অভিমত

বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা : গণমানুষের পাশে আওয়ামী লীগের ৭২ বছর

তাপস হালদার :

২৩ জুন ১৯৪৯, ঢাকার রোজ গার্ডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ গঠন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।”

২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস হওয়ার নেপথ্যে একটা  ইতিহাস আছে। ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর আম্রকাননে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লা পরাজয় বরণ করেন। ঠিক ১৯২ বছর পর বাংলার জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছিল তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

উপমহাদেশে শত শত রাজনৈতিক দল থাকলেও তিনটি  দলের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ এবং বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। কংগ্রেসের নেতৃত্বে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। এ কারণেই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই তিনটি দলের গুরুত্ব ও মর্যাদা আলাদা।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী  সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দী তরুণ উদীয়মান নেতা  শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় কাউন্সিলেই ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১ বছর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।

আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটা যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সকল ধর্মাবলম্বীদের দলে সুযোগ করে দেয়া হয়। নতুন নাম দেয়া হয়- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। যা স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

আওয়ামী লীগ দলটি প্রতিষ্ঠার পরই পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার  কারণে দলটির জনপ্রিয়তা খুবই দ্রুত বাড়তে থাকে। শুরুতেই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ২৩৭টি  আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। এছাড়া সব সময় বিরোধী দলে থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই, সংগ্রাম করে গেছে।

১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দল থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দলটির প্রথম ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদল তরুণ কর্মী বাহিনী নিয়ে দলটির হাল ধরেন। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দেওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ছয় দফার ভিত্তিতেই ৭০-এর নির্বাচন হয়, আওয়ামী লীগ  নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসকদের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ। দলে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী (মিজান-আওয়ামী লীগ) ও ফরিদ গাজী (আওয়ামী লীগ-ফরিদ গাজী) নামে দল গঠন করেন। পরবর্তীতে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন  শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি হয়ে দেশে ফিরে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮৩ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেন। যা ছিল দেশরত্ন শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর দলে প্রথম ভাঙ্গন। ’৯১ সালে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর বাকশাল বিলুপ্ত করে তারা পুনরায় আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। আর ’৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ড. কামাল হোসেন গঠন করেন গণফোরাম। কালের পরিক্রমায় গণফোরাম এখন নামসর্বস্ব একটি দল।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লড়াই-সংগ্রাম করে  দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার পর ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা করেনি। হাজার হাজার নেতাকর্মীদেরকে হত্যা, গুম করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে জনসভা মঞ্চে প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করা হয়। ২০০৭ সালে ১/১১ সরকার এসেও আওয়ামী লীগকে  রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে গ্রেফতার, দলে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য সংস্কারপন্থী নেতাদের দিয়ে দল তৈরির চেষ্টা, দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি করেও নেতাকর্মীদেরকে বিভক্ত করতে পারেনি।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত সরকার গঠন করে। আর সেই থেকে টানা একযুগ দেশ পরিচালনা করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বটগাছের মত মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বটগাছ থেকে দু-একটা পাতা ঝরে গেলে যেমন গাছটির কিছুই হয়না বরং পাতা গুলোই মাটিতে বিলীন হয়ে যায়। ঠিক তেমনি অতীতে যারা আওয়ামী লীগ থেকে  চলে গেছে তারাই রাজনীতি থেকে বিলীন হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, বিশাল দলটির কিছু হয়নি। আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক শক্ত, অনেক গভীরে। দলটি বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। অতীতে অনেক উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে চলে আসা দলটি আরো মজবুত হয়েছে। সরকারি দলে থাকার সময় যেমন জনগণের সেবা করেছে, আবার বিরোধী দলে থাকার সময় কখনো জনগণের ন্যায় সঙ্গত দাবী নিয়ে আন্দোলন করেছে। কখনও জনগণ থেকে দূরে সরে যায়নি।

আওয়ামী লীগের ৭০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচনা সভায় সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে বারবার ভাঙ্গা-গড়ার খেলা দেখতে হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল যতবারই ষড়যন্ত্র করে ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছে ততবারই আরও শক্তিশালী হয়েছে। হীরার টুকরা যত কাটে তত উজ্জ্বল হয়। আওয়ামী লীগেও ঠিক সেটাই হয়েছে। যে যখনই ক্ষমতায় এসেছে সবার আগে আওয়ামী লীগের উপর আঘাত হেনেছে।’

আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘ পথ চলার সময়ে যারাই ক্ষমতায় ছিল তারাই আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছে কিন্তু সেসকল দলগুলোই আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এদেশের জন-মানুষের দল। এদেশের যা কিছু অর্জন তার নেতৃত্ব দিয়েছে  বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দিয়েছে স্বাধীনতা আর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি। ভাষা আন্দোলন, সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়া এমন সব গৌরব পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। আজ ৭২-এ পদার্পণ করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। শুভ জন্মদিনে আওয়ামী লীগের যেসকল কোটি কোটি নেতাকর্মীর আত্মত্যাগে দলটি আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে সেসকল নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্খীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *