অভিমত

১৫ আগস্ট : একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক ও কিছু মতাদর্শ

তাপস দাস :

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধানকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যেভাবে গুণে গুণে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে সে রকম ঘটনা বিরল। শিশু-কিশোরসহ ১৬ জন নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সাথে সাথে চুরমার হয়েছিল সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন, কুঠারাঘাত করা হয়েছিল চার মূলনীতির ওপর, বাংলাদেশ প্রবাহিত হয়েছিল অন্য খাতে। ফলস্বরূপ ১৯৮৮ সালে সাংবিধানিকভাবে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যুক্ত করা হয়।

তবে আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য এটা নয় যে কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল অথবা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতির কী পরিবর্তন ঘটে। আমি লেখার মধ্যে দিয়ে দেখতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার রাজনৈতিক ভাবনা বা মতাদর্শ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুছে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছিল আরো বেশ কিছু ব্যক্তির মতাদর্শ, যাদের তিনি শ্রদ্ধা করতেন, বিশেষ করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধী উল্লেখযোগ্য। বারবার এই তিনজনের কথা বঙ্গবন্ধুর লেখায় এবং কাজে সর্বোপরি তাঁর মতাদর্শ তৈরিতে সাহায্য করেছিল। যদিও এই তিনজন মহান ব্যক্তি ছাড়াও তিনি অন্যান্য ব্যক্তি যেমন ফজলুক হক, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ব্যক্তিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমি এই লেখার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতাজী, গান্ধীজী এবং কবিগুরুর প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল সেটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সুভাষ বসু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এক ধরনের শ্রদ্ধা ছিল। ছেলেবেলা থেকেই তিনি সুভাষ বসুর ভক্ত। কিন্তু পাকিস্তান প্রশ্নে তাঁর মনেও দ্বন্দ্ব লেগেছিল। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন “হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগতো। এই সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হত, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধহয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হত, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ান সহজ হবে। আবার মনে হত, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কি হবে? আবার মনে হত, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম।”

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি বাঙালির মুক্তির জন্য একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র পন্থার কথা চিন্তা করেছিলেন। পাকিস্তানের কাঠামোয় বাস করে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে বোধ হয় এই বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানিদের মতো বর্বরতা কখনও গণতান্ত্রিক পন্থায় সমঝোতায় আসবে না। অন্তিমে সশস্ত্র পন্থাই হবে উত্তম। এক্ষেত্রে, তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অনুগামী। সুভাষ বসু ছিলেন তাঁর কাছে এক বীর। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ অন্তিমে বাঙালিকে তিনি নির্দেশে দিয়েছিলেন সশস্ত্র পন্থার জন্য তৈরি হতে। ১৯৬২ সালেই তিনি প্রবাসী সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। এরকম কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। শশাঙ্ক ব্যানার্জীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “সাইপ্রাসের আক্রোতিরিতে ব্রিটেনের বিমান ঘাঁটিতে তেল ভরা হলো কমেট জেটে। তারপর ওমান। ব্যানার্জী দেখলেন, বঙ্গবন্ধু বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন – ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ব্যানার্জীকে বললেন গলা মেলাতে। প্রথমবারেরটা হলো রিহার্সালের মতো। দ্বিতীয়বার আবেগে ভরা। বঙ্গবন্ধুর চোখ সজল।

বঙ্গবন্ধুর জামাতা ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, “৩রা জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন। এক পর্যায়ে গম্ভীর হয়ে আমাদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেশটা যদি কোনোদিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কবিগুরুর আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি – গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করো।’

আমরা জানি পরবর্তীতে সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন, “সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।” কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ।” সুতরাং দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু তাঁর পথপ্রদর্শককে শুধু চিন্তার জগতে রাখেননি তাকে বাস্তবের মাটিতে ব্যবহার করেছেন।

‘অসহযোগ’ এবং ‘অহিংসা’ -এই দুটি প্রত্যয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যুক্ত। গান্ধীজী দুটি প্রত্যয়কেই রাজনীতিতে একইসঙ্গে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, এককভাবে একটিকে নয়। এই প্রত্যয় দুটি একজনই সফলভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এই উপমহাদেশেই। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন অসহযোগ আন্দোলন হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে তা এগিয়ে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাঁধে। ঘোষণা করেন- “এখানে বসবাসকারী বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সমান। সবাই আমাদের ভাই এবং সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

তিনি লিখেছিলেন, “অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শিখর। অসহযোগে যে ৩৫টি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা হলো নিরস্ত্র মানুষের কর্তৃত্ব। পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিল একেবারে নতুন ধারণা। সাধারণ মানুষ নির্বাচিত করেছেন জনপ্রতিনিধিদের। জনপ্রতিনিধিরা নির্দেশ দিচ্ছেন এবং তা সমগ্র জনসাধারণ মানছে। এর বাইরে নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি কর্মচারিরা এই নৈতিক জোরের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি কিন্তু ক্ষমতায় যাননি, তাদের কথাই মানতে বাধ্য হচ্ছেন। এই কর্তৃত্বের স্বাদ বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো নিরাষ্ট্রকে দিতে পেরেছিলেন, যে কারণে তারা ছিল উদ্বুদ্ধ। ভারতে অসহযোগ আন্দোলন কোনো পরিণতি পায়নি। বাংলাদেশে পেয়েছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু শুধুমাত্র এক দেশনায়ককে হত্যা নয়, হত্যা করা হয়েছিল বহু মতাদর্শকে।

তথ্যসূত্র :
রহমান, শ. ম. (২০১২), অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
মামুন, ম. (২০১৩), বঙ্গবন্ধু কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন, মাওলা ব্রাদার্স।
মামুন, ম. (২০১৯), বঙ্গবন্ধুর জীবন : ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি ১৯২০-১৯৪৯, সময়।
মামুন, ম. (২০১৯), ষড়যন্ত্রের রাজনীতি : দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা, কথা প্রকাশ।
হোসেন, স. (২০২০), পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ : রবীন্দ্রনাথ ও শেখ মুজিবুর রহমান, কথা প্রকাশ।

লেখক: গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *