স্বাস্থ্য

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে অনেক পথ এগিয়েছে বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, অসম্ভব কিছু নয়। দেশের ক্ষুদ্র আয়তন ও সীমিত সম্পদের বিপরীতে রয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে রয়েছে আকাশচুম্বী বৈষম্য। স্বাস্থ্য বীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। এমতাবস্থায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতেই হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা হচ্ছে, সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হয়ে পড়বে না। উদ্দেশ্য অর্জনে কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে, স্বাস্থ্য বীমা মানুষকে সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিটের তৈরি ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার মাত্র ২৩ ভাগ বহন করে সরকার আর ৬৭ ভাগ ব্যয় করে ব্যক্তি নিজে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। ২০১২ সালে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৩ শতাংশ বহন করত ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে। আর এখন তা বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। আর এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো বহন করছে ১০ শতাংশ। স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়লেও সরকারি অংশের খরচ কমেছে।
স্বাস্থ্য বীমার কার্যক্রম কম
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোগীর সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বীমা চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনও এ সেবা সফলভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য বীমা শুরু হলেও তা দেশের মাত্র একটি জেলার তিনটি থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য বীমায় আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
জানা যায়, দেশে প্রচলিত প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা খুব গ্রহণযোগ্য না হলেও গ্রুপ স্বাস্থ্য বীমা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বহু প্রতিষ্ঠান এই গ্রুপ স্বাস্থ্য বীমা করছে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ ব্যাংকসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। অন্যদিকে কমিউনিটি পর্যায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকার পরও দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমা করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া আগে টাকা দিয়ে পরে সেবা গ্রহণের মনোভাব না থাকা এবং একজনের টাকায় অন্যজনের চিকিৎসা এ বিষয়েও অনীহা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। পৃথিবীর উন্নত দেশ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা অনেকাংশে বীমার ওপর নির্ভরশীল। ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় মেটাতে সেসব দেশের জনগণকে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাংলাদেশের মানুষকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ ভাগ পকেট থেকে করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা পেতে বীমাতে অনাগ্রহের কারণে অধিক সংখ্যক মানুষকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) আওতায় আনা যাচ্ছে না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭ উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম সবার জন্য সুস্বাস্থ্য। কারণ দেশের সব ধরনের উন্নয়নের স্থায়িত্বের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এজন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর এবং স্বাস্থ্য বীমার বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমার প্রতি অনাগ্রহী। এই প্রেক্ষিতে দেশে স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা সহজ নয়। এর জন্য সমন্বিত (সরকারী-বেসরকারী) উদ্যোগ প্রয়োজন। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সম্প্রতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শ্লোগান হিসেবে শুনতে ভাল। কিন্তু এই জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। অর্থ ছাড়া মানসম্পন্ন সেবা দেয়া সম্ভব নয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসনসহ আরও বেশকিছু মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সকলের আন্তরিক অংশগ্রহণ দরকার : বিশেষজ্ঞগণ
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সাবেক মহাপরিচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণা আমাদের জন্য নতুন নয়। সংবিধানে সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়টি উল্লে­খ করা হয়েছে। ২০০০ সালের আলমা আতা ঘোষণায়ও ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’-এ কথা বলা হয়েছিল। তাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। তবে ইউএইচসিতে যে বিষয়টি নতুন তা হলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এবং তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব সেই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বস্তি, ভাসমান, চর ও হাওড়াঞ্চলের মানুষ এখনও স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে না। দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে।
দরকার দক্ষ জনবলও
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলও দরকার। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি আছে। সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দূরেই আছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *