নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি নিয়ে জটিলতা রয়েই গেছে। তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে সরকার ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে আদিবাসী জনগণকে ইতোমধ্যে ‘উপজাতি, নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করেছে সরকার। সরকারী ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। এমন মতানৈক্যের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বের অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশেও আজ (৯ আগস্ট) পালিত হচ্ছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর ধরে ভিন্ন পরিবেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। অনলাইন মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকছে সকল কর্মসূচী।
আদিবাসী নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, নানাভাবে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনে নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে সরকার। প্রশাসনে এবং সরকারী পর্যায়ে এ ধারণা প্রবলভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশে ৪৫টি জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী রয়েছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে পাহাড়ী ও সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একের পর এক কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে তারা। সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে তারা নিজেদের দাবিদাওয়া পেশ করেন। স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় তারা বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু আদিবাসীদের দাবি এড়িয়ে যায় সরকার। ২০১২ সালে আদিবাসী স্বীকৃতি নাকচ করে দিয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন আদিবাসীরা। তারই ধাবাবাহিকতায় ২০১২ সালে একই বক্তব্য দেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। ‘আদিবাসী’ বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে ২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশী কূটনীতিক ও উন্নয়নসহযোগী গোষ্ঠী এবং দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের পৃথক পৃথকভাবে ব্রিফিং করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করতে বারণ করেন এবং পক্ষান্তরে তাদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ বা ‘উপজাতি’ (ট্রাইবাল) আখ্যায়িত করতে পরামর্শ দেন। ২০১২ সালে এই দু’মন্ত্রীর বক্তব্য যেন কাগজে-কলমে রূপ পায়। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে ৩০ লাখ আদিবাসীকে ‘উপজাতি, নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে সরকার। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আদিবাসীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, “সংবিধানে আদিবাসীদের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদিবাসী জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, আদিবাসীদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সব সময়ই আদিবাসীদের প্রতি বৈরী মনোভাব কাজ করে। সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিসমূহের স্বীকৃতি প্রদান করতেই হবে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সরকার কখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস উদযাপন করেনি। সব সরকারই আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের অধিকার অস্বীকার করেছে, যা দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে।”
সন্তু লারমা আরও বলেন, “দেশের আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভাল নয়। তাদের ওপর হামলা, তাদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করেও সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, আদিবাসীর মতামতও নেয়া হয়নি। উন্নয়ন, পরিকল্পনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আদিবাসীর সিদ্ধান্ত নির্ধারণী কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয় না সরকার। বরং উন্নয়নের নামে আদিবাসী জীবনধারা বিপর্যস্ত করে তোলা হয়।”
সন্তু লারমা আরও অভিযোগ করেন, “নানা কৌশলে দেশের আদিবাসীকে পেছনে রেখে দেয়া হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে, আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ বলা যাবে না। তারপরও প্রশাসনে এবং সরকারী পর্যায়ে এ ধারণা প্রবলভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। কেউ ইচ্ছে করলেই কোনো জাতিসত্তার পরিচয় বদলে দিতে পারে না। দেশে আদিবাসী ভূমি দখলের উৎসব চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে আদিবাসী ঘোষণাপত্রের আলোকে আদিবাসীর উন্নয়নে পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চলেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে।”
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, “মানবাধিকার লংঘন, ভূমি দখল, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে আদিবাসীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে। আদিবাসী জনগণের সঙ্গে বাঙালী জনগণের সংহতি স্থাপন ও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের জাতীয় উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলমান ভূমিকা অব্যাহত রাখতে চায় আদিবাসীরা।”
মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা সবাই জানি আদিবাসীরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ মানুষ হিসেবে তাদের সে অধিকারগুলো দরকার। আমরা আদিবাসীদের সংগ্রামের সঙ্গে সহভাগী হতে চাই।”