তাপস হালদার :
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। ১০ই জানুয়ারী, ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের হাল ধরেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি ধ্বংসস্তুপের দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রথম বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বলেছিলো, ‘সবচেয়ে ভাল পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। এদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’
আর ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জিডিপি’র আকার ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার, দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ।
বাংলাদেশের গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বড় অর্জন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণ। বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে কোনও দেশকে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও সেই তিনটি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের ৪০তম প্লেনারি সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ এখন স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করল। যদিও প্রস্তুতিকালীন পাঁচ বছর পর ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সেন্ট্রাল ইকোনমিক বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। আর ২০৪১ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে একটি হবে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের অর্জন নিয়ে বিশ্বের অর্থনীতিবিদসহ অনেকে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর দেশের জিডিপি ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। আর বিগত এক যুগে সেটা চারগুণ বেড়ে ৪১১ বিলিয়ন ডলারে (গড়) দাঁড়িয়েছে।
শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসেবে অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ১৫৩ জন। ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জন। ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো প্রতি হাজারে ২শ ১২ জন। সেটি ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে মাত্র ২৯ জন। ১৯৯১ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। জাতিসংঘের মানব সম্পদ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ শতাংশ। এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলত শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর, যেখানে ভারতের ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’র সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। যেকোনো সময় জরুরি ভিত্তিতে সেবা পেতে আধুনিক বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চালু হয়েছে ইমার্জেন্সি সার্ভিস ‘৯৯৯’ কল সেবা। এ ছাড়া জনগণের সেবাদানে অন্যান্য কল সেবাগুলো চালু হয়েছে; দুদক, নারী নির্যাতন বা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, সরকারি তথ্যসেবা, স্বাস্থ্য বাতায়ন, দুর্যোগের আগাম বার্তা, জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্য ও মানবাধিকার সহায়ক কল সেন্টার।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সারাদেশে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। এসব বাস্তবায়ন হলে কর্মসংস্থান তৈরিসহ অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার হবে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে উদীয়মান এশিয়ান টাইগার বলেও আখ্যায়িত করেন। আর ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলা সেই দেশেরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ২০১৬ সালের আাগস্ট মাসে ঢাকা সফরে এসে বলে গেছেন, ‘বাঙালী জাতির মেধা, পরিশ্রম আর একাগ্রতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
পাকিস্তানকে আমরা পরাজিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই পাকিস্তান থেকে এখন বাংলাদেশ অর্থনীতি ও সামাজিক উন্সয়নসহ সকল ক্ষেত্রেই এগিয়ে গেছে। মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃ মুত্যু হ্রাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রোল মডেল।বাংলাদেশ এখন তার নিজস্ব রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঋণও দিচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কাকেও ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন সারাবিশ্বে প্রশংসিত। আর্থ-সামাজিক সকল সূচকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল:haldertapas80@gmail.com
আরো পড়ুন:
আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যেভাবে উজ্জীবিত করেছে মুক্তিযুদ্ধকে