অভিমতউৎসব-পার্বণ

বাঙালির সর্ববৃহৎ সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ বরণ

তাপস হালদার

১লা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণ। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার নানা আয়োজন ৷ রমনা বটমূলে ছায়ানট কেন্দ্রীয়ভাবে বর্ষবরণের আয়োজন করে থাকে। তবে নববর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামের প্রতিটি অঞ্চলে৷ এটি বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

শুরু হল ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। গত বছরও  বাঙালি বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পালন করতে পারেনি। এবছরও নববর্ষের অনুষ্ঠান ঘরোয়াভাবে পালন হবে। একটি অজানা অচেনা মরণব্যাধি করোনা নামক ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে জনসমাগম এড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান সরকারী নিষেধাজ্ঞায় বাতিল করা হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি ও নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণের আয়োজন বিগত বছরের  মতই নিরুত্তাপ থাকবে।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে মিলত না।এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধে বাধ্য করা হত। কৃষকদের অযথা হয়রানি থেকে মুক্ত করতে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রথমে নাম ছিল ফসলি সন যা পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন নামে পরিচিত হয়।

সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ শুরু হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন সকলে খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করত। পহেলা বৈশাখে তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। সে সময় থেকেই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন স্বর্ণ, মনোহারি ও কাপড়সহ বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীরা পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করে নতুন করে হিসাবের খাতা খুলতেন, যাকে বলা হয় ‘হালখাতা’। বাংলা সনের প্রথম দিনটিতে ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন ‘হালখাতা’ এবার হচ্ছে না। ‘লকডাউন’ পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় এবছরও হালখাতা খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

পাকিস্তান সৃষ্টির পরই  বাংলার এই সর্বজনীন সংস্কৃতির উপর আঘাত আসে। বর্ষবরণকে হিন্দুদের সংস্কৃতি অ্যাখ্যা দিয়ে পালন করতে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৫৮ সালে বাংলা নববর্ষের সরকারি ছুটি বাতিল করে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান – স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল পুরো বাঙালি সমাজ। ষাটের দশকে মৌলবাদী পাকিস্তানিরা সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংসের যে পাঁয়তারা শুরু করেছিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বন্ধ করা ছিল তারই ধারাবাহিকতারই অংশ।

পাকিস্তানিদের এই অন্যায় নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ‘ছায়ানট’ ঢাকার রমনা বটমূলে সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন করে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে। বাংলা নববর্ষ গ্রামীণ আবহে জন্ম নিলেও শহরের আভিজাত্য থেকে মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেণীরই মিলন মেলায় পরিণত হয়। পয়লা বৈশাখের এই আনন্দধারা সমগ্র বাংলায় এবং বিশ্বের সব বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা নববর্ষ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসবে।

নববর্ষের সাথে পান্তা-ইলিশের সম্পর্ক এখন যেন একাকার হয়ে গেছে। ভাবখানা এমন মনে হয় যে,পান্তা -ইলিশ নেই ! তাহলে কিসের নববর্ষ? বিশেষ করে এটি শহুরে সংস্কৃতির সাথে একদম মিশে গেছে। অথচ এই প্রচলন শুরু হয়েছে বেশি দিন আগে নয়। ১৯৮৩ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনা এলাকায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পান্তা ভাতের দোকান দেয়া হয়। অভিনবত্ব আনতে পান্তার সাথে পরিবেশন করা হয় ইলিশ ভাজা। সেই থেকে শুরু, এটি আজ অভিজাত বাঙালি শ্রেণীর কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি কোন মতে  বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়।

গ্রাম-গঞ্জে নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। হরেক রকমের কারুপণ্যের বিকিকিনি হয় বৈশাখী মেলায়। যাত্রা, পালাগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, বাউল গানসহ নানা আঞ্চলিক গানে সরগরম হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। ভোরের সূর্য উদিত হলেই বাঙালিরা নতুন পোশাক পরিধান করে বের হয়ে পড়ে। এই দিনটিতে ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়, অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় এখন  সকল শ্রেণী-পেশা কিংবা  বয়সের মানুষের কাছে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর স্যোশাল মিডিয়ার বদৌলতে  শুভেচ্ছা বিনিময়েও এসেছে নানামুখী বৈচিত্র্যতা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজন থেকে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রথম বের হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রতি বছর  শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। এবং সম-সাময়িক  বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে বিভিন্ন রংয়ের মুখোশ ও প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি পহেলা বৈশাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে।

স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল সময়ে বাংলাদেশের অনেক অসাধ্য অর্জনের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার কালো থাবা সম্প্রীতির পরিবেশকে মাঝে মাঝে বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করছে। এরা নববর্ষকে মানেনা, বাঙালি সংস্কৃতি মানেনা। এদের লক্ষ্য বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করা। এই চক্রটি ক্ষুদ্র হলেও এদেরকে আর বাড়তে দেয়া যাবেনা। এদের মূলোৎপাটন করা অতীব জরুরী।

বাংলা নববর্ষের মতো অসাম্প্রদায়িক  সর্বজনীন উৎসব বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া পাওয়া যাবেনা। এখানে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের কোনো ভেদাভেদ থাকে না৷ বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য মিশে আছে এই বাংলা বর্ষবরণের সঙ্গে৷ এই উৎসব বাঙালিকে  আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেয়৷ আর এ কারণেই এই বাংলা বর্ষবরণ উৎসব সবাইকে একই স্রোতে নিয়ে আসে। এই উৎসব বাঙালিকে পরিশুদ্ধ করে, শক্তি ও সাহস জোগায়৷ নববর্ষ অশুভকে বিদায় দিয়ে শুভ শক্তির আগমনের আহ্বান জানায়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী গান “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।” করোনা মহামারির কারণে এই গান গেয়ে প্রতিটি বাঙালি ঘরে থেকেই নতুন বছরকে আহ্বান জানাবে। আমাদের প্রার্থনা থাকবে বিশ্ব করোনা ভাইরাসমুক্ত হোক। নতুন বছরে আবার সবার জীবন সুন্দর ও স্বাভাবিক হোক। আঁধার কেটে বেরিয়ে আসুক নতুন সূর্যালোক।

শুভ নববর্ষ।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@ gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *