প্রচ্ছদ

বিস্ফোরণ রোধে সর্বত্র গ্যাস ডিটেক্টিং সেন্সর বসানোর পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: মগবাজারের মতো ভয়াবহ বিস্ফোরণ রোধে ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে ১৪ দফা সুপারিশ দেওয়া হয়েছে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে তিতাস, রাজউক এবং ওয়াসা কী কী দায়িত্ব পালন করলে এমন ঘটনা রোধ করা সম্ভব। ২১ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতামূলক বার্তা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব স্থানে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ বা এলপিজি মজুদ রয়েছে সেখানে হাইড্রো কার্বন গ্যাস ডিটেক্টিং সেন্সর বা অ্যালার্ম ব্যবহার করতে হবে। এতে গ্যাস লিকেজ শনাক্ত করতে অডোরেন্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ভবন থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত সেখানে থাকা তিতাসের পুরোনো লাইন স্থায়ীভাবে ধ্বংস না করায় এ দুর্ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। পাইপলাইন লিকেজ হয়ে জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্ত কমিটি এ ধরনের দুর্ঘটনায় এবারই প্রথম যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের দুটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মতামত নিয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বে এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করে থাকে। দুই-এক দিনের মধ্যে পুলিশের এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কেন দুর্ঘটনা ঘটল আর এতে কার কী ধরনের গাফিলতি ছিল, তা তদন্তে উঠে এসেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

গত ২৭ জুন মগবাজারের বিস্ম্ফোরণে ১২ জন নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক।

দুর্ঘটনার পর তিতাসের পক্ষ থেকে প্রথমে দাবি করা হয়, ওই ভবনে তিতাস গ্যাস লাইনের কোনো সংযোগ নেই। পরে বলা হয়, যে লাইনটি ছিল, তা সচল ছিল না। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা পৃথকভাবে ৬টি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে যে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের সকল অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা; ক্ষয় হওয়া বা নষ্ট লাইন নিয়মিত পরিবর্তন বা মেরামত করা; দ্রুত সকল হাইড্রো কার্বন গ্যাস নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া; গ্যাস সংযোগ রয়েছে এমন আবদ্ধ কক্ষের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ও প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা।

তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে- অতি আবদ্ধ কক্ষের ক্ষেত্রে শাটারপ্রুফ গ্যাস ব্যবহার করতে হবে, যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ‘ব্লাস্ট ওয়েভ’ সহজে নির্গত হতে পারে এবং বিস্ফোরণ ঘটলে গ্লাসের টুকরো স্পিল্গন্টার হিসেবে বিক্ষিপ্ত হতে না পারে। বলা হয়েছে, আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় হাইড্রোকার্বন গ্যাস ব্যবহারকারীকে সতর্কতামূলক নির্দেশনা মানতে হবে; গ্যাস নির্গমন সন্দেহ বা অনুভূত হলে জরুরি সেবা প্রদানকারী নম্বর ‘৯৯৯’-এ জানাতে হবে; তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে ‘৯৯৯’-এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তিতাস, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ডেসকো, ডিপিডিসিসহ সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে হবে; কমিশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; যে কোনো ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগকারী কর্তৃপক্ষ, হাইড্রো কার্বন সংযোগকারী প্রতিষ্ঠান, অগ্নিনির্বাপনকারী কর্তৃপক্ষকে প্রতি বছর নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে হবে; পরিদর্শনের প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থাও নিতে হবে।

প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে- যত্রতত্র এলপিজি সিলিন্ডার মজুদ রোধে এর নিরাপদ মজুদ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; বাধ্যতামূলক করতে হবে রাজউক থেকে প্রতিটি ভবন পরিদর্শন; ভবনের বৈদ্যুতিক লোড হিসাব করে সংযোগ প্রদান এবং যথাযথ মানের বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট ব্রেকার ও সরঞ্জামাদি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

কমিটি তার প্রতিবেদনে বিস্ফোরণজনিত ঘটনা তদন্তের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জানায় যে, গ্যাস বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা বা অগ্নি দুর্ঘটনাজনিত সংশ্নিষ্ট মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে; এবং এ ধরনের সকল দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, বিজ্ঞানসম্মত তদন্ত, দুর্ঘটনা রোধে করণীয় এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রণয়নে পুলিশ অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষয়প্রাপ্ত, বিনষ্ট ও পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক গ্যাসলাইন পরিবর্তন, মেরামত এবং অপসারণের ক্ষেত্রে তিতাসকে সংশ্নিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। ভূমিকম্প বা অন্য কারণে গ্যাসলাইন লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকাররোধে প্রতিবেদনে এখনই কর্ম-পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়। প্রতিবেদনের অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- উন্নত দেশের মতো আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাস পাইপলাইনের লে-আউট প্ল্যান করা; গ্যাস পাইপলাইনের ওপর যে কোনো ধরনের সিভিল কনস্ট্রাকশন তৈরি রোধ করা; গ্যাস কর্তৃপক্ষকে যে কোনো ধরনের সেবা সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টার জন্য চালু রাখা; বিধিসম্মত কারণে কোনো লাইন বিচ্ছিন্ন করলে ভবিষ্যতে সেখানে আবারও অবৈধ সংযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা; এবং সংশ্নিষ্ট গ্যাস নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্যাস প্রবাহ মনিটর সিস্টেম চালু করার ব্যবস্থা করা।

তদন্তের সুপারিশে ওয়াসার ব্যাপারে বলা হয়, সংশ্নিষ্ট গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করে ভূগর্ভে স্থাপিত পানির সরবরাহ লাইন এবং ড্রেনেজ মেরামত, পরিবর্তন, বিলুপ্ত করতে হবে। অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- পানির সরবরাহ লাইন এবং ড্রেনেজ লাইন পরিস্কারের ক্ষেত্রে নিরাপদ প্রবেশের উপযোগিতা নিশ্চিত না হলে কোনো কর্মীকে ড্রেনেজ লাইন বা ম্যানহোলে প্রবেশ করতে না দেওয়া; ড্রেনেজ লাইনে সৃষ্ট বায়োগ্যাস সম্পূর্ণ অপসারণের আগে সেখানে যে কোনো কার্যক্রম বন্ধ রাখা এবং বায়োগ্যাস বা মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে এমন আবর্জনা দ্রুত অপসারণ করা।

প্রতিবেদনে রাজউকের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়- রাজউকের আওতাধীন আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং যে কোনো ধরনের স্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালা অনুসরণে হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করা; আবাসিক ভবনে গৃহস্থালির জ্বালানি হিসেবে এলপিজির মজুদ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বিধিমালা অনুসারে নির্মিতব্য ভবনের পাশে নিরাপদ স্থান সংকুলান সাপেক্ষে নকশা অনুমোদন করা এবং নকশাবহির্ভূত কোনো স্থাপনা থাকলে তা অপসারণ করা। এরপর রাজউক বিধি অনুসারে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। নকশাবহির্ভূত কোনো ভবনের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তা রাজউকের গাফিলতি বলে বিবেচিত হবে।

প্রতিবেদনে তিতাসের ব্যাপারে বলা হয়, মগবাজারে ‘রাখি নীড়’ নামে যে বাড়ি থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত, ২০১৪ সালে তিতাস সেখানকার গ্যাস সংযোগ থেকে শুধু রাইজার বিচ্ছিন্ন করে। এতে গ্যাসের সংযোগ অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও পাইপলাইনের গ্যাস স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়নি। বিস্ফোরণস্থলে গ্যাস নির্গমনের প্রমাণ মিলেছে। তিতাসের পাইপলাইনের নির্গত গ্যাস জেনারেটর রুম থেকে চিলার রুমে জমা হয়। দুর্ঘটনার পর তিতাস সেখানকার গ্যাস পাইপ মেরামত করে এবং সরিয়ে নেয়। তিতাসের পাইপলাইনে লিকেজের কারণে এর আগেও অনেক বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ না করেই ওই ভবনের নিচতলায় শোরুম করেছে বেঙ্গল মিট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না রেখে আবদ্ধ কক্ষে তারা একটি জেনারেটর বসিয়েছে। বেঙ্গল মিট কর্তৃপক্ষ উচ্চ লোডসম্পন্ন চিলার, কুলার ব্যবহার করেছে- যা এই জীর্ণ ভবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ছাড়া ভবনে থাকা শর্মা হাউজ প্রতিষ্ঠানটি সিটিং পজিশন, ওয়াশরুম, ফ্রিজ, ক্যাশ কাউন্টার এবং কিচেন রুমের সমন্বয়ে একটি আবদ্ধ কক্ষ। এ ছাড়া রাখি নীড়ের মালিক নিয়ম অমান্য করে ভবনের নিচতলা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছেন। রাউজক কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পুলিশের এ প্রতিবেদন তৈরিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের মতামত নিয়েছে সেগুলো হলো- ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুরের স্যান্ডস বে, যুক্তরাজ্যের সিএফডি ব্লাস্ট অ্যানালাইসিস, স্টারলিং সলিউশন লিমিটেড ও তুলি ক্রিয়েশন।

পুলিশের তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মগবাজারের মতো দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষার জন্য কোন সংস্থার কী দায়িত্ব রয়েছে, তা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *