উন্নয়ন

হাওরের বিস্ময় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে পর্যটকদের | আজ উদ্বোধন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে বাস্তবায়িত হয়েছে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক। গভীর হাওরের তিন উপজেলা কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা সড়কটি এখন সৌন্দর্য্যপিপাসুদের কাছে হয়ে উঠেছে এক দুর্নিবার আকর্ষণের নাম। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এরই মাঝে আগামীর পর্যটন ঠিকানা হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে সড়কটি। এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

সড়কটি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অভিপ্রায় অনুযায়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়। রাষ্ট্রপতির হাত ধরেই শুভ সূচনা হয় এর নির্মাণ কাজের। ২০১৬ সালের ২১শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। নির্মাণকাজ শেষে এবার হাওরের বিস্ময়খ্যাত অলওয়েদার সড়কটির উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

করোনা পরিস্থিতির কারণে সশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও আজ (বৃহস্পতিবার) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাওরবাসীর স্বপ্নের এ সড়ক উদ্বোধন করবেন তিনি। কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতিপুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা নিয়ে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। এই তিনটি উপজেলা বছরে অর্ধেকের বেশি সময় জলমগ্ন থাকায় এলাকাটি অনগ্রসর ও দুর্গম হিসেবে পরিচিত। হাওর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বর্ষাকাল ও শুষ্ক মৌসুমে তিনটি উপজেলার জনগণকে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো।

হাওরবাসীর এই কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হাওরের বুক চিরে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তার অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সায় দিয়ে উদ্যোগ নেন বিশাল এই কর্মযজ্ঞের।বাংলাদেশের কোথাও হাওরের মাঝখানে এত দীর্ঘ সড়ক নেই। দুই পাশে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ আর ঢেউয়ের গর্জন। যেন কোনো বাউলের সঙ্গে একাগ্র বেজে চলেছে সঙ্গত একতারা। মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সুদীর্ঘ অলওয়েদার সড়ক। প্রকৃতির মাঝে হাওরের জলরাশি আর আকাশের সীমানায় তুখোড় দৃষ্টিও হয়ে যায় বিভ্রান্ত। বিস্তৃত জলরাশি আর আকাশ সীমানা তুলে দিয়ে যেন এখানেই কেবল একাকার। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘ আর জলের এই মনোরম মিতালীর বিস্ময়কর দৃশ্যের সঙ্গে বুকভরে নির্মল বাতাস উপভোগ করে আত্মভোলা হন পর্যটক। চন্দ্র-সূর্য উদয় হয় এখানে জলের ভেতর থেকে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন সৌন্দর্য্য আর ভ্রমণপিপাসুরা। হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখর হাওরের একসময়ের অবহেলিত আর প্রত্যন্ত এই জনপদ। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, নয়নাভিরাম সড়ক ও হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটকদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। দিনের আলো থাকা পর্যন্ত অসাধারণ স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে যেতে ব্যস্ত থাকেন পর্যটকরা। সমুদ্রে সূর্য ডোবার দৃশ্যের সঙ্গে অদ্ভুত মিল এখানে। সূর্যাস্তের সময় লালচে আকাশে ফুটে উঠে ভিন্নরূপ। হাওরের ঢেউ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সম্মিলনে নেচে ওঠে হৃদয়-মন। করোনাভাইরাসের সময়েও সৌন্দর্য্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে হাওরের এ সড়কটি। এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে অনেক ভিআইপিরা আসছেন মিঠামইনে। মন্ত্রী, আইজিপি, সচিব, যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে বিচার বিভাগসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ কেউ না কেউ প্রতি সপ্তাহে আসছেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। এরকম পরিস্থিতিতে ভিআইপিদের প্রটোকল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।

সদ্য নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে ‘হাওরের বিস্ময়’ হিসেবে। এ সড়ককে ঘিরে দুঃখ ঘুচেছে হাওরবাসীর। সড়কটি নির্মিত হওয়ায় অনুন্নত হাওর এলাকায় আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বর্ষায় কর্মহীন অনেক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে হাজারো মানুষের। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন এসব উপজেলার মানুষ। ক্ষুদ্র দোকানি, রেস্তরাঁ মালিক, নৌকার মাঝি, নসিমন-করিমন-লেগুনা-অটোরিকশা-মিশুকের চালক মিলিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য মানুষের। একটি মাত্র সড়ক যেভাবে একটি জনপদের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে দিচ্ছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।

কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলম জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ ৩টি পিসি গার্ডার নির্মাণ, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ও ৭.৬০ লক্ষ বর্গমিটার সিসি ব্লক দ্বারা স্লোপ প্রটেকশন কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকি সেতু এবং ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু এই তিনটি সেতু সড়কটির সৌন্দর্য্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সড়কটি ইটনা উপজেলা সদর থেকে শুরু হয়ে ধনু ও বাউলাই নদীর সমান্তরালে সম্পূর্ণভাবে বিস্তীর্ণ হাওরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে মিঠাইন উপজেলা সদর হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরে সমাপ্ত হয়েছে। বর্ষাকালে হাওরের পানির প্রচণ্ড স্রোতে যেন নির্মিত সড়ক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সড়কের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যে সড়ক বাঁধের উভয় পাশের স্লোপে সিসি ব্লক দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ ও সড়ক বাঁধের স্থায়িত্বের জন্য টো-ওয়াল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা ফলিং এপ্রোনের কাজ করা হয়েছে। বর্ষায় সড়কের দু’পাশের গ্রামসমূহে নৌপথে যাতায়াতের লক্ষ্যে সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে যেন সেচ কাজ বাধাগ্রস্ত না হয় এবং হাওরের উৎপাদিত ফসলবাহী যানবাহন যেন সড়কের নিচ দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে, সেজন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।

মিঠামইনের ইউএনও প্রভাংশু সোম মহান বলেন, অলওয়েদার সড়ক হাওরের সৌন্দর্য্যকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। এ ছাড়া সড়কটি নির্মিত হওয়ায় হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে এখানকার অনেক মানুষ দিনে ৫০০ টাকা আয় করতে পারতো না। অথচ এখন একই ব্যক্তি দিনে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা আয় করছেন। তার মতে, মিঠামইনে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। একইভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অষ্টগ্রাম ও ইটনায়ও। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতো দ্রুত বদলে যাবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, এ সড়কটি হওয়ার ফলে তিন উপজেলার মানুষের যোগাযোগসহ পরস্পরের প্রতি সমপ্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম তিন উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের উপযোগী সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অদূর ভবিষ্যতে মিঠামইন উপজেলার সঙ্গে একটি ফ্লাইওভারের মাধ্যমে করিমগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার সঙ্গে তথা ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *