সাকিব আইপিএল নিলামে কেন দল পেলেন না

সাকিব আইপিএল নিলামে কেন দল পেলেন না, এ বিষয়ে কথা উঠলে ধারণা করা হচ্ছিলো গত আইপিএলে যা পারফরমান্স, তাতে দল পাওয়া নিয়ে সংশয়ের জায়গা ছিল। পাশাপাশি ছিল আশার ছবিও।

দল বেড়েছে এবার দুটি। বিপিএলে ধারাবাহিকতা বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফর্মের বার্তা দেওয়াও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সাম্প্রতিক ফর্মের উত্তাপ নিলামের টেবিলকে স্পর্শ করতে পারল না। শঙ্কাই হয়ে গেল সত্যি। নিলামে দুই দফায় নাম উঠলেও আইপিএলে এবার দল পেলেন না সাকিব আল হাসান।
বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য বড় কোনো ঘটনা এটি নয়। অনেক বড় তারকাই আইপিএলের নিলামে পাত্তা পান না খুব একটা। এবারও অবিক্রিতদের উদ্যানে মহীরুহের অভাব নেই। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে প্রবলভাবেই নাড়িয়ে দিয়েছে সাকিবের দল না পাওয়া।

আন্তর্জাতিক আঙিনায় এদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তিনি। আইপিএলেও ছিলেন নিয়মিত মুখ। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ২০০৯ ও ২০১০ আইপিএলে নিলাম বাদ দিলে আর কোনো নিলামেই তার নাম এভাবে স্রেফ হাওয়ায় হারিয়ে যায়নি। সেই সাকিবের এবার নিলামে দল না পাওয়া ছুঁয়ে গেছে দেশের ক্রিকেটের সব সীমানা। তার নিলাম-হতাশার আলোচনার আড়ালে চাপা পড়েছে বিপিএলের শেষ সময়ের উত্তেজনাও।

চলছে কারণ অনুসন্ধান কিংবা বিশ্লেষণও। এবার মেগা নিলাম, দলগুলির বাজেট বিশাল। আগের চেয়ে দুটি দল বেড়ে যাওয়ায় আরও বেশি ক্রিকেটারদের সুযোগ। সেখানে সাকিব কেন দল পেলেন না, নিশ্চিতভাবে তা বলা কঠিন। তবে নানা সমীকরণ বিবেচনায় রেখে কিছু কারণ ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে।

মূলত, দুটি ব্যাপার প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে এখানে, গত আইপিএলে তার পারফরম্যান্স এবং এবারের আইপিএলে তাকে কত দিনের জন্য পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয়।

গতবারের নিলামে ২ কোটি ভিত্তিমূল্যের সাকিবকে কলকাতা ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতে দলে নেয় পাঞ্জাব কিংসের সঙ্গে টেবিলের লড়াইয়ে জিতে। সেই সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি তিনি। ৮ ম্যাচ খেলে মাত্র ৯.৪০ গড় ও কেবল ৯৭.৯১ স্ট্রাইক রেটে রান করেছিলেন মোটে ৪৭, উইকেট নিতে পেরেছিলেন স্রেফ ৪টি।

অমন পারফরম্যান্সের পর কলকাতা তাকে ধরে রাখা ক্রিকেটারদের তালিকায় রাখেনি অনুমিতভাবেই। আইপিএল ক্যারিয়ারের ৯ মৌসুমের ৭টিতেই যে দলে খেলেছেন, সেই কলকাতা নিলামেও হয়তো আর আস্থা পায়নি তার ওপর নতুন বিনিয়োগের। গত আসরের পারফরম্যান্স দেখে দমে যেতে পারে অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের আগ্রহও।

আইপিএলে দল পাওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই বড় প্রভাবক কোনো ক্রিকেটারের প্রাপ্যতা। মহাতারকা হলে কিংবা একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ক্রিকেটারকে হয়তো অল্প সময়ের জন্য হলেও পেতে মরিয়া থাকে দলগুলি।

কিন্তু সাকিবের মতো ক্রিকেটার, যাদের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা খুব জরুরি, চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স না হলেও যারা মূলত নানাভাবে অবদান রেখে দলের ঘাটতির জায়গাগুলি পূরণ করার চেষ্টা করেন, ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন টুর্নামেন্টের নানা বাঁকে, এই ধরনের ক্রিকেটারকে মৌসুমের একটা লম্বা সময়ের জন্য পেতে চায় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো।

এবার আইপিএল শুরুর সময় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে সম্ভাব্য যে সময় ধরে নেওয়া আছে, মার্চ-এপ্রিলের ওই সময়টায় বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর যেমন আছে, তেমনি মে মাসে দেশের মাঠে আছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ।

যদিও ভারতভিত্তিক কয়েকটি ক্রিকেট ওয়েবসাইটের খবর, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজের সময়টায় সাকিব আইপিএল খেলবেন বলেই আভাস দেওয়া ছিল আইপিএল কতৃপক্ষের কাছে। সেটি সত্যি হলে হয়তো আইপিএলের শুরুর সময়টা থেকে পাওয়া যেত সাকিবকে। কিন্তু মে মাসের তিন-চার সপ্তাহ যে আইপিএলে তাকে পাওয়া যেত না, এটি নিশ্চিতই।

এসব অনিশ্চয়তা-টানাপোড়েনের কারণে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকতে পারে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাকিব সত্যিই বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট না খেললে অবশ্য প্রায় পাঁচ সপ্তাহের মতো তাকে পাওয়া যেত আইপিএলে। এটাও খুব কম সময় নয়। তবে গতবারের পারফর‌ম্যান্সের সঙ্গে এবারের অনিশ্চয়তা যোগ করে এক পাল্লায় রাখলে, সাকিবকে বিবেচনা না করার কারণ আছে বৈকি। অন্য পাল্লায় টি-টোয়েন্টির উপযোগী কার্যকর ক্রিকেটারের অভাব যে নেই!

সাকিবের বয়সও প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। আগামী মাসেই ৩৫ পূর্ণ হবে তার। তিন বছরের মেগা নিলামে তার ওপর বিনিয়োগ করা ঝুঁকির মনে হতেই পারে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছে।

এবারের বিপিএলের আগে ব্যাট হাতে তার পারফরম্যান্সও জন্ম দিয়েছিল বেশ কিছু প্রশ্নের। বোলিং তার বরাবরই বেশ ক্ষুরধার। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে তার ব্যাটিংয়ের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় জেগে উঠছিল। পরে অবশ্য বিপিএলে টানা ৫ খেলায় ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার পথে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন। টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন যেন। কিন্তু বিপিএলের পারফরম্যান্সের ঢেউ যে আইপিএলের নিলাম টেবিলে আছড়ে পড়েনি, সেটা তো এখন ষ্পষ্টই!

এমনকি তার ২ কোটি রুপি ভিত্তিমূল্যও তার বিপক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। তার প্রাপ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা মাথায় রাখলে, কোনো কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে এই অঙ্ক একটু বেশিই মনে হতে পারে। সেটির একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে নিলামের একদম শেষাংশে। তখন নিলামে ছিল কেবল ৬টি দল, তাদের কাছ থেকে দুটি করে ক্রিকেটারের তালিকা চাওয়া হয়েছিল, যাদের প্রতি আগ্রত আছে তাদের। সেই সময়টায় মোহাম্মদ নবিকে দলে নেয় সাকিবের পুরনো দল কলকাতা। আফগান স্পিনিং অলরাউন্ডারের ভিত্তিমূল্য ছিল ১ কোটি রুপি।

নিলামের ফাঁকে স্টার স্পোর্টস-এ কথোপকথনে বিশ্লেষক ও সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান আকাশ চোপড়া তুলে ধরলেন সাকিবের দল না পাওয়ার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ।

“সাকিবের প্রাপ্যতা একটি ব্যাপার। কত সময় তাকে পাওয়া যাবে, এটা নিশ্চিত নয়। এটি বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। আরেকটি ব্যাপার হলো, সে খুব ভালো অলরাউন্ডার হলেও আইপিএলে তার পরিসংখ্যান খুব সমৃদ্ধ নয়। ভালো পারফরম্যান্স আছে, কিন্তু তার রেকর্ড অসাধারণ। এবার বিপিএলে খুব ভালো করলেও তা আসলে পাত্তা পায়নি।”

আইপিএলে রেকর্ড নিয়ে আকাশ চোপড়ার মন্তব্যও যথেষ্ট যৌক্তিক। টুর্নামেন্টে নানা সময়ে তার দারুণ কিছু পারফরম্যান্স আছে বটে। ২০১২ আইপিএলের ফাইনালে ভালো বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতে শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ এক ছোট্ট ক্যামিও খেলেন। ২০১৪ আইপিএলের ফাইনালেও বেশ ভালো বোলিং করেন। কলকাতার ওই দুটি শিরোপা জয়ে আসরজুড়েই তার ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। তবে ২০১৪ আসর ছাড়া ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত অলরাউন্ড মৌসুম তার কাটেনি কোনোবারই।

সব মিলিয়ে আইপিএল ৭১ ম্যাচে তার ফিফটি স্রেফ ২টি। মোট ৭৯৩ রান করতে পেরেছেন ১৯.৮২ গড় ও ১২৪.৪৮ স্ট্রাইক রেটে। অবশ্য ব্যাটিং অর্ডারে থিতু জায়গা তিনি পেয়েছেন কমই। তবে খুব প্রভাববিস্তারি ব্যাটসম্যান না হলে বিদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে থিতু জায়গা পাওয়াও তো কঠিন! বল হাতে ৭১ ম্যাচে তার উইকেট ৬৩টি। ওভারপ্রাত রান দিয়েছেন ৭.৪৩।

এই পরিসংখ্যান খারাপ নয় অবশ্যই, তবে খুব ভালো বা দারুণ কিছুও নয়। এই ৩৫ ছুঁইছুঁই বয়সে তিনি সেরা সময়কে পেছনে ফেলে এসেছেন, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এটাও ধরে নিতে পারে।

একেক ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর ভাবনায় থাকতে পারে এই একেকটি কারণ। কিংবা অন্য কিছু। কেউ চোট পেলে বা অসুস্থ হলে, তার বদলি হিসেবে আইপিএল খেলার সুযোগ এখনও আছে। তবে নিলামে দল না পাওয়া যে সাকিবের জন্য ধাক্কা, এটা বলে দেওয়ায় ঝুঁকি খুব বেশি নেই। তার ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভাবনায়ও নতুন নাড়া দিতে পারে এটি।

আবার, কে জানে, এটা তাকে তাতিয়েও দিতে পারে। অতীতে অনেকবারই সম্ভাব্য সব সমীকরণকে ভুল প্রমাণ করে তিনি ফিরে এসেছেন নতুনভাবে। চ্যাম্পিয়নদের জন্য উপক্ষো তো অনেক সময়ই জ্বলে ওঠার রসদ!

সুত্রঃ বিডি নিউজ ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *