জাতীয়

উন্নয়নের স্বার্থেই মত প্রকাশের মুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন

উন্নয়নের স্বার্থেই নাগরিক সমাজের মুক্তভাবে মত প্রকাশের পরিবেশ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন জার্মান প্রতিমন্ত্রী ব্যেয়ারবেল ক্যোফলার৷ বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।

ঢাকার একটি হোটেলে জার্মান দূতাবাস আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বিবর্তনের জন্য : বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জার্মানি-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভূমিকা’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে ইউরোপের দেশটির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক ভাইস মিনিস্টার এবং ডয়চে ভেলের ব্রডকাস্টিং কাউন্সিলের সদস্য ব্যেয়ারবেল ক্যোফলার বলেন, সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নাগরিক সমাজ ও তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ কারণ যাদের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তাদের কথা আমাদের শুনতে হবে৷ তারা যেন মুখ খুলতে এবং মুক্তভাবে কথা বলতে পারে৷

ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম বিষয়ক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই ব্যেয়ারবেল ক্যোফলার বাংলাদেশে এসেছেন৷ গত ২৮ অক্টোবর তিনি বাংলাদেশে আসেন৷ এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও নানা শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন৷ বর্তমানে তিনি কিছু প্রকল্প দেখতে খুলনা এলাকায় অবস্থান করছেন৷ মঙ্গলবার তার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে৷ পরদিন অর্থাৎ বুধবার তিনি ফিরে যাবেন৷

জার্মানি-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভূমিকা শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের একটি বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়৷ সেখানে তিনি দুদেশের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগিতা আরও জোরদারের আশা প্রকাশ করেন৷ ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন৷

ব্যেয়ারবেল ক্যোফলারের সঙ্গে প্যানেল আলোচনায় যোগ দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, পিকার্ড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক ড. এ রাজ্জাক এবং ইকোনমি অফ টুমোরো’র প্রতিনিধি সুসান সুহা৷

ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া পিকার্ড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্যোফলার যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটা হলো, উন্নয়নের স্বার্থেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন৷ বাংলাদেশে সেটা আছে কী নেই সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি৷ পাশাপাশি ব্যবসা সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন৷

তিনি বলেন, আমার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে তিনি বলেছেন, ১০ বছর আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন৷ এবার ১০ বছর পর এলেন৷ এই সময়ের মধ্যে তিনি একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন৷ সোশ্যাল ও এনভায়রনমেন্ট কমপ্লায়েন্সের উপর উনি জোর দিয়েছেন৷ জার্মানিতে বাংলাদেশের বাজার বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে৷ বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি৷ খাদ্য ও জ্বলানি নিরাপত্তার একটি গ্লোবাল প্লাটফরমের বিষয়ে উনি গুরুত্ব দিয়েছেন৷ শ্রমিকদের জন্য আইএলও কনভেনশন বাংলাদেশ রেডিফাই করাতে তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন৷

ঢাকায় অনুষ্ঠানে ব্যেয়ারবেল ক্যোফলার বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপীই অনুভব করা যায় এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশে৷ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের এক-পঞ্চমাংশকে স্থায়ীভাবে পানির নিচে তলিয়ে দেওয়ার হুমকিতে ফেলেছে৷ এটা হলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ কোটি লোক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবে৷ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের কাজের পরিবেশের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, বিশেষ করে পোশাক খাতে৷ তাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অনেক কিছু করার আছে৷ অধিকারের দাবি কেবল শ্রমিকদের দিক থেকে নয়, ভোক্তা ও সরবরাহ ব্যবস্থাসহ সবপর্যায় থেকেই তোলা হয়৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন খাদ্য ও জলবায়ু নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদেরকে বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি করেছে৷ সেকারণে জ্বালানিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা দরকার৷

অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক ড. এ রাজ্জাক বলেন, আমরা তাকে বলেছিলাম এলডিসির যে সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে এটা আরও বেশি সম্প্রসারণ করা যায় কিনা? পরিবেশ নিয়েও আমরা কথা বলেছি৷ নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কথা হয়েছে৷ ২০২৯ সালের পর তো আমাদের গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে সুবিধা থাকবে না৷ সেক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যেহেতু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তারপরও অন্য কোথাও সুবিধা পেতে পারে কিনা সেটাও দেখতে হবে৷ উনি সাভারে গিয়েছিলেন৷ কারখানার পরিবেশ দেখেছেন৷ তারা অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব জিনিসপত্র দেখতে চান৷ তবে তিনি কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই আমার মনে হয়েছে৷

ভাইস মিনিস্টার ব্যেয়ারবেল ক্যোফলার মুক্তভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োজনের যে কথা বলেছেন সেটা আসলে বাংলাদেশে কতটুকু আছে? জানতে চাইলে পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই সেটা তো আর বলা যাবে না৷ সংবিধানে তো মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে৷ সেই অর্থে সাংবিধানিক অধিকার আপনার আছে৷ কিন্তু এই স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আবার কতগুলো বাধা আছে৷ একটা হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট৷ আমরা যারা পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা সরকারের অনেকগুলো কাজে সঙ্গে যুক্ত৷ পৃথিবীর সবদেশেই পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বলবে৷ কিন্তু আমরা এখানে এটা বলতে গেলেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী বলে চাপে ফেলা হচ্ছে৷ এই আইনটি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও বড় বাধার সৃষ্টি করেছে৷ এনজিওদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা সরকারের হাতে৷ যে কারণে অধিকারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মিথ্যা তথ্য দিয়েছে৷ সরকারও কি সব সময় জনগণকে সঠিক তথ্য দেয়? আপনি নানাভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন, কিন্তু কারও লাইসন্সে বাতিল করে নয়৷ আমাদের বেশ কিছু পরিবেশকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে৷ এগুলো তো বন্ধ করতে হবে৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জার্মান ভাইস মিনিস্টার যে মন্তব্য করেছেন সেটা তো নতুন কিছু না৷ যারা একটু খোঁজ খবর রাখেন তারা সবাই সেটা বলবেন৷ এখানে যেটা হয়েছে, নাগরিকদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই প্রতিবন্ধকতা বাড়ছে বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়৷ কিছু নতুন আইন হয়েছে৷ এর মধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে৷ তবে স্বাধীনতা তো সীমাহীন না৷ যে কোন স্বাধীনতার একটা সীমা থাকে৷ এটা আইনগতভাবে নির্ধারিত৷ এখানে কোন কোন শ্রেণীর মানুষের জন্য বাকস্বাধীনতা সীমাহীন৷ আর বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাক স্বাধীনতায় অন্তরায় বেড়েই চলেছে৷ এটা এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করছে৷ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *