প্রেমচাঁদ বৈরাগী :

ভাবছিলাম সেই ভয়ংকর ঊষালগ্নের কথা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদুরে মেধাবী কন্যা, তাঁর আদরের ‘হাচু’, যদি সেদিন তাঁর সাথেই থাকতেন, তবে কী হতো! আমার এই প্রতিবেদন নিশ্চয় এভাবে লেখা হতো না! এক রক্তাক্ত ভোরের কুৎসিত ইতিহাসে মৃত মানুষের তালিকায় তাঁর নামটিও লেখা হতো। যেমনভাবে ফুটফুটে ছোট্ট রাসেলের নামও লেখা হয়ে আছে! জানিনা, রাসেল বেঁচে থাকলে আজ তাঁর অবস্থান কোথায় হতো – তিনি পিতাকে অনুসরণে একজন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতেই পারতেন, আবার নাও হতে পারতেন। তিনি এই বিশ্বের একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হতে পারতেন বা সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, খেলোয়াড় – যা কিছু হতে পারতেন বা নাও হতে পারতেন। সম্ভাবনা ও প্রতি সম্ভাবনার এই পৃথিবীতে স্হান কাল ও পাত্রের অবস্থান বোধহয় সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সম্ভাবনার দার্শনিক তত্ত্বকথা নিয়ে বেশি আলোচনা না করে এই উপমহাদেশের সবচাইতে তৎপর ও বাস্তববাদী জননেত্রীর গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখাই সমীচীন।

এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় আরও দু’জন শক্তিশালী নারীর প্রসঙ্গ এসেই যায়। শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ও ইন্দিরা গান্ধী। এঁদের তিন জনের ক্ষেত্রেই একটা মিল লক্ষ্যণীয় – এঁরা কেউ রাজনীতিতে হঠাৎ আসেননি। ইন্দিরা গান্ধী যেমন বাবার মৃত্যুর পরে রাজনীতিতে থিতু হয়েছিলেন, তেমনি শ্রীমোভা তাঁর স্বামী তথা তৎকালীন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দরনায়েকের নিষ্ঠুর হত্যার পর ১৯৬০ সনে রাজনীতিতে আসেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হন। আর শেখ হাসিনার বিষয়টা আমরা সকলেই জানি, সেই হাজার বছরের নৃশংসতম হত্যা ঘটনার পরে তিনি রাজনীতির আঙিনায় পা দিয়েছিলেন গণতন্ত্রেরই প্রয়োজনে। তবে সেটা খুব তাৎক্ষণিক বা সহজে হয়নি। সময় ও সমাজ তাঁকে বেশ খানিকটা পরেই রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

প্রসঙ্গত বলা যায়, পিতাসহ পরিবারের বহু সদস্যকে চিরতরে হারিয়েও তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে পা ফেলতে পারেননি। এইজন্য তাঁকে বহুবছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, দেশের বাইরে থাকতে হয়েছিল বহুকাল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকালে তিনি তাঁর বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ছিলেন এবং ঘটনার কথা প্রাথমিকভাবে তাঁকে জানানো হয়নি। তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত ফোনে ওয়াজেদ মিয়াকে আংশিকভাবে এই দুঃসংবাদ জানান এবং তাঁদের আসন্ন প্যারিস সফর বাতিল করে নিরাপত্তার কারণে বনে তাঁর বাসায় চলে আসতে বলেন। আরো কিছুদিন পরে ভারত সরকারের ব্যবস্হাপনায় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে এসে তাঁর পরিবারের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা জানতে পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেই সময় শ্রীমতী গান্ধী তাঁকে স্নেহমহীর মতো সান্ত্বনা ও সাহস জোগান।

তার পরের ইতিহাস আমরা সকলেই জানি – ক্ষমতা দখলের ‘সামরিক’ লড়াইয়ের মধ্যে বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক চেতনার ভরকেন্দ্রটি সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলেছিল। অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানে অর্জিত রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল, পুনরায় উত্থান হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী ঘাতক শিবিরের। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। তাঁর দল নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলো। কিন্তু ততোদিনে যা হবার হয়ে গেছে – দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষ মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে গেছেন। আর সেখান থেকেই শুরু হাসিনা ওয়াজেদের সংগ্রাম। এক্ষেত্রে শ্রীমতী বন্দরনায়েকে ও শ্রীমতী গান্ধীর চাইতে শেখ হাসিনাকে আমি অনেকটা এগিয়ে রাখতে চাই এই কারণে যে, তাঁর রাজনৈতিক অভিষেকটি নির্বাসিত অবস্থায় বহু বহু প্রতিকূলতায় সংগঠিত হয়েছিল যা পূর্বক্তোদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

১৯৮১ সনের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরার সুযোগ পান এবং তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। একনায়ক এরশাদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে সংগ্রাম, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি দেশে কীভাবে একটি অপরিপক্ক সুযোগসন্ধানী স্বৈরাচারের জন্ম দেয় তা স্পষ্ট করেছে। তেমনি পরিকল্পনাহীন ও দর্শন বর্জিত নেতৃত্ব কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতাকে তেমন কাজে লাগাতে পারে না, এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন তিনি বেগম খালেদা জমানায় বিরোধী নেত্রী হিসেবে।

’৯৬ সনে প্রথমবার ক্ষমতায় আসা থেকে আজ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থেকে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যা অন্য জমানায় অনেকটাই কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল। প্রথমেই যেটা বলা উচিৎ বলে মনে করি তা হলো ১৯৯৭ সনে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একটি স্হায়ী ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেন – তাঁর মন্ত্রীসভা মার্চ মাসে ‘নারী প্রগতির জন্য জাতীয় নীতি’ অনুমোদন করে যা বাংলাদেশের নারীদের জন্য কেবলমাত্র বিদেশি সহায়তাই নয় দেশের পরিকাঠামো বা সম্পদ কাজে লাগিয়ে নারী উন্নয়নের রাস্তা তৈরি করে দেয়। ৪৪ সদস্যের জাতীয় মহিলা কাউন্সিল গঠন করেন তিনি। গঠিত হয় ক্ষমতাশালী নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়।

যদিও সেই সময় দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ পুরুষতান্ত্রিক অবজ্ঞা ও ধর্মীয় কুসংস্কার এর উদ্দেশ্যকে ব্যাপকভাবে সফল হতে দেয়নি। তবে সেদিন এর শুরু না হলে আজকের বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়ন যে তুলনামূলকভাবে অনেক এগিয়ে উপমহাদেশে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছে, তা অবশ্যই সম্ভব হতো না। নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বুনিয়াদি শিক্ষাকে এ পর্যায়ে যুক্ত করা হয় যাতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তারা জীবিকা অর্জন করতে পারেন।

আজকের পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের এই বিস্তারে সেইসব কর্মজীবী মহিলাদের যোগদান প্রবল। এছাড়া বিভিন্ন সময় জাতীয়তাবাদ বিরোধী ঘাতকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি দেশের যোগাযোগ, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে অনেক বাস্তবমুখি প্রকল্প গ্রহণ করেতে পেরেছেন। যার ফলে আজ মাঝে মাঝে জাতীয় আয়ে বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে সবাইকে ছাপিয়ে চলে যায়।

খুব সম্প্রতি ঢাকায় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। আর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নদীমাতৃক দেশটিতে যে উচ্চতায় শেখ হাসিনা পৌঁছে দিতে পেরেছেন তা এক কথায় অভাবনীয়। অন্তত এটুকু বলাই যায়, যে সমকালীন ব্যবস্থা ও শর্তের মাধ্যমে আজকের জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে ওঠে তার অনেকটাই পূরণ করতে পারছে আজকের বাংলাদেশ হাসিনা ওয়াজেদ-এর নেতৃত্বে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে— আমার বাড়ি আমার খামার, আশ্রয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম, নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রমসমূহ, সবার জন্য বিদ্যুৎ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, বিনিয়োগ বিকাশ, ও পরিবেশ সুরক্ষা। এগুলোর মাধ্যমে প্রত্যায়িত হয় যে, বিকাশ ও জনকল্যাণের বিষয়টিকে তিনি কেবল কিছু শিল্প মালিকদের মুনাফা বৃদ্ধি করিয়ে জাতীয় গড় আয়কে বড়ো করে দেখানোর কৌশল হিসেবে নেননি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিশ্বের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন নির্বাহের জন্য তাঁর চিন্তাধারা আবিশ্ব চিন্তাশীল নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, গত ২০০৯ সনে ইতালিতে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সম্মেলনে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে সুষম বণ্টন ব্যাবস্হার মাধ্যমে এর সুফল পৌঁছে দেওয়া এবং খাদ্য উৎপাদনে বিশ্ব পরিবেশের প্রভাব সংক্রান্ত যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা তাঁর সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রকাশ।

তবে একটি বিশেষ বিষয়ে তাঁকে আরো তীক্ষ্ণ হতে হবে দেশ ও সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সেটি হলো তাঁর দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান। এ বিষয়ে তাকে আরো তৎপরতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের দুর্নীতি আজকের ঘটনা নয়। স্বাধীনতার সূচনা থেকেই বা তার আগে থেকেই এটি ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে আজকে ছাত্র নেতাদের মধ্যেও এটা জেঁকে বসেছে। এমনকি তাঁর নিজের দলের মধ্যেও অসংখ্য দুর্নীতিবাজ লুকিয়ে আছে। আমরা মাঝে মাঝেই তাঁর মধ্যে প্রতিরোধের ঝলক দেখতে পাই, কিন্তু দুর্নীতি দমনে তাঁকে একটি সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে অন্তত কিছুদিনের জন্য এই বিষয়ে তাঁকে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। তিনি সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ দমনে যেমনি নিরবচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এই উপমহাদেশের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন, তেমনি দুর্নীতির মতো একটি উপমহাদেশীয় রোগ নিরসনে প্রতিবেশী দেশগুলিরও আদর্শে পরিণত হবেন বলে আশা রাখি।

অবশ্য দুর্নীতি দমনে তাঁর একার প্রয়াস যথেষ্ট নয়, এতে সব রাজনৈতিক দল এবং সুনাগরিকের যোগদান দরকার। বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর, ভারত পাকিস্তানেও, সমস্যা হলো কোনও দুর্নীতিবাজ নেতাকে একদল অর্ধচন্দ্র দিলে অন্যদল তাকে সাদরে গ্রহণ করে। এই মুহূর্তে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এই নজির রোজকার।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি যেমনি বামপন্থীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া মিটিয়ে দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলি বিশেষ করে ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্য, প্রযুক্তি, কৃষি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে আদান-প্রদানের রাস্তা সুগম রেখে ধৈর্যশীল বাস্তবানুগ নীতি নিয়ে চলেছেন। ইদানীংকার তিস্তার জল বন্টনের ক্ষেত্রে, যা আমিসহ বহু ভারতীয় মনে করেন বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা, তাঁর ধৈর্যপূর্ণ স্থিতিশীল মনোভাব আমাকে মুগ্ধ করেছে। সত্যিকারের আন্তর্জাতিক নেত্রীর স্পষ্ট ছায়া আমি তাঁর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। তাই আশা রাখি আগামী দিনে অন্তত ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিময় আরো সহজ হবে, দেশ ভাগের যন্ত্রণা খানিক উপশমের জন্য সহজ ভিসা বা ভিসা ছাড়া যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ দুই দেশের নাগরিকরা যাতে দুই দেশেই চাকুরি বা ব্যবসা করতে পারেন সেই ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ চোখে পড়বে।

আর শেষে এটি বলতে চাই – সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কিছু দরজা যা এখনো বন্ধ রয়েছে, বই-পুস্তক বাণিজ্যিকভাবে আদান প্রদান, দূরদর্শন ও চলচ্চিত্রের অবাধ বাণিজ্যিক প্রদর্শন ইত্যাদি, তা খুলে দিতে তিনিই প্রথম এগিয়ে এসে সমগ্র বাঙালির নেত্রী হয়ে উঠুন। হয়ে উঠুন এই উপমহাদেশের পথ প্রদর্শনকারী।

লেখক: প্রেমচাঁদ বৈরাগী, সংস্কৃতি কর্মী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

আরো পড়ুন :

আশার বাতিঘর শেখ হাসিনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *