানি শোষকদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন।

চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের এই পাঁচ দশকের অনেক চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে সেলুলয়েডের ফিতায়। স্বাধীনতার পরে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা তৈরি হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’। সেই সিনেমার অধিকাংশ কলাকুশলী ছিলেন সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বাংলার সূর্যসন্তান। এছাড়াও মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের ‘অরণ্যদোয়ের অগ্নি সাক্ষী’। মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ও উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এরপর খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৪ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘সংগ্রাম’ মুক্তি পায়।

এরপর আবার নব্বইয়ের দশকে বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’, ’মাটির ময়না’ বহুল আলোচিত হয়। এর মাঝে মাটির ময়না প্রথম বাংলাদেশি ছবি হিসেবে অস্কারে মনোনয়ন পায়, হুমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, ১৯৯৭ সালে চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’,  ২০০৪ সালে হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ আর তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ নির্মিত হয়।

এরপর সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ২০১১ সালে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ নির্মিত ‘গেরিলা’।  সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ থেকে নির্মিত এই সিনেমায় বিলকিস আর মেজরের শেষ অংশ এযুগে এসেও আমাদের রক্তে শিহরণ তৈরি করে।

এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ আজও আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যে বেঁচে আছে। ৫০ বছর পর নতুন প্রজন্ম হিসেবে আমার দায়িত্ব একে ধারণ করা, যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা। তবেই ১৯৭১ এ ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গান গেয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা এনেছে যাঁরা, তাঁদের আমরা আরো সহস্র বছর আমাদের সত্তার মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।

আরো পড়ুনঃ 

সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলার ক্রীড়াঙ্গন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *