স্বাস্থ্য

বাসার করোনা রোগীকে সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ

নিখিল মানখিন :

বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মোট চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর ৮০ শতাংশের বেশি রোগী বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের বাড়তি সতর্কতা নেয়াসহ চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করার উপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় এবং করোনায় মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনেও এই ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা রয়েছে। দৃশ্যমানভাবে সুস্থ মনে হওয়ার পরও যে কোনো মুহূর্তেই জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এই ভ্যারিয়েন্ট। প্রয়োজন হয়ে পড়ে অক্সিজেন, আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় বাড়তি চিকিৎসাসেবার, যা বাসায় ব্যবস্থা থাকে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সরকারিভাবে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংকুলান হচ্ছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে করোনা রোগীদের মধ্যে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা গ্রহণে আতঙ্ক ও অনীহা সৃষ্টি  হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ফলে মোট আক্রান্তের ৮০ শতাংশের বেশি করোনা রোগী নিজেদের বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, দেশে গত বছর প্রথম রোগী শনাক্তের পর প্রায় তিন মাস  স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। ফলে গত বছরের জুনের প্রথম দিকে এসে করোনা থেকে মুক্ত হওয়া বিপুল সংখ্যক করোনা রোগীর সংখ্যা একসঙ্গে হঠাৎ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ঘোষণা দিতে হয়। এর আগে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে মারা যাওয়ার সংখ্যাও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ  বুলেটিনে ঘোষণা দেয়া হয়নি। বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের নিয়মিত মনিটরিং না করার কারণেই এমনটি হয়েছে। এভাবে সঠিক পরামর্শ ও চিকিৎসার অভাবে বাসায় চিকিৎসাধীন অনেক করোনা করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বাসায় করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবার বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজস্টি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, করোনা পরীক্ষার পর যদি পজিটিভ রেজাল্ট আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে। এবং যার পজিটিভ তার সংস্পর্শে যারা আসবে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যেতে হবে। যাদের শরীরে শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য লক্ষণ থাকবে তাদেরকে অবশ্যই হাসপাতালে পাঠাতে হবে। যদি শারীরিক সমস্যা সামান্যতম থাকে তবেই সে বাসায় থাকবে। যারা বাসায় মারা যাচ্ছে তারা সঠিক চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাচ্ছে। হয়তো তারা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাসায় অবস্থান করছে। বাড়িতে নানান জনের নানান পরামর্শে এটা ওটা খাওয়াতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। প্রয়োজন হলে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে বলে জানান ডা. নজরুল ইসলাম।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, করোনা রোগীর পাশাপাশি নন-করোনা রোগীও বাড়ছে। যাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। তবে সকল করোনা রোগীকে হাসপাতালে রাখা সম্ভব হবে না। আক্রান্তদের অধিকাংশই বাসায় অবস্থান করছেন। বাড়তি জটিলতা দেখা দিলেই হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, কিছু রোগী হয়তো হাসপাতালে যেতে চায়নি বা যায়নি। তারা মনে করেছে বাসায় থাকলে ভালো হবে। তাদের হয়তো সেই সক্ষমতা ছিল। আরো কিছু রোগী হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেনি। ভর্তি হতে না পেরে হয়তো বাসায় ফেরত গেছে। যারা বাসায় ছিলেন তাদের শারীরিক অবস্থার হয়তো দ্রুত অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি। যারা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা বাসায় থাকলেও একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। না হলে তারা বুঝতে পারবেন না অবস্থার অবনতি হচ্ছে কিনা। 

তিনি বলেন, সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের করোনা আক্রান্ত বা নন-করোনা সকল রোগীর দায়-দায়িত্ব সরকারের। মহামারির সময় প্রত্যেকটা রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে। কেউ যদি হাসপাতালে না আসে তবে সরকারকে কোনো না কোনো চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীকে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হবে। হাসপাতালে আসলে সরকার নিজেই দায়িত্ব পালন করবে।

তিনি বলেন, রোগীকে ফলোআপ করার জন্য চিকিৎসক ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছিল তারা সেটি করেননি। তারা শুধু কারো সমস্যা হলে টেলিফোনে পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু একজন প্রান্তিক পর্যায়ের লোকের ক্ষেত্রে সেটি হয়ে উঠেনি। এখন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। তাই জেলায় হলে রোগীকে ফলোআপ করার জন্য সিভিল সার্জনের সঙ্গে, উপজেলায় হলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে। তারা প্রতিনিয়ত রোগীদের ফলোআপ করবেন, তাহলে মৃতের সংখ্যা কমানো যাবে।

এবিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা ধূমকেতু ডটকমকে জানান, করোনা রোগীদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা প্রদানে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। সকল করোনা রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয় না। ৮০ শতাংশের বেশি করোনা রোগী বাসায় অবস্থান করেই চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের করোনা আক্রান্ত অন্য সব দেশেও একই ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা চলছে। হটলাইনগুলোর মাধ্যমে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদেরকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের শত শত চিকিৎসক অপেক্ষায় থাকেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হট লাইনগুলোতে প্রতিদিন এসব সংক্রান্ত কয়েক লাখ কল আসে। অন লাইনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে। 

ডা. নাসিমা সুলতানা আরও বলেন, বাসার অন্য সদস্যদেরকে বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের বিষয়ে কড়া নজর রাখতে হবে। শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট হটলাইনগুলোতে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে। শারীরিক অবস্থার অবনতি অব্যাহত থাকলে রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *