ধর্ম ও জীবন ডেস্ক, সুখবর ডটকম:  আল্লাহ হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। অন্যান্য নবি-রাসুলদের আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়টিও সুরা আম্বিয়ায় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অনেক-নবি রাসুল পাঠিয়েছেন। সব নবি-রাসুলের দাওয়াতের স্লোগান ছিল এক ও অভিন্ন। সে সম্পর্কে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানাতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِ اَنَّهٗ

‘(হে রাসুল!) আপনার আগে আমি যে রাসুলই পাঠিয়েছি, তাকে এ (দাওয়াতের) নির্দেশ দিয়েই পাঠিয়েছি যে-

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘আমি (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ২৫)

কোরআন নাজিলের মাসে মুমিন মুসলমানের ক্ষমার জন্য অন্যতম ইবাদত হচ্ছে এই রাতের বিশেষ তারাবিহ নামাজ।

সুরা আম্বিয়া (১১২)

মানুষের আক্বিদা বিশ্বাস নিয়ে মক্কায় নাজিল হয়েছে সুরা আম্বিয়া। ইসলামের প্রথম যুগের সুরা এটি। ১৮ জন নবি-রাসুলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ সুরায়। সুরাটিতে দাওয়াতের ইতিহাস স্থান পেয়েছে।

নবি রাসুলদের দাওয়াতের ইতিহাস, পদ্ধতি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়া হয়েছে এক অন্যরকম সান্ত্বনা। কারণ এতে ওঠে এসেছে, তৎকালীন অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এ ১৮ জন নবির আচরণ, অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনা।

এত কিছুর পরও আল্লাহ তা’আলা সব পয়গাম্বরকে কিভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছেন সে আলোচনাও রয়েছে এ সুরায়। এ সুরার তেলাওয়াত অধ্যায়নই মুমিন মুসলমানকে দ্বীনের দাওয়াত ও আমলে একনিষ্ঠ হতে সহায়তা করবে। পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার দিকে নিয়ে যাবে।

নিম্নে সুরাটি সংক্ষিপ্ত আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো

বিচার দিবসের বর্ণনায় শুরু হবে আজকের তারাবিহ। প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা;আলা বিচার দিবসের কথা তুলে ধরেছেন। যে দিন সম্পর্কে অবিশ্বাসীরা ছিল চিন্তাহীন। তাই আয়াতে মানুষের হিসাব-নিকাশ ও তাদের উদাসিনতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

اِقۡتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمۡ وَ هُمۡ فِیۡ غَفۡلَۃٍ مُّعۡرِضُوۡنَ ۚ

‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ১)

মানুষের কাছ থেকে তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেওয়ার দিন অর্থাৎ কেয়ামতের দিন ঘনিয়ে এসেছে। এখানে পৃথিবীর বিগত বয়সের অনুপাতে ঘনিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। লোকদের নিজেদের কাজের হিসাব দেওয়ার জন্য তাদের রবের সামনে হাজির হওয়ার সময় আর দূরে নেই।

মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন একথারই আলামত যে, মানব জাতির ইতিহাস বর্তমানে তার শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এখন সে তার সূচনাকালের পরিবর্তে পরিণামের বেশি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। সূচনা ও মধ্যবর্তীকালীন পর্যায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং এবার শেষ পর্যায়ে শুরু হয়ে গেছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর একটি হাদিসে একথাই বলেছেন। তিনি নিজের হাতের দুটি আঙ্গুল পাশাপাশি রেখে বলেন- ‘আমার আগমন এমন সময়ে ঘটেছে। যখন আমি ও কেয়ামত এ দুটি আঙ্গুলের মতো অবস্থান করছি।’ (বুখারি ৪৯৯৫)

আমার পরে শুধু কেয়ামতই আছে, মাঝখানে অন্য কোন নবির আগমনের অবকাশ নেই। যদি সংশোধিত হয়ে যেতে চাও তাহলে আমার দাওয়াত গ্ৰহণ করে সংশোধিত হও।

অথচ মানুষ কোনো সতর্কতা সংকেত ও সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি দেয় না। দুনিয়া নিয়ে তারা এতই মগ্ন যে, আখেরাতের কথা ভুলে গেছে। আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে যে আল্লাহর উপর ঈমান, তাঁর ফরায়েজগুলো আদায় করতে হয়, নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকতে হয় সেটার জন্য তারা প্ৰস্তুতি নিচ্ছে না। (ফাতহুল কাদির)

আর যে নবি তাদেরকে সর্তক করার চেষ্টা করছেন তার কথাও শোনে না। তাদের রাসুলের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে অহি এসেছে তারা সেটার প্রতি দৃষ্টি দেয় না। এ নির্দেশটি প্রাথমিকভাবে কুরাইশ ও তাদের মত যারা কাফের তাদেরকে করা হচ্ছে।’ (ইবনে কাসির)

مَا یَاۡتِیۡهِمۡ مِّنۡ ذِکۡرٍ مِّنۡ رَّبِّهِمۡ مُّحۡدَثٍ اِلَّا اسۡتَمَعُوۡهُ وَ هُمۡ یَلۡعَبُوۡنَ

‘যখনই তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে কোনো নতুন উপদেশ আসে তখন তারা তা কৌতুকভরে শ্রবণ করে।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ২)

কোরআনের যে নতুন সুরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাজিল হয় এবং তাদেরকে শুনানো হয়। (ইবনে কাসির) তারা এটাকে কোনো গুরুত্বের সঙ্গে শুনে না। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আহলে কিতাবদের তাদের কাছে যা আছে তা জিজ্ঞাসা কর, অথচ তারা তাদের কিতাবকে বিকৃতকরণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বাড়ানো-কমানো সবই করেছে। আর তোমাদের কাছে রয়েছে এমন এক কিতাব যা আল্লাহ সবেমাত্র নাজিল করেছেন, যা তোমরা পাঠ করে থাক, যাতে কোন কিছুর সংমিশ্রণ ঘটেনি।’ (বুখারি ২৬৮৫)

যারা আখেরাত ও কবরের আজাব থেকে গাফেল এবং তজন্যে প্রস্তুতি গ্ৰহণ করে না, এটা তাদের অবস্থার অতিরিক্ত বর্ণনা। যখন তাদের সামনে কোরআনের কোনো নতুন আয়াত আসে এবং পঠিত হয়, তখন তারা একে কৌতুক ও হাস্য উপহাসচ্ছলে শ্রবণ করে। তাদের অন্তর আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসিন থাকে। এর অর্থ এটিও হতে পারে যে, তারা খেলাধুলায় লিপ্ত থাকে, কোরআনের প্রতি মনোযোগ দেয় না এবং এরূপ অৰ্থও হতে পারে যে স্বয়ং কোরআনের আয়াতের সঙ্গেই তারা রঙতামাশা করতে থাকে। আবার এ অর্থও হতে পারে যে, এখানে খেলা মানে হচ্ছে এই জীবনের খেলা। আল্লাহ ও আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল লোকেরা এ খেলা খেলছে।’ (কুরতুবি)

অবিশ্বাসীরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবি হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না। তারা তাঁকে নিজেদের মতো মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করছিল এমনকি তাকে জাদুকর বলছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের কথাটি এভাবে তুলে ধরেছেন-

لَاهِیَۃً قُلُوۡبُهُمۡ ؕ وَ اَسَرُّوا النَّجۡوَی ٭ۖ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ٭ۖ هَلۡ هٰذَاۤ اِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ ۚ اَفَتَاۡتُوۡنَ السِّحۡرَ وَ اَنۡتُمۡ تُبۡصِرُوۡنَ

‘তাদের অন্তর থাকে অমনোযোগী। আর যারা জালেম তারা গোপনে পরামর্শ করে, এ তো তোমাদের মত একজন মানুষই, তবুও কি তোমরা দেখে-শুনে জাদুর কবলে পড়বে?’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৩)

তারা (অবিশ্বাসীরা) বলতো, এ ব্যক্তি তো কোনক্রমে নবি হতেই পারে না। কারণ এতো আমাদেরই মতো মানুষ, খায় দায়, বাজারে ঘুরে বেড়ায়, স্ত্রী-সন্তানও আছে। কাজেই এ লোক কি করে নবি হয়? তবে কিনা এ ব্যক্তির কথাবার্তায় এবং এর ব্যক্তিত্ত্বের মধ্যে জাদু আছে। ফলে যে ব্যক্তি এর কথা কান লাগিয়ে শোনে এবং এর কাছে যায় সে এর ভক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই যদি নিজের ভালো চাও তাহলে এর কথায় কান দিয়ো না এবং এর সঙ্গে মেলামেশা করো না। কারণ এর কথা শোনা এবং এর কাছে যাওয়া সুস্পষ্ট জাদুর ফাঁদে নিজেকে আটকে দেওয়ার মতই।’ (ইবন কাসির)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবিশ্বাসীদের মিথ্যা রটনা ও গুজবের ব্যাপারে যে ঘোষণা দেন; সেটি হলো এমন-

قٰلَ رَبِّیۡ یَعۡلَمُ الۡقَوۡلَ فِی السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ۫ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

‘সে (রাসূল) বলল, ‘আমার রব আসমান ও যমীনের সমস্ত কথাই জানেন এবং তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৪)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব রটনার এই অভিযানের জবাবে এটাই বলেন যে, তোমরা যেসব কথা তৈরি করো, সেগুলো জোরে জোরে বলো বা চুপিসারে কানে কানে বলো, আল্লাহ সবই শোনেন ও জানেন। (ফাতহুল কাদির)

তিনি আসমান ও জমিনের সমস্ত কথা জানেন। কোন কথাই তার কাছে গোপন নেই। আর তিনিই এ কোরআন নাজিল করেছেন। যা আগের ও পরের সবার কল্যাণ সমৃদ্ধ। কেউ এর মত কোনো কিছু আনতে পারবে না। শুধু তিনিই এটা আনতে পারবেন যিনি আসমান ও জমিনের গোপন রহস্য জানেন। তিনি তোমাদের কথা শুনেন, তোমাদের অবস্থা জানেন। (ইবনে কাসির)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا قَبۡلَکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ

‘আর তোমার পূর্বে আমি পুরুষই পাঠিয়েছিলাম, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠাতাম। সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর যদি তোমরা না জান।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৭)

এটি হচ্ছে ‘এ ব্যক্তি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ’ তাদের এ উক্তির জবাব। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মানবিক সত্তাকে তাঁর নবি না হওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে পেশ করতো। জবাব দেওয়া হয়েছে যে, পূর্ব যুগের যেসব লোককে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে বলে তোমরা মানো তারা সবাইও মানুষ ছিলেন এবং মানুষ থাকা অবস্থায়ই তারা আল্লাহর অহি পেয়েছিলেন।

যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘আর আমরা আপনার আগেও জনপদবাসীদের মধ্য থেকে পুরুষদেরকেই পাঠিয়েছিলাম, যাদের কাছে অহি পাঠাতাম।’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ১০৯)

এ আয়াত থেকে আরও জানা গেল যে, মহান আল্লাহ নবুওয়ত ও রিসালাতের জন্য শুধুমাত্র পুরুষদেরই মনোনীত করেছেন। নারীরা এটার যোগ্যতা রাখে না বলেই তাদের দেওয়া হয়নি। সৃষ্টিগতভাবে এতবড় গুরু-দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। নবুওয়তের প্রচার-প্রসারের জন্য যে নিরলস সংগ্রাম দরকার হয় তা নারীরা কখনো করতে পারে না। তাদেরকে তাদের সৃষ্টি উপযোগী দায়িত্বই দেওয়া হয়েছে। তাদের দায়িত্বও কম জবাবদিহিতাও স্বল্প। তাদের এ দায়িত্ব না দিয়ে আল্লাহ তাদের উপর বিরাট রহমত করেছেন।

সব নবিই পুরুষ মানুষ ছিলেন। না মানুষ ছাড়া, না পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ নবি হয়েছেন। অর্থাৎ, নবুয়ত শুধুমাত্র মানুষের ও পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট। এ থেকে বোঝা গেল যে, কোনো নারী নবি হননি। কারণ নবুয়তের দায়িত্ব ও কর্তব্য এমন, যা নারীদের স্বভাব ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আল্লাহ তাআলা বহু জালেমের জনপদকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ کَمۡ قَصَمۡنَا مِنۡ قَرۡیَۃٍ کَانَتۡ ظَالِمَۃً وَّ اَنۡشَاۡنَا بَعۡدَهَا قَوۡمًا اٰخَرِیۡنَ

‘আমি কত জনবসতিকে ধ্বংস করেছি যারা ছিল জালিম এবং তাদের পর অন্য জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ১১)

দুনিয়ায় আল্লাহর সব সৃষ্টি অনর্থক নয়, এ কথা অনেক সুরায় আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। এ সুরায়ও তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আল্লাহ বলেন-

وَ مَا خَلَقۡنَا السَّمَآءَ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَهُمَا لٰعِبِیۡنَ  لَوۡ اَرَدۡنَاۤ اَنۡ نَّتَّخِذَ لَهۡوًا لَّاتَّخَذۡنٰهُ مِنۡ لَّدُنَّاۤ ٭ۖ اِنۡ کُنَّا فٰعِلِیۡنَ

‘আকাশ পৃথিবী এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি ক্রীড়া উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম, তবে আমি আমার কাছে যা আছে তা দ্বারাই তা করতাম, যদি আমাকে করতে হত।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১৬-১৭)

আল্লাহ তা’আলা সত্যের প্রকাশ ঘটাবেন। মিথ্যা ধ্বংস হবে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-

بَلۡ نَقۡذِفُ بِالۡحَقِّ عَلَی الۡبَاطِلِ فَیَدۡمَغُهٗ فَاِذَا هُوَ زَاهِقٌ ؕ وَ لَکُمُ الۡوَیۡلُ مِمَّا تَصِفُوۡنَ

‘বরং আমি মিথ্যার উপর সত্য নিক্ষেপ করি; ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং নিমিষেই তা বিলুপ্ত হয়। আর তোমাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ তোমরা যা বলছ তার জন্য।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ১৮

আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, পৃথিবী ও আকাশের অত্যাশ্চর্য বস্তুসমূহ আমি খেলার জন্য নয়, বরং বড় বড় রহস্যের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি করেছি। তন্মধ্যে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ফুটিয়ে তোলাও এক রহস্য। সৃষ্ট জগতের অবলোকন মানুষকে সত্যের দিকে এমনভাবে পথ প্রদর্শন করে যে, মিথ্যা তার সামনে টিকে থাকতে পারে না। এ বিষয়বস্তুটিই এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সত্যকে মিথ্যার উপর ছুড়ে মারা হয়, ফলে মিথ্যার মস্তিষ্ক চূৰ্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। (ইবনে কাসির)

এ আয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে তাদের যাবতীয় কু ধারণার মুলোৎপাটন করা হয়েছে। তারা আল্লাহকে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে বিমুক্ত করে রাখে। তারা তাঁকে মনে করে থাকে যে, তিনি এমনিতেই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া। এ সমস্ত মিথ্যা কথা ও রটনা দ্বারা আল্লাহকে খারাপ বিশেষণে বিশেষিত করা হয় বিধায় এ আয়াতে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।’ (কুরতুবি, ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির)

এ সুরায় আল্লাহ তাআলা তার বিশাল সৃষ্টির প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। যা বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সব মানুষের জন্য চিন্তার বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَوَ لَمۡ یَرَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ کَانَتَا رَتۡقًا فَفَتَقۡنٰهُمَا ؕ وَ جَعَلۡنَا مِنَ الۡمَآءِ کُلَّ شَیۡءٍ حَیٍّ ؕ اَفَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ

‘কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩০)

وَ جَعَلۡنَا فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِهِمۡ ۪ وَ جَعَلۡنَا فِیۡهَا فِجَاجًا سُبُلًا لَّعَلَّهُمۡ یَهۡتَدُوۡنَ

‘আমি পৃথিবীতে ভারী বোঝা (পাহাড়-পর্বত) রেখে দিয়েছি যাতে তাদেরকে নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে এবং তাতে প্রশস্ত পথ রেখেছি, যাতে তারা পথ প্রাপ্ত হয়।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩১)

আয়াতের অর্থ এই যে, পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তা’আলা পাহাড়সমূহের বোঝা রেখে দিয়েছেন, যাতে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় থাকে এবং পৃথিবী অস্থির নড়াচড়া না করে।’ (ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির) পৃথিবী নড়াচড়া করলে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারীদের অসুবিধা হত। পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে পাহাড়সমূহের প্রভাব অপরিসীম।

যদি পৃথিবীতে এত বড় বড় পর্বত না থাকত, তাহলে পৃথিবী সব সময় নড়াচড়া করত। যার কারণে পৃথিবী মানুষ ও জীব-জন্তুর বসবাসের উপযোগী হত না। আমি পর্বতের বোঝা দিয়ে পৃথিবীকে আন্দোলিত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছি। (আহসানুল বয়ান)

وَ جَعَلۡنَا السَّمَآءَ سَقۡفًا مَّحۡفُوۡظًا ۚۖ وَّ هُمۡ عَنۡ اٰیٰتِهَا مُعۡرِضُوۡنَ

‘আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি; অথচ তারা আমার আকাশস্থ নিদর্শনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩২)

‘সুরক্ষিত ছাদ’ অর্থাৎ, পৃথিবীর জন্য সুরক্ষিত ছাদ; যেমন তাঁবু বা গম্বুজের ছাদ হয়। অথবা এই অর্থে সুরক্ষিত যে, আল্লাহ তাকে পৃথিবীর উপর পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। নচেৎ আকাশ যদি পৃথিবীর উপর ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে পৃথিবীর সব শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ে পড়বে। অথবা তা শয়তানসমূহ থেকে সুরক্ষিত,

যেমন তিনি বলেছেন- وَحَفِظْنَاهَا مِن كُلِّ شَيْطَانٍ رَّجِيمٍ

অর্থাৎ “আমি আকাশকে প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে সুরক্ষিত করেছি”। (সুরা হিজর: আয়াত ১৭)

وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ وَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ

‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে’। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩৩)

রাতকে আরামের জন্য ও দিনকে জীবিকা অর্জনের জন্য সৃষ্টি করেছি। সূর্যকে দিনের ও চাঁদকে রাতের নিদর্শন বানিয়েছি। যাতে মাস ও বছর গণনা সম্ভব হয়; যা মানুষের জন্য একটি জরুরী বিষয়। এখানে সুর্য ও চন্দ্রের কক্ষপথ বোঝানো হয়েছে। সবাই এক একটি ফালাকে (কক্ষপথে) সাঁতরে বেড়াচ্ছে- এ থেকে দুটি কথা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।

এক. প্রত্যেকের ফালাক বা কক্ষপথ আলাদা এবং

দুই. ফালাক এমন কোনো জিনিস নয় যেখানে এ গ্রহ-নক্ষত্রগুলো খুঁটির মতো প্রোথিত আছে এবং তারা নিজেরাই এ খুঁটি নিয়ে ঘুরছে। বরং তারা কোনো প্রবাহমান অথবা আকাশ ও মহাশূন্য ধরনের কোনো বস্তু; যার মধ্যে এই গ্রহ-নক্ষত্রের চলা ও গতিশীলতা সাঁতার কাটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে।

মানুষ অমর নয়, প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সে ঘোষণাও রয়েছে এ সুরায়। যা মানুষের জন্য হুশিয়ারি সংকেত। আল্লাহ বলেন-

وَ مَا جَعَلۡنَا لِبَشَرٍ مِّنۡ قَبۡلِکَ الۡخُلۡدَ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مِّتَّ فَهُمُ الۡخٰلِدُوۡنَ

‘আপনার আগেও কোনো মানুষকে আমি অনন্ত জীবন দান করিনি। সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে?’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩৪)

মক্কার কাফেররা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বলতো যে, সে তো একদিন মারাই যাবে। এ আয়াত তারই উত্তর। আল্লাহ বললেন, মৃত্যু তো প্রত্যেক মানুষের জন্য অবধারিত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এই নিয়ম-বহির্ভূত নয়। কারণ সেও একজন মানুষ। আর আমি কোনো মানুষকে অমরতা দান করিনি। কিন্তু যারা এ কথা বলে তারা কি মরবে না? এ হতে মুশরিকদের মতবাদেরও খন্ডন হয়ে যায়; যারা দেবতা, আম্বিয়া ও আওলিয়াগণের চিরজীবী থাকার ধারণা পোষণ করে থাকে। আর সেই ভিত্তিতেই তারা তাঁদের নিজেদের সাহায্যকারী মনে করে। সুতরাং কোরআন-বিরোধী এই ভ্রষ্ট আকীদা হতে আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ نَبۡلُوۡکُمۡ بِالشَّرِّ وَ الۡخَیۡرِ فِتۡنَۃً ؕ وَ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ

‘প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৩৫)

আলেমদের সর্বসম্মত মতে আত্মার দেহপিঞ্জর ত্যাগ করাই মৃত্যু। (ফাতহুল কাদির) একটি গতিশীল, প্রাণবিশিষ্ট, সূক্ষ্ম ও নুরানি দেহকে আত্মা বলা হয়। এই আত্মা মানুষের সমগ্র দেহে সঞ্চারিত থাকে, যেমন গোলাপজল গোলাপ ফুলের মধ্যে বিরাজমান। (ইবনুল কাইয়্যিম, আর-রূহ: ১৭৮)

আমি ভালো ও মন্দ উভয়ের মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করি। প্রত্যেক স্বভাব বিরুদ্ধ বিষয় যেমন- অসুখ-বিসুখ, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদিকে মন্দ বলে অপরদিকে ভালো বলে প্রত্যেক পছন্দনীয় ও কাম্য বিষয় যেমন-সুস্থতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। দুঃখ-আনন্দ, দারিদ্র-ধনাঢ্যতা, জয়-পরাজয়, শক্তিমত্তা-দুর্বলতা, সুস্থতা-রুগ্নতা ইত্যাদি সকল অবস্থায় তোমাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। অনুরূপভাবে হালাল, হারাম, আনুগত্য, অবাধ্যতা, হেদায়াত ও পথভ্রষ্টতা এ সবই পরীক্ষার সামগ্ৰী।’ (ইবনে কাসির)

কখনো দুঃখ-দুর্দশা দিয়ে, কখনো পার্থিব সুখ-শান্তি দিয়ে, কখনো সুস্বাস্থ্য ও প্রশস্ততা দিয়ে, কখনো অসুস্থতা ও সংকীর্ণতা দিয়ে, কখনো ধনবত্তা ও বিলাস-সামগ্রী দিয়ে, কখনো দরিদ্রতা ও অভাব দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি। যাতে কে কৃতজ্ঞ ও কে অকৃতজ্ঞ, কে ধৈর্যশীল ও কে অধৈর্যশীল তা আমি পরীক্ষা করি। কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্য আল্লাহর সন্তুষ্টির এবং অকৃতজ্ঞতা ও ধৈর্যহীনতা আল্লাহর অসন্তুষ্টির বড় কারণ। (আহসানুল বয়ান)

আলেমগণ বলেন, বিপদাপদে সবর করার তুলনায় বিলাসব্যসন ও আরাম-আয়েশে হক আদায়ে দৃঢ়পদ থাকা অধিক কঠিন। তাই আব্দুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা যখন বিপদে পতিত হলাম, তখন তো সবর করলাম, কিন্তু যখন সুখ ও আরাম আয়েশে লিপ্ত হলাম, তখন সবর করতে পারলাম না। অর্থাৎ এর হক আদায়ে দৃঢ়পদ থাকতে পারলাম না। (ইবনুল কাইয়্যিম, উদাতুস সাবেরীন: ৬৪)

ওখানে তোমাদের কর্মানুসারে ভালো-মন্দ প্রতিদান দেওয়া হবে। যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য উত্তম এবং যারা অসৎকর্মশীল তাদের জন্য মন্দ বিনিময় দেওয়া হবে।’ (আহসানুল বয়ান)

শেষ বিচারের দিন বিচার ব্যবস্থা কেমন হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। কারো প্রতি কোনে ধরণের জুলুম করা হবে না সে ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন-

وَ نَضَعُ الۡمَوَازِیۡنَ الۡقِسۡطَ لِیَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ فَلَا تُظۡلَمُ نَفۡسٌ شَیۡئًا ؕ وَ اِنۡ کَانَ مِثۡقَالَ حَبَّۃٍ مِّنۡ خَرۡدَلٍ اَتَیۡنَا بِهَا ؕ وَ کَفٰی بِنَا حٰسِبِیۡنَ

‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৪৭)

কেয়ামতের দিন পাপ-পুণ্য ওজন করার জন্য কয়েকটি দাঁড়িপাল্লা হবে, নতুবা দাঁড়িপাল্লা তো একটিই হবে, তবে ওর বিশেষ মহত্তের জন্য বা বিভিন্ন ধরনের আমলের দিকে লক্ষ্য রেখে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষের আমল ও কর্মসমূহ অতীন্দ্রীয়, তা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ও অনুভূত নয়, তার বাহ্যিক কোন রূপ বা অস্তিতত্ত্ব নেই, তাহলে তার ওজন কিভাবে সম্ভব?

আধুনিক যুগে এই প্রশ্নের কোন গুরুত্ব নেই। যেহেতু বর্তমানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এ প্রশ্নের উত্তর সহজ করে দিয়েছে। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সাহায্যে নিরাকার তথা ওজনহীন বস্তুও ওজন করা যাচ্ছে। যখন মানুষের দ্বারা এটা সম্ভব তখন মহান আল্লাহর জন্য আকারহীন বা ওজনহীন অশরীরী জিনিসকে ওজন করা কেমন করে কঠিন হতে পারে?

তাঁর মহিমা হল, তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। এ ছাড়া এও হতে পারে যে, (ন্যায়-বিচার করতে) মানুষকে দেখানোর জন্য তিনি নিরাকার বস্তুকে সাকার বানাবেন এবং তা ওজন করবেন। যেমন হাদিসসমূহে কিছু কর্মের সাকার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কেয়ামতের দিন কোরআন এক ফ্যাকাসে বর্ণের শীর্ণ পুরুষের বেশে কোরআন তেলাওআতকারীর সামনে উপস্থিত হবে। সে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তুমি কে?’ সে বলবে, ‘আমি কোরআন যা তুমি রাত জাগরণ করে পাঠ করতে ও দিনে পিপাসার্ত অবস্থায় পাঠ করতে।’ (মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৪৮, ৩৫২, ইবনে মাজাহ)

অনুরূপভাবে মুমিনের কবরে তার সৎকর্ম এক সুন্দর সুরভিত যুবকের রূপ ধরে আসবে এবং কাফের ও মুনাফিকদের কাছে এর বিপরীত রূপ নিয়ে। (মুসনাদে আহমাদ ৫/২৮৭)

অধিকাংশ আলেমের মতে, দাঁড়িপাল্লা একটিই হবে। যার থাকবে দু’টি পাল্লা। যে দু’টি পাল্লা সবাই দেখতে পাবে, অনুভব করতে পারবে। তবে বহুবচনে ব্যক্ত করার কারণ হয়ত এটাই যে, মিজানের পাল্লাতে যেমনিভাবে বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে তেমনিভাবে বান্দার আমলকেও সরাসরি ওজন করা হবে এমনকি বান্দাকেও ওজন করা হবে। সে হিসেবে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। (শারহুত তাহাভিয়্যাহ)

বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে তার প্রমাণ- হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উম্মতের মধ্যে একলোককে কেয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে পৃথক করে একান্তে ডেকে তার জন্য ৯৯ টি দপ্তর বের করবেন যার প্রত্যেকটি চোখ যতদুর যায় তত লম্বা হবে। তারপর তাকে বলবেন, ‘তুমি কি এগুলো অস্বীকার কর? আমার রক্ষণাবেক্ষণকারী লেখক ফেরেশতাগণ কি তোমার উপর অত্যাচার করেছে? সে বলবে- না, হে প্ৰভু! তারপর আল্লাহ বলবেন. তোমার কি কোনো ওজর বা সৎকর্ম আছে? লোকটি তখন হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলবে- না, হে প্ৰভু! তখন আল্লাহ বলবেন, অবশ্যই তোমার একটি সৎকর্ম আছে, তোমার উপর আজ কোনো জুলুম করা হবে না।’

তারপর তার জন্য একটি কার্ড বের করা হবে যাতে আছে- اَشْهَدُ اَنْ لاَّ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো হক ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসুল।’ তারপর আল্লাহ বলবেন, সেটা নিয়ে আস। তখন লোকটি বলবে- হে প্ৰভু! ঐ সমস্ত দপ্তরের বিপরীতে এ কার্ড কি ভূমিকা রাখতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার উপর জুলুম করা হবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারপর সে সমস্ত দপ্তর এক পাল্লায় এবং কার্ডটি আরেক পাল্লায় রাখা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আর তাতেই সমস্ত দপ্তর উপরে উঠে যাবে এবং কার্ডটি ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর নামের বিপরীতে কোন কিছু ভারী হতে পারে না।’ (তিরমিজি ২৬৩৯, ইবনে মাজাহ ৪৩০০) এ হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে।

বান্দার আমলই সরাসরি ওজন করার প্রমাণ হাদিসে পাকে এভাবে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুটি বাক্য এমন যা দয়াময়ের কাছে প্রিয়, জিহ্বার উপর হাল্কা, মিজানের মধ্যে ভারী, আর তা হলো- ‘সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ (আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি তাঁর প্রশংসা সহকারে), ‘সুবহানাল্লাহিল আজিম’ (মহান আল্লাহ কতই না পবিত্র)।’ (বুখারি ৭৫৬৩, মুসলিম ২৬৯৪)

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম

এ সুরায় হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার কাওমের সঙ্গে বিষদ আলোচনা করেছেন। যাতে ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি ওঠে এসেছে। কিন্তু তারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অবিশ্বাসী নমরূদ ও তার সম্প্রদায়। তাকে আগুণে নিক্ষেপ করে। সে সময়ে বর্ণনা এভাবে এসেছে-

قَالَ اَفَتَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنۡفَعُکُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا یَضُرُّکُمۡ  اُفٍّ لَّکُمۡ وَ لِمَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ

‘তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের কোনো উপকার ও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদের জন্যে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরই এবাদত কর, ওদের জন্যে। তোমরা কি বোঝ না? ‘ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৬৬-৬৭)

যখন তারা তাদের অক্ষমতার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হল, তখন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাদের অজ্ঞতার উপর আফসোস করে বললেন, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে এমন অক্ষমদের ইবাদত কর?

قَالُوۡا حَرِّقُوۡهُ وَ انۡصُرُوۡۤا اٰلِهَتَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ فٰعِلِیۡنَ  قُلۡنَا یٰنَارُ کُوۡنِیۡ بَرۡدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبۡرٰهِیۡمَ

‘তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে আগুন, তুমি ইবরাহিমরে ওপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৬৮-৬৯)

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন নিজের প্রমাণাদি পূর্ণরূপে পেশ করলেন এবং ওদের ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা এমনভাবে প্রকাশ করলেন যে, তারা কোনো উত্তর দিতে পারল না। কিন্তু যেহেতু তারা ছিল হেদায়েতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত তথা কুফরি ও শিরক তাদের অন্তরকে অন্ধকার করে রেখেছিল, সেহেতু তারা তখন শিরক হতে তওবা করার পরিবর্তে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হল এবং নিজেদের দেব-দেবীর দোহাই দিয়ে তাঁকে আগুনে ফেলার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। যথারীতি আগুনের বিরাট একটি কুন্ড তৈরি করা হল। আর ওর মধ্যে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে প্রস্তর নিক্ষেপক যন্ত্র দ্বারা নিক্ষেপ করল। কিন্তু আল্লাহ আগুনকে আদেশ করলেন যে, ‘তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’

উলামাগণ বলেন যে, ‘শীতল’ বলার সাথে ‘নিরাপদ’ শব্দ যদি আল্লাহ না বলতেন, তাহলে ওর শীতলতা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জন্য অসহনীয় হত। মোট কথা এটি একটি মস্ত বড় মুজেজা; যা আল্লাহর হুকুমে আকাশ ছোঁয়া অগ্নির লেলিহান শিখা ফুলের বাগানে রূপান্তরিত হয়ে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জন্য প্রকাশ পেল। আর এইভাবে আল্লাহ নিজের খাস বান্দাকে শত্রুদের কবল হতে রক্ষা করলেন।

হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম

হজরত আইয়ুব আলাইহসি সালামের কষ্টের সময়ের বর্ণনাও এসেছে এ সুরায়। যেখানে পয়গাম্বর আইয়ুব আলাইহিস সালাম আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ তাকে ক্ষমা দান করেন। আল্লাহ বলেন-

وَ اَیُّوۡبَ اِذۡ نَادٰی رَبَّهٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الضُّرُّ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ  فَاسۡتَجَبۡنَا لَهٗ فَکَشَفۡنَا مَا بِهٖ مِنۡ ضُرٍّ وَّ اٰتَیۡنٰهُ اَهۡلَهٗ وَ مِثۡلَهُمۡ مَّعَهُمۡ رَحۡمَۃً مِّنۡ عِنۡدِنَا وَ ذِکۡرٰی لِلۡعٰبِدِیۡنَ

‘এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন- ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশতঃ আর এটা ইবাদতকারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৩-৮৪)

কোরআন থেকে শুধু এতটুকু জানা যায় যে, তিনি কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে সবর করে যান এবং অবশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে রোগ থেকে মুক্তি পান। এই অসুস্থতার দিনগুলোতে তার সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব সবাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরপর আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থতা দান করেন। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর নবি আইয়ুব আলাইহিস সালাম ১৮ বছর মুসিবত ভোগ করেছিলেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে তার ভাই বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে দু’জন ছাড়া সবাই ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। এ দু’জন সকাল বিকাল তার কাছে আসত। তাদের একজন অপরজনকে বলল, জেনে নাও আল্লাহর শপথ! অবশ্যই আইয়ুব এমন কোনো গুনাহ করেছে যার মত গুনাহ সৃষ্টিজগতের কেউ করেনি। তার সাথী বলল, এটা কেন বললে? জবাবে সে বলল- আঠারো বছর থেকে সে এমন কঠিন রোগে ভুগছে অথচ আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে তা থেকে মুক্তি দিচ্ছে না। এ কথা শোনার পর সাথীটি আইয়ুব আলাইহিস সালামের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ব্যথিত হয়ে কথাটি তাকে জানিয়ে দিল। তখন আইয়ুব আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, আমি জানি না তুমি কি বলছ, তবে আল্লাহ জানেন আগে আমি কখনও কখনও ঝগড়ায় লিপ্ত দু’জনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটাও শুনতাম যে, তারা আল্লাহর কথা বলে বলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। তখন আমি বাড়ী ফিরে তাদের পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করতাম এই ভয়ে যে, তারা হক ছাড়া অন্য কোনোভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেনি তো?

ঘটনা বর্ণনা করতে করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আইয়ুব আলাইহিস সালাম তার প্রাকৃতিক কাজ সারতে বের হতেন। কাজ সারার পর তার স্ত্রী তার হাত ধরে নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি তাঁর প্রাকৃতিক কাজ সারার পর তার স্ত্রীর কাছে ফিরতে দেরী করছিলেন এমন সময় আল্লাহ তাআলা আইয়ুব আলাইহিস সালামের কাছে অহি পাঠালেন যে, ‘আপনি আপনার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত করুন, এই তো গোসলের সুশীতল পানি ও পানীয়।’ (সুরা সোয়াদ: আয়াত ৪২)

তার স্ত্রী তার আগমনে দেরী দেখে নিজেই এগিয়ে গিয়ে তার কাছে পৌছলেন। তখন আইয়ুব আলাইহিস সালামের যাবতীয় মুসিবত দূর হয়ে তিনি পূর্বের ন্যায় সুন্দর হয়ে গেলেন। তার স্ত্রী তাকে দেখে বললেন, হে মানুষ! আল্লাহ আপনার উপর বরকত দিন, আপনি কি ঐ বিপদগ্ৰস্ত আল্লাহর নবীকে দেখেছেন? আল্লাহর শপথ, যখন সে সুস্থ ছিল তখন সে ছিল আপনার মতই দেখতে। তখন আইয়ুব আলাইহিস সালাম বললেন যে, আমিই সেই ব্যক্তি। আইয়ুব আলাইহিস সালামের দুটি উঠান ছিল। একটি গম শুকানোর অপরটি যব শুকানোর। আল্লাহ তাআলা সে দু’টির উপর দুখণ্ড মেঘ পাঠালেন। এক খণ্ড মেঘ সে গমের উঠোনে এমনভাবে স্বর্ণ ফেললো যে, সেটি পূর্ণ হয়ে গেল। অপর মেঘ খণ্ডটি সেটির উপর এমনভাবে রৌপ্য বর্ষণ করল যে, সেটাও পূর্ণ হয়ে গেল।’ (ইবন হিব্বান ৭/১৫৭, ২৮৯৮; মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৬৩৫, ৪১১৫)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ একবার আইয়ুব আলাইহিস সালাম কাপড় খুলে গোসল করছিলেন, এমতাবস্থায় এক ঝাক স্বর্ণের টিড্ডি (পঙ্গপাল) তার উপর পড়তে আরম্ভ করল, তিনি সেগুলো মুঠি মুঠি তার কাপড়ে জমা করছিলেন। তখন তার প্রভু তাকে ডেকে বললেন, হে আইয়ুব! আমি কি আপনাকে যা দেখছেন তা থেকেও বেশি প্রদান করে ধনী করে দেইনি? উত্তরে আইয়ুব আলাইহিস সালাম বললেন, অবশ্যই হে প্ৰভু! তবে আপনার দেওয়া বরকত থেকে আমি কখনো অমুখাপেক্ষী হবো না।’ (বুখারি ৩৩৯১, ২৭৯)

কোরআনের অন্যত্র এসেছে, আল্লাহ তাকে বলেন, ‘নিজের পা দিয়ে আঘাত করুন, এ ঠাণ্ডা পানি মজুদ আছে গোসল ও পান করার জন্য।’ (সুরা ছোয়াদ: আয়াত ৪২) এ থেকে জানা যায়, মাটিতে পা ঠুকবার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তার জন্য একটি প্রাকৃতিক ঝরণা-ধারা প্রবাহিত করেন। এ ঝরণার পানির বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এ পানি পান ও এতে গোসল করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রোগমুক্ত হয়ে যান। এ রোগ নিরাময় এদিকে ইংগিত করে যে, তার কোনো মারাত্মক চর্মরোগ হয়েছিল।

তিনজন নবির কথা

وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِدۡرِیۡسَ وَ ذَاالۡکِفۡلِ ؕ کُلٌّ مِّنَ الصّٰبِرِیۡنَ وَ اَدۡخَلۡنٰهُمۡ فِیۡ رَحۡمَتِنَا ؕ اِنَّهُمۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ

আর স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল্ কিফল এর কথা, তাদের প্রত্যেকেই ধৈর্যশীল ছিল। আর তাদেরকে আমি আমার রহমতে শামিল করেছিলাম। তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ।’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৮৫-৮৬)

আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে তিন জন মনীষীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ইসমাঈল ও ইদরিস যে নবি ও রাসুল ছিলেন, তা কোরআনের অনেক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত আছে। কোরআনে তাদের কথা স্থানে স্থানে আলোচনাও করা হয়েছে। তৃতীয় জন হচ্ছেন- যুলকিফল। আল্লামা ইবনে কাসির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তার নাম দু’জন নবির সঙ্গে শামিল করে উল্লেখ করা থেকে বাহ্যতঃ বোঝা যায় যে, তিনিও আল্লাহর নবি ছিলেন। কিন্তু কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি নবিদের কাতারভুক্ত ছিলেন না; বরং একজন সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তি ছিলেন। তবে সঠিক মত হলো এই যে, তিনি নবি ও রাসুলই ছিলেন। তার সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য জানা যায় না।

হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম-

বিপদে মাছের পেটে অন্ধকারে হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন, সে ঘটনাও ওঠে এসেছে এ সুরায়। আল্লাহ বলেন-

وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡهِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ

‘আর মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন, তিনি রাগ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধরতে পারব না। অতপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেন যে-

لَّا إِلَهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বালিমিন।

অর্থাৎ তুমি ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গোনাহগার।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৮৭)

ইউনুস ইবনে মাত্তা আলাইহিস সালাম এর কাহিনী পবিত্র কুরআনের সূরা ইউনুস, সূরা আল-আম্বিয়া, সূরা আস-সাফফাত ও সূরা আল-কালামে বিবৃত হয়েছে। কোথাও তার আসল নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কোথাও যুন-নুন এবং কোথাও ছাহেবুল হূত উল্লেখ করা হয়েছে। নুন ও হূত উভয় শব্দের অর্থ মাছ। কাজেই যুন-নুন ও সাহেবুল হুতের অর্থ মাছওয়ালা। ইউনুস আলাইহিস সালামকে কিছুদিন মাছের পেটে অবস্থান করতে হয়েছিল। এই আশ্চর্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে যুন-নুন বা ছাহেবুল হূত শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে।

فَاسۡتَجَبۡنَا لَهٗ ۙ وَ نَجَّیۡنٰهُ مِنَ الۡغَمِّ ؕ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ

‘অতপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৮)

হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম-

উঠে এসেছে হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের আহ্বান ও দোয়ার কথা। যা আল্লাহ কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

وَ زَکَرِیَّاۤ اِذۡ نَادٰی رَبَّهٗ

‘আর স্মরণ করুন জাকারিয়ার কথা, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহবান করেছিল-

رَبِّ لَا تَذَرْنِي فَرْدًا وَأَنتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ

উচ্চারণ : ‘রাব্বি লা তাজারনি ফারদাও ওয়া আংতা খাইরুল ওয়ারিছিন।’

অর্থ : হে আমার পালনকর্তা আমাকে একা রেখো না। তুমি তো উত্তম ওয়ারিস।

فَاسۡتَجَبۡنَا لَهٗ ۫ وَ وَهَبۡنَا لَهٗ یَحۡیٰی وَ اَصۡلَحۡنَا لَهٗ زَوۡجَهٗ ؕاِنَّهُمۡ کَانُوۡا یُسٰرِعُوۡنَ فِی الۡخَیۡرٰتِ وَ یَدۡعُوۡنَنَا رَغَبًا وَّ رَهَبًا ؕوَ کَانُوۡا لَنَا خٰشِعِیۡنَ

‘অতপর আমি তার দোয়া কবুল করেছিলাম, তাকে দান করেছিলাম ইয়াহইয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে প্রসবযোগ্য করেছিলাম। তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৯-৯০)

স্ত্রীকে যোগ্য করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে, তার বন্ধ্যাত্ব দূর করে দেওয়া এবং বার্ধক্য সত্বেও তাকে গর্ভধারণের উপযোগী করা। ‘সবচেয়ে ভালো উত্তরাধিকারী আপনিই’ মানে হচ্ছে, সন্তান না দিলে কোনো দুঃখ নেই। আপনার পবিত্র সত্তা-উত্তরাধিকারী হবার জন্য যথেষ্ট। কারণ আমার জানা আছে যে, আপনারা দ্বীনের জন্য আপনি কাউকে না কাউকে মনোনীত করবেন। যিনি আপনার দ্বীনকে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারবে। (ফাতহুল কাদির)

হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের একজন উত্তরাধিকারী পুত্ৰ লাভের একান্ত বাসনা ছিল। তিনি তারই দোয়া করেছেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে, পুত্ৰ পাই বা না পাই; সর্বাবস্থায় আপনিই উত্তম ওয়ারিশ। এটা নবিসূলভ শিষ্টাচার প্রদর্শন বৈ অন্য কিছু নয়। আয়াতের অন্য অর্থ হচ্ছে, ওয়ারিশ বানানোর মালিক তো আপনিই। আপনিই তো দিতে পারেন। আপনার দ্বীন কখনও ধ্বংস হবে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আমার বংশ এ ফজিলত থেকে বঞ্চিত না হোক।’ (কুরতুবি)

হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-

আল্লাহ তাআলা বিশ্ববাসীর জন্য প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন মর্মে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭)

মানবজাতি, জিন, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, জড় পদার্থসমূহ সবই আলামিনের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার জন্যেই রহমতস্বরূপ ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন মানব জাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ। হাদিসে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘“আমি তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত।’ (তাবারানি, মুজামুল আওসাত ৩০০৫, আস-সাগির ১/১৬৮, ২৬৪, মুস্তাদরাক হাকেম ১/৯১, ১০০, মুসনাদে শিহাব ১১৬০, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৫/৬৯, ৩০৫)

তাছাড়া যদি আখেরাতই সঠিক জীবন হয় তাহলে আখেরাতের আহবানকে প্রতিষ্ঠিত করতে কুফর ও শির্ককে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে কাফেরদেরকে হীনবল করা এবং তাদের মোকাবেলায় জেহাদ করাও সাক্ষাত রহমত। এর ফলে আশা করা যায় যে, অবাধ্যদের জ্ঞান ফিরে আসবে এবং তারা ঈমান ও সৎকর্মের অনুসারী হয়ে যাবে। যারা রাসুলের উপর ঈমান আনবে ও তার কথায় বিশ্বাস করবে তারা অবশ্যই সৌভাগ্যবান হবে, আর যারা ঈমান আনবে না তারা দুনিয়াতে পূর্ববর্তী উন্মতদের মত ভূমিধ্বস বা ডুবে মরা থেকে অন্তত নিরাপদ থাকবে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাবস্থায় রহমত। (কুরতুবি)

অথবা আয়াতের অর্থ, আমরা আপনাকে সবার জন্যই রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। কিন্তু এটা তাদের জন্যই যারা ঈমান আনবে এবং আপনাকে মেনে নেবে। কিন্তু যারা আপনার কথা মানবে না, তারা দুনিয়া ও আখেরাত সর্বত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন-

‘আপনি কি তাদেরকে লক্ষ্য করেন না। যারা আল্লাহর অনুগ্রহকে কুফারি দ্বারা পরিবর্তন করে নিয়েছে এবং তারা তাদের সম্প্রদায়কে নামিয়ে আনে ধ্বংসের ঘরে- জাহান্নামে, যার মধ্যে তারা দগ্ধ হবে, আর কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল!’ (সুরা ইবরাহিম: আয়াত ২৮-২৯)

অন্য আয়াতে কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বলুন, এটি মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও আরোগ্য।’ আর যারা ঈমান আনে না তাদের কানে রয়েছে বধিরতা এবং কোরআন এদের (অন্তরের) উপর অন্ধত্ব তৈরি করবে। তাদেরকেই ডাকা হবে দূরবর্তী স্থান থেকে।’ (সুরা ফুসসিলাত: আয়াত ৪৪)

তাছাড়া হাদিসে পাকে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাকে অভিশাপকারী করে পাঠানো হয় নি, আমাকে রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে।’ (মুসলিম ২৫৯৯)

যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালতের উপর ঈমান আনবে সে আসলে উক্ত করুণা ও রহমতকে গ্রহণ করবে। পরিণামে দুনিয়া ও আখিরাতে সে সুখ ও শান্তি লাভ করবে। আর যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত বিশ্বজগতের জন্য, সেহেতু তিনি বিশ্বজগতের রহমত রূপে; অর্থাৎ নিজের শিক্ষা দ্বারা বিশ্ববাসীকে ইহ-পরকালের সুখের সন্ধান দিতে প্রেরিত হয়েছিলেন।

কিছু উলামায়ে কেরাম তাঁকে এই অর্থেও বিশ্বজগতের জন্য করুণা বলেছেন যে, তাঁর কারণেই এই উম্মত (তাঁর দাওয়াত গ্রহণ অথবা বর্জনকারী মুসলিম অথবা কাফের সকলেই) নির্মূলকারী ব্যাপক ধ্বংসের হাত হতে রেহাই পেয়েছে। যেভাবে পূর্ববর্তী বহু জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, উম্মাতে মুহাম্মাদিয়াকে ঐ রকম আজাব দিয়ে ধ্বংস করে নির্মূল করা হয়নি।

বহু হাদিস দ্বারা জানা যায় যে, মুশরিকদের উপর বদদোয়া ও অভিশাপ না করাও ছিল তাঁর করুণারই একটি বিশেষ অংশ। তাঁকে তাদের উপর বদদোয়া করতে আবেদন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হইনি; আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম ২০০৬)

অনুরূপ রাগান্বিত অবস্থায় কোন মুসলিমকে তাঁর অভিশাপ বা গালিমন্দ করাকে কেয়ামতের দিন তার জন্য রহমতের কারণ হওয়ার দোয়া করাও তাঁর দয়ারই একটি অংশ। (আহমাদ ২/৪৩৭, আবু দাউদ ৪৬৫৯)

এই কারণেই একটি হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘আমি রহমতের মূর্তপ্রতীক হয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বজগতের জন্য একটি উপহার।’ (জামে ২৩৪৫)

আর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। সব ফয়সালা ন্যায়ানুগ হওয়ার জন্যও তিনি আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করতেন। আল্লাহ তাআলা সুরা আম্বিয়ার শেষ আয়াতে তা তুলে ধরে বলেন-

‘পয়গাম্বর বললেন,

رَبِّ احْكُم بِالْحَقِّ وَرَبُّنَا الرَّحْمَنُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ

‘হে আমার পালনকর্তা, আপনি ন্যায়ানুগ ফয়সালা করে দিন। আমাদের পালনকর্তা তো দয়াময়, তোমরা যা বলছ, সে বিষয়ে আমরা তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১১২)

সুরা হজ : (৭৮)

সুরা হজ মাক্কী না মাদানি এ বিষয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে; তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক বলেন, এ সুরাটি মিশ্র। এতে মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ উভয় প্রকারের আয়াতই সন্নিবেশিত হয়েছে। এর কিছু আয়াত রাতে, কিছু আয়াত দিনে, কিছু আয়াত সফরে, কিছু আয়াত গৃহে অবস্থানকালে, কিছু আয়াত মক্কা, কিছু আয়াত মদিনায়, কিছু আয়াত যুদ্ধাবস্থায় এবং কিছু আয়াত শান্তি বিরাজমান অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এ সুরায় নাসেখ ও মানুসুখের আয়াতও নাজিল হয়েছে এ সুরায়। এ সুরা বিষয়বস্তুগুলো হলো—

কিয়ামাতের ভূকম্পন সম্পর্কিত তথ্য; আল্লাহকে ভয় করার কথা দিয়ে শুরু হয়েছে সুরাটি। আল্লাহ বলেন-

‘হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার।’ (সুরা হাজ :আয়াত ১)

মায়ের গর্ভে মানব সৃষ্টির স্তর ও বিভিন্ন অবস্থার আলোচনা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানব সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে বলেন-

– ‘হে লোকসকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও, তবে (ভেবে দেখ-) আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে পতিত দেখতে পাও, অতঃপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৫)

বাইতুল্লায় সকল মুসলমানের সমান অধিকারের তাৎপর্য; বাইতুল্লাহ নির্মাণ সম্পর্কিত আলোচনা; গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হজের কর্যক্রমে সুন্দরভাবে সম্পাদনের বিষয়াবলীর আলোচনা; আল্লাহ বলেন—

‘যখন আমি ইব্রাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্যে এবং রকু সেজদাকারীদের জন্যে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৬)

– ‘ আর এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৭)

– ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাব গ্রস্থকে আহার করাও।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৮)

– ‘এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৯)

কুরবানি করার বিষয়েও দিক-নির্দেশনা উঠে এসেছে এ সুরায়। কুরবানির বিধান ও তার গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছ পৌঁছায় না তা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা তা ঘোষণা করে বলেন-

– ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)

– ‘যাদের অন্তর আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে ভীত হয় এবং যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্য্যধারণ করে এবং যারা নামায কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৫)

– ‘আর কা’বার জন্যে উৎসর্গীকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের যবেহ করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যে কিছু যাচ্ঞা করে না তাকে এবং যে যাচ্ঞা করে তাকে। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৬)

– ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)

এ সুরায় ইসলামি রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ। ক্ষমতা লাভের পর এ চারচি বিধান বাস্তবায়নই মুমিনের কাজ। আল্লাহ বলেন-

– ‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে-

> তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে;

> জাকাত ব্যবস্থা বিন্যস্ত করবে;

> আর সৎকাজে আদেশ (বাস্তবায়ন করবে) দেবে আর

> অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারভূক্ত।’ (সুরা হজ : আয়াত ৪১)

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মুসলিম উম্মাহর জন্য সতর্ককারী। তিনি সব বিষয়ে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক ও নসিহত পেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

– (হে রাসুল! আপনি) বলুন, হে লোক সকল! আমি তো তোমাদের জন্যে স্পষ্ট ভাষায় সতর্ককারী। সুতরাং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যে আছে পাপ মার্জনা এবং সম্মানজনক রুজি।’ (সুরা হজ : আয়াত ৪৯-৫০)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সফলকাম হওয়ার আমলের ঘোষণা দিয়েছেন। যে আমলে বান্দা হবে সফলকাম। আর তাহলো নামাজে যথাযথ রুকু ও সেজদা আদায় করা। ভালো কাজ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

– ‘হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু কর, সেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা হজ : আয়াত ৭৭)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরা দুটি বুঝে পড়ার এবং এর দিকনির্দেশনা মেনে যথাযথ আমল করার মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের সফলতা লাভ করার তাওফিক দান করুন। নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএইচডি/

আরো পড়ুন:

তারাবিহর আলোচনা: হজরত নুহের (আ.) মহাপ্লাবনের ঘটনার বর্ণনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *