অভিমতমাতৃভূমি

জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি – সুজন ময় চৌধুরী

সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় সুপ্রিয় পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি “জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি” শিরোনামে সৃজনশীল লেখা আহ্বান করেছেন ধূমকেতু বাংলা (dailydhumketu.com)-এর সম্পাদক ও প্রকাশক খোকন কুমার রায়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই লেখা পাঠিয়েছেন। তাদের লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে ছাপা হচ্ছে।

জন্মভূমিকে কেন ভালোবাসি

সুজন ময় চৌধুরী

ভালোবাসা এমনই একটি নিষ্পাপ শব্দ যার মধ্যে কোনো খাদ থাকে না। যা অন্তর থেকে সৃষ্টি হয় আর পরম আনন্দকে উপলব্ধি করে। একটি সুখের স্বপ্ন বোনার ইতিহাস গড়ে। এটি একটি আপেক্ষিক ভাবাবেগ। মা এবং মাতৃভূমি দুটোই একজনের ব্যক্তিজীবনে বড় প্রভাব সৃষ্টি করে আছে। যে মা’কে ভালোবাসে সে ব্যক্তি অবশ্যই তার জন্মভূমিকে ভালোবাসবে। দুটোই হল তার আপন সত্তা, একেবারে তার নিজস্ব ভুবন। এখানে কোনো সীমারেখা নেই, বাধা নেই, থাকবে না কোনো স্বার্থ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

আরও পড়ুন: শুভ জন্মদিন কবিগুরু || সংকটে প্রেরণা হয়ে পাশে থাকে রবীন্দ্রনাথ

জননী আর জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও পবিত্র এবং উত্তম। এ কথাটি কবি, লেখক, সাহিত্যিক, মহামানব সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। তাই আমি একজন মানবসন্তান হিসেবে তার বাইরে নই। বিজ্ঞাননির্ভর তথ্য যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, মানুষের শরীর প্রাকৃতিকভাবে তৈরি। তার জীনগত সত্তা তার বংশানুক্রমিক। তাই সে যে প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়ে উঠে সেখানে তার একটি অবহাওয়াগত, সামাজিক ও প্রকৃতিগত কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠে। আর প্রকৃতিটা হলো তার সামাজিক অবস্থান। অবস্থানটি নির্ভর করে একটি এলাকাভেদে। জননী যেমন তাকে লালন পালন করে বড় করে তোলে, তেমনিভাবে প্রকৃতিও তাকে বাড়তে সাহায্য করে। যার ফলশ্রুতিতে জন্মভূমির প্রতি ঋণী হয়ে থাকে। একটা অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি হয়, যার মধ্যে কোনো প্রকার খাদ থাকে না। একজন সন্তানের মায়ের সাথে যে নিবিড় সম্পর্ক থাকে তেমনি জন্মভূমির সাথেও থাকে নাড়ীর টান।

প্রকৃতির দিক দিয়ে যদি তুলনা করা হয়, দেখুন- মরুভূমিতে যে গাছ জন্মে তা কিন্তু অন্য এলাকায় জন্মে না, বা কৃত্রিমভাবে বেশী দিন বাঁচানো যায় না। তেমনি যে বা যিনি তার জন্মভূমিতে আমৃত্যু বসবাস করেন না, তার ভিতরে একটি আক্ষেপ থেকে যায়। যা তার মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্তও অনুধাবন করে। পরবাসী জীবন একটি পরগাছা প্রাণীর মতো জীবন ধারণ করে থাকে। আমরা যদি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কপোতাক্ষ নদ” কবিতাটি বিশ্লেষণ করি, সেখানে এই ভালোবাসার প্রমাণ মিলে।

আরও পড়ুন: ৯ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী

এবার আলোচনা করা যাক ভাষা ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে। আমার পূর্ব পুরুষগণ বাংলাদেশী। আমি এ দেশের সন্তান, আমার জন্মভূমিতে রয়েছে আমার পরিবারের শত বছরের ইতিহাস। আমার সত্তা, আমার বৈশিষ্ট্য সব কিছু মিলে রয়েছে একটি সুষ্পষ্ট জন্মভূমির ছাপ। দেখুন আমাদের জাতীয় সংগীতেও রয়েছে গভীর দেশপ্রেম। এত সুন্দর অর্থবহ সংগীত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। অন্যদিকে, দেখুন পৃথিবীর একমাত্র জাতি আমরা যারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছি। আর কোনো দেশের এ রকম ইতিহাস নেই। তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তাঁর শ্রদ্ধাবোধ “ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা”। তা শুধুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নিদর্শন করে না, এটি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও বটে। তাইতো আমার জন্মভূমির ভাষা আন্তজার্তিক অফিসিয়াল ভাষাতে স্থান করে নিয়েছে।

ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে, আমরা ভারত উপমহাদেশের অধিবাসী। এ দেশের অধিবাসীগণ এমনিতেই আবেগপ্রবণ এবং ধর্মভীরু। যার কারণে তাদের সামাজিক বন্ধন ও রক্ষণশীলতার রয়েছে বিভিন্ন নিদর্শন। তাছাড়া মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে মনের মধ্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাই তাদের আবেগপ্রবণতা এক অনন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করে। ফলে তারা দেশপ্রেমেও বিভোর হয়। প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে বসবাস করে থাকে।

সুজন ময় চৌধুরী

শত কষ্টের মধ্যেও দেশ ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করতে পারে না। তাছাড়া সামাজিক বন্ধনে রয়েছে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও নির্ভরতা। প্রাচ্যের দেশগুলোতে যেমন একজন ১৮ বছর বা সাবালক হলে সে তার স্বাধীনতা লাভ করে এমনকি ভাগ্য অন্বেষণে মা-বাবা থেকে দূরে চলে যায়। কিন্তু এখানে বংশপরম্পরা রয়েছে তার দায়িত্ববোধ এবং পারিবারিক বাধ্যবাধকতা। এ থেকে জন্ম হয় অন্য এক ভালোবাসা।

এবার আলোচনা করা যাক রাজনৈতিক দিক থেকে। পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, ইতিপূর্বে ছোট-বড় ১৪টি শাসক দলের ছিল দৃপ্তপদচারণা। প্রত্যেকেই উৎখাত হয়েছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে এবং যুদ্ধের মাধ্যমে। যেমন- পর্তুগীজ, সেনবংশ, পালবংশ, মোঘল শাসক সর্বশেষ ইংরেজ শাসক বেশীর ভাগ সময় ধরে এ দেশ শাসন করেছে। তাছাড়াও আরও কিছু পরাক্রমী শক্তিশালী শাসক দল কালে কালে শাসন করে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে রয়েছে এক অনার্যতার সুষ্পষ্ট ছাপ। প্রত্যেকটি শাসক দলের শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হয়ে তৈরি হয়েছে নিজস্ব জাতিসত্তা। যার ফলশ্রুতিতে ফকির বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, দেশ বিভাগ আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন; পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আজ ফিরে পেয়েছি আমাদের দেশ-বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তা। এদেশ আমার, এদেশ অর্জনের জন্য আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করেছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের রয়েছে প্রতিটা আন্দোলনের সাথে আকুন্ঠ সমর্থন। শোষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ধর্ষিত হয়েছে কালে-কালে। কোনো কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে রেখেছে জীবন বাজি; হারিয়েছে প্রাণ। তাই এ জন্মভূমির প্রতি রয়েছে আমার নাড়ীর টান, অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ থেকেই সৃষ্টি হয় গভীর ভালোবাসা। দেখুন কেউ কিন্তু ‘দেশত্যাগ দিবস’ পালন করে না, কিন্তু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করা হয়। এটি একটি ভালোবাসার নিদর্শন বা অনুকরণীয় করে রাখার জন্য পালন করা হয়ে থাকে।

পাঠকগণ, অনেকেই বলবেন- অমুক বিদেশ গিয়ে খুব ভালো আছে, ভালো করছে। এদেশে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, নেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নেই স্বাধীনতা, আছে ধর্মান্ধতা। খোঁজ নিয়ে দেখুন- কতটুকু ভালো আছে? ঐ দেশে সে ২য় বা ৩য় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদায় দিনাতিপাত করছে। আছে শ্রেণীবিভেদ আর বৈষম্য। শুধু আর্থিক স্বচ্ছলতাই ভালো থাকার সর্বশেষ উপায় নয়। কিছুদিন পর পর রাজনৈতিক দলগুলোর হুমকি-ধামকি, নাগরিত্ব বাতিল, অপারেশন পুশব্যাক ইত্যাদি। এসবের টেনশন যে কত ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তাভুক্তভোগীই জানেন। আরেকটি বিষয় হলো- বিদেশের মাটিতে আপনি বিপদে পড়েছেন, কেউ আসবে না আপনার হয়ে বিনাস্বার্থে। কাজেই দেশকে ভালোবাসুন, দেশের জন্য কাজ করুন, আপনি-আমি ইচ্ছা করলে ভালো রাখতে পারব এবং থাকতে পারব।

এবার আসি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। দেশের ভবিষ্যৎ আপনি-আমি সবাই। সবাই যদি একসাথে একযোগে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারি, দেশের ভবিষ্যৎ এমনিতেই ভালো হবে। একটা কথা আমাদের সবার মাথায় রাখতে হবে- ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য প্রয়োজন আত্মনিয়োগ করা, বিশেষজ্ঞান অর্জন করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। তাই তো কবি আক্ষেপ করে ও বড় আশা করে লিখেছেন- “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোকপাত করলে দেখা যাবে ৩য় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নীরব আত্মঘাতী রাজনীতি চলছে। কোথাও চলছে মারণাস্ত্র নিয়ে, কোথাও চলছে নেট দুনিয়া নিয়ে, কোথাও চলছে ধর্মান্ধতা নিয়ে। সবচাইতে একটি অপ্রিয় সত্য কথা হলো সংখ্যালঘু হিসেবে আপনি যে দেশেই জন্মগ্রহণ করেন না কেন, আপনাকে সংখ্যাগুরুর যাতনা সহ্য করতে হবে। আর তা বর্ণে হোক বা ধর্মে হোক। তারপরও আমরা অনেক ভালো আছি। কতিপয় ব্যক্তি স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে মুখোশধারী রাজনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম বা দেশ নিয়ে কোনো চিন্তা করার সময় নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে প্রাচ্যে বা অন্যদেশে। এদেশের অর্থ পাচার করে অন্য দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে। একটা সময় তারা ভোগ করারও সময় পায় না, সময়ের অতল গহ্বরে চলে যায়। তারা সমাজে বেশী দিন টিকে থাকে না, কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনমনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে। তাদেরকে উদাহরণ না করে, নিজেকে উদাহরণ হিসেবে তৈরি করুন।

প্রায়শঃই একটি লেখা চোখে পড়ে- “আগামী ২০ বছর পর এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন থাকতে পারবে না।” এ ধরনের স্ট্যাটাস দেয়া লোকগুলো দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু। তারা জন্মভূমিকে ভালোবাসার অযোগ্য। আর স্ট্যাটাস পড়ে নীরবে নিভৃত্তে কত শত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু ঐ ব্যক্তিও জানেন না। বরঞ্চ যদি ঐ ব্যক্তি লিখতেন যে- আগামী ২০ বছর পর এ দেশে সংখ্যালঘুদের বুনিয়াদ আরও শক্ত হবে। এতে একটা শ্রেণী থমকে যেত। দেশপ্রেম আরও গভীর হতো, মানুষ মানুষের প্রতি হতো আরও শ্রদ্ধাশীল।

ব্যক্তি প্রয়োজনে যখন দেশের বাইরে যাই, তখন বুঝতে পারি জন্মভূমির স্বাদ।

সর্বোপরি আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমার মৃত্যু যেন এ মাটিতে হয়- এ প্রত্যাশা রাখি।

লেখক: সিনিয়র অফিসার, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট সেক্টর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *