খাদ্য-পুষ্টিলাইফস্টাইল

সুস্থ থাকতে প্রতিদিনের খাবার করে তুলুন নিরাপদ ও পুষ্টিকর

লাইফস্টাইল প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: খাদ্য আমাদের প্রধান জৈবিক চাহিদা। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব’র প্রথম ধাপেই রয়েছে খাদ্য। খাদ্য আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এটা যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি সঠিক খাদ্য বা সঠিক উপায়ে খাদ্য গ্রহণ না করলে তা আমাদের সুস্বাস্থ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, শরীরে নানা রোগ সৃষ্টি করে। আবার বেঁচে থাকা মানে কিন্তু শুধুই শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার সক্ষমতা নয় বরং সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকাই প্রকৃত বাঁচা। তাই খাদ্য যাতে আমাদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে সেদিকে নজর দেয়া উচিৎ।

সঠিক খাদ্য এবং এর পুষ্টিগুণ আমাদের সুস্থ রাখে। কিন্তু আমরা অনেকেই খাদ্যের পুষ্টিগুণের বিষয়ে সচেতন নই। কী খাচ্ছি, কখন খাচ্ছি কোনো কিছুই ঠিক থাকে না, যা স্বাস্থের জন্য মোটেও ভালো কথা না। খাবার যাতে নিরাপদ হয় এবং এতে পুষ্টিগুণ থাকে সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।

পুষ্টিবিদ মিতা শুক্লা জানান- “খাবারে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট, ভিটামিন সি আর প্রোটিনের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে, তবেই বাড়বে আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা।”

পুষ্টিকর খাবার বা নিরাপদ খাবার মানেই কিন্তু দামী খাবার না। তাই এর সাথে বাড়তি খরচের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু টিপস মেনে চললেই খাবার নিরাপদ ও পুষ্টিকর করে তোলা যায়। যেমন-

পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ: আমাদের দেহের অস্থি, পেশী, বিভিন্ন দেহযন্ত্র, রক্ত কণিকা থেকে শুরু করে দাঁত, চুল, নখ সব প্রোটিন দিয়ে গঠিত। প্রোটিন দৈহিক বৃদ্ধি সাধন ও দেহ গঠন করে। আমাদের দেহে নতুন কোষ গঠন করে ক্ষয়পূরণ করে ও ক্ষত সারিয়ে তোলে প্রোটিন। যখন দেহে চর্বি ও শর্করার অভাব দেখা যায় তখন প্রোটিন তাপশক্তি উৎপাদনের কাজ করে। রোগ সৃষ্টিকারী রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের দেহে তাদের প্রতিরোধী পদার্থ বা অ্যান্টিবডি তৈরী করা আমিষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মানসিক বিকাশ বা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য আমিষ অপরিহার্য। তাই খাদ্যে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। তবে বিষাক্ত খাবার খাওয়া, কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষতি বা ফ্রিজিং করা প্রোটিনজাত খাবারগুলো শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই নিরাপদ উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন– মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল। এক্ষেত্রে মাছ, মাংস যেন টাটকা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেশি দিন ফ্রিজিং করা মাছ, মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিকর।

মাছ এবং মাংস যদি অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা উৎসগুলো থেকে নেয়া যায় তবে বেশি ভালো হয়। টাটকা মাছ মাংস না পাওয়া গেলে সেগুলোর বদলে ডাল বা ডিমই ভালো প্রোটিন সরবরাহ করবে। ডাল রান্নার পূর্বে ভালো করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। দুধ, দই, ছানাও বেশ ভালো প্রোটিন উৎস। দই খাদ্য পরিপাকেও ভালো কাজ করে।

বেশি করে শাক-সবজি খাওয়া: বেশি করে শাক-সবজি খেতে হবে। রান্নার পূর্বে শাক-সবজিগুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে পানিতে ভিনেগার বা নিম থেকে তৈরি ভেজিটেবল পিউরিফায়ার মিশিয়ে শাক-সবজি ৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে পারেন। রান্নার সময় এগুলো ভালো করে সিদ্ধ করে নিতে হবে। কারণ আজকাল রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে এগুলো উৎপাদন করা হয় তাই ভালো করে ফুটালে এগুলোর বিষক্রিয়া কমে যায়।

সব সময় মাছ, মাংস ভুনা রান্না করার পরিবর্তে এতে সবজি মিশিয়ে ঝোল বা স্ট্যু আকারে রান্না করে খেতে পারেন। যারা নিরামিষ খান তারা ডালে সবজি মিশিয়ে রান্না করুন। চেষ্টা করবেন ডাল পতলা করে রান্না করার। শরীরের জন্য শুকনা খাবারের চেয়ে কম মসলাদার ঝোল জাতীয় খাবারগুলো ভালো। এতে শরীরের পুষ্টি উপাদানের সাথে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও পূরণ হয় এবং এগুলো সহজ পাচ্য।

বেশি করে খেতে হবে ভিটামিস সি: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি এর গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি এটি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের বিরুদ্ধেও লড়াই করে। এর সাথে হাড় ও দাঁতের জন্যও ভিটামিন সি অনেক উপকারী। এটি ত্বকের টিস্যুর গঠনেও সরাসরি অংশ নেয়। যে কোনো ক্ষত খুব তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলতেও এই ভিটামিনের বিকল্প নেই। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিক্যাল থেকেও রক্ষা করে এটি। ভিটামিন-সি দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে। তাই প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেতে হবে।

টক ফল এবং কাঁচামরিচে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। অনেকে সকালে বা রাতে ভিটামিন সি হজম করতে পারেন না, তারা দুপুরে খাবারের কিছুক্ষণ পর টক জাতীয় ফল খেতে পারেন।

সঠিক পরিমাণে পানি পান: পানি পানের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। শরীরের প্রয়োজন অনুপাতে পানি পান করতে হবে, কম পানি পান বা অতিরিক্ত পানি পান দু’ই শরীরের জন্য খারাপ। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক গ্লাস স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি পান করার অভ্যাস করুন। খাবারের পর সাথে সাথে পানি পান করা যাবে না। অন্তত ১৫-২০ মিনিট পর পানি পান করতে হবে। প্রয়োজনে খাবারের পূর্বে এক ঢোক পানি পান করে নিতে পারেন।

নিয়ম করে খাবার খাওয়া: খাবার খেতে হবে নিয়ম করে সঠিক সময়ে। চেষ্টা করতে হবে প্রতিদিন একই সময়ে খাবার খাওয়ার। কোনো বেলাতেই খাবার বেশি দেরী করে খাওয়া ঠিক না। একবারে বেশি খাবার না খেয়ে বারেবারে খাবার খাওয়া উচিৎ। খালি পেটে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। নির্ধারিত খাবার সময়ের বাইরে অন্য সময় পেটে ক্ষুধা অনুভূত হলেই হালকা কিছু খেতে হবে। এসময় কম ক্যালরির, সুগার ফ্রি বিস্কুট বা ফল খতে পারেন।  

নাস্তায় রাখুন স্বাস্থ্যকর খাবার: নাস্তায় মসলাদার, বেশি তেলযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো। সকালের নাস্তায় খেতে পারেন ছোলা-বাদাম। অল্প পরিমাণে ভেজানো কাঁচা ছোলা, বাদাম, কয়েক টুকরো কিসমিস, একটু আদা কুচি, কাঁচা হলুদ কুচি সাথে অল্প পরিমাণে আখের গুড় মিশিয়ে খেতে পারেন। সকালেরনাস্তায় খেতে পারেন ডিম সেদ্ধ, পাকাকলা, ওটস, যবের ছাতু, মিষ্টি ফল বা ফলের জুস।

বিকেলে ভাজাপোড়ার বদলে খেতে পারেন ছোলা সেদ্ধ-মুড়ি, নারকেল-মুড়ি, ডাবের জল, ছতুর শরবত, শসা, পেয়ারা, আপেল জাতীয় ফল।

প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবার কে না বলুন: যে কোনো প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবার খাওয়া থেকে দূরে থাকুন। এগুলোতে যেমন পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে না তেমনি এগুলো ক্যান্সারের মতো রোগের কারণ। সব সময় চেষ্টা করবেন কম চিনি, লবণযুক্ত খাবার খেতে। সফট ড্রিংকস খাওয়ার অভ্যাসও ছাড়তে হবে।

খাবারে হলুদের ব্যবহার: হলুদ যেমন মসলা হিসেবে পরিচিত তেমনি এটা ভালো মানের এ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। রান্নায় হলুদের ব্যবহার খাবারের পুষ্টিগুণ বাড়ায়। বিশেষ করে মাছ-মাংস রান্নায় হলুদ ব্যবহার জরুরী। মাছ রান্নার পূর্বে হলুদে মাখিয়ে রাখলে মাছে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। দুধে হলুদ মিশিয়ে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

মাঝে মাঝে দুগ্ধজাত মিষ্টি খাওয়া: মাঝে মাঝে দুগ্ধজাত মিষ্টি খাবেন যদি ডায়বেটিস বা অন্য কোনো সমস্যা না থাকে। এগুলো আমাদের শরীরের হাড় গঠন ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে। তবে এগুলো বেশি পরিমাণে বা নিয়মিত না খাওয়াই ভালো।

লাল চাল ও লাল আটা: সাদা চাল বা রিফাইন্ড আটা, ময়দা থেকে লালা চাল ও লাল আটায় পুষ্টি বেশি থাকে এবং এতে ফাইবার থাকায় হজম ভালো হয়।

খাবার ফ্রিজিং এ সচেতন হোন: খাবার ফ্রিজিং করুন নিয়ম মেনে। রান্না করা খবার অবশ্যই ঢেকে ফ্রিজিং করতে হবে। রেফ্রিজারেটরের নরমালে রেখে কোনো খাবারই দুই দিনে বেশি খাওয়া ঠিক না। মাছ, মাংস বক্সে সংরক্ষণ করা ভালো। বক্স না থাকলে মোটা পলিব্যাগে রাখতে হবে। কোনো রান্না করা খাবারই ফ্রিজ থেকে সরাসরি বের করে খাওয়া ঠিক না, গরম করে খাওয়া উচিৎ। সরাসরি ফ্রিজে রাখা পানি না খেয়ে বরং পানিতে বরফের টুকরো দিয়ে খেতে পারেন।    

সুষম খাদ্য উপাদানের সবগুলোই আমাদের শরীরের জন্য জরুরী। তাই সবগুলো খাওয়ারই অভ্যাস করতে হবে। এবং এদের কোনো উপাদানে শরীরের কোনো সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে নিজে বুদ্ধি করে খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। একবার আমাদের শরীর কোনো খাবারে অনভ্যস্ত হয়ে পড়লে পরবর্তীতে আর ঐ খাবার পরিপাক বা ধারণ করতে পারে না এবং সেই খাবারের অভাবজনিত সমস্যা দেখা দেয়। আর এই জন্যই ডায়েট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশষজ্ঞ বা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করা উচিৎ।

আরো পড়ুন:

চকলেট খেলে সেরে যাবে সর্দি-কাশি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *