অভিমত

আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না

জিসান তাসফিক:

সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হলো- হোয়াইট হাউসে যিনিই আসেন, তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, ব্যক্তিবিশেষের ওপর দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে না।

শুনতে তিতা হলেও কথাটি ধ্রুব সত্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা গেছে, জো বাইডেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন এই ভেবে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন হলে পররাষ্ট্রনীতিও পরিবর্তন হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পরিবর্তন হয়, সরকারের পরিবর্তনের জন্য নয়।

পররাষ্ট্রনীতি হল এমন নীতি, যা বহির্বিশ্বের সঙ্গে একটি দেশের সম্পর্ক কেমন হবে; সেসব ‘নীতির’ নীতিমালা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে- এটাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে: বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলবে না; সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং জাতিসংঘের নীতিমালাকে সম্মান ও এই নীতি অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি হবে।

বাংলাদেশের কোনো সরকার এই পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করেনি এবং বাস্তবেও এই নীতি অনুযায়ী কাজ করেছে। কোনো দেশের পরারাষ্ট্র নীতিমালা ওই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জাতিগত সম্পর্ক, রাজনীতি, আইন ও সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী গড়ে উঠে এবং বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতিতে জাতিসংঘের প্রভাব থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হয় জো বাইডেনের কাছে। অনেকেই মনে করে, ট্রাম্পের স্থানে জো বাইডেন আসায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কেমন- সেটা জানার আগে জেনে নেয়া উচিত, মার্কিন সরকার ব্যবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেমন হয়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ হল রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হওয়ার কারণে রাষ্ট্রপতিই নির্বাহী বিভাগ তথা শাসন বিভাগের প্রধান। এই দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেশটির সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত। ওই ক্ষমতাবলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি যে কোনো নির্বাহী আদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু এসব আদেশে একটি বিষয় আছে, তা হল-মার্কিন আইন বিভাগ মানে সংসদ (Parliament)।

মার্কিন রাষ্ট্রপতির যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় তবে তার জন্য কংগ্রেস ও সিনেট থেকে অনুমোদন নিতে হয়; অন্যথায় তা কার্যকর হয় না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস ও সিনেটের সদস্য না হওয়ার কারণে ওই সভাগুলোয় তার কোনো ভূমিকা থাকে না এবং আইনসভার প্রত্যেক সদস্য তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজস্ব মতামত অনুযায়ী ভোট দিয়ে থাকেন।

কোনো বিল বা আইন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে পাস হয়। তাছাড়া চার বছর পরে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়; ফলে জনগণ তাদের জন্য উত্তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তার ভূমিকা ও সপ্তম নৌবহরের কথা আমরা সবাই জানি। রিচার্ড নিক্সন ছিলেন রিপাবলিকানদের দলে।

সে সময় মার্কিনিরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল ও ভারতের বিপক্ষে। বর্তমানেও তাই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করেছে; আর অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে এখন চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অথচ এই ট্রাম্পও রিপাবলিকান দলের।

আবার ট্রাম্পের আগে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বারাক ওবামা; যার সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গুপ্ত হামলা করে আল কায়েদা প্রধান লাদেনকে হত্যা করা হয়। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও পরবর্তীকালে ঠিক হয়ে যায়। ট্রাম্প প্রশাসন আসার পরও সেই সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারত ও পাকিস্তানকে উদাহরণ হিসেবে যদি দেখি; তবে পাকিস্তানে যেমন সরকার পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি ভারতেও। কিন্তু দেশ দুটির মধ্যে বৈরী মনোভাব আগে যেমন ছিল, তেমনই আছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনবিরোধীদের মধ্যে একটি দেশ হল ইরান। সেই ৯০ দশক থেকে ইরানের সঙ্গে মার্কিনিদের বৈরী সম্পর্ক। এমনকি একাধিকবার ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু নীতি নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি হল বিশ্ব শাসন করা; যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল জাতিসংঘ। অবশ্য ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মার্কিনিদের পক্ষে থাকলেও রাশিয়া ও চীন নিজ স্বার্থ ব্যতীত মার্কিনিদের পক্ষে থাকে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। তবে একনায়ক বা রাজতন্ত্র রয়েছে-এমন দেশে সরকার পতনের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন হতে দেখা যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *