ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল :
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই নজরুলকে চেনা, ‘আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত……’ আর আমাদের সমর সঙ্গীত, ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল……’ এর মাধ্যমে। মাত্রই আমরা উদযাপন করলাম জাতীয় কবির ১২২তম জন্মদিন। প্রতি বছরের মত এবারও অসংখ্য মানুষ গিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কবির সমাধিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। প্যান্ডেমিকে মানুষের ঢল কমেছে, কিন্তু থামেনি।
যারা ২৫মে কবির সমাধিতে গিয়েছেন এবং যারা যাননি তাদের অনেকের কাছেই নজরুলকে চেনার পরিধিটা এই অতটুকুই। এবারের জন্মদিনে আমার সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধায় সম্বোধন করেছে ‘সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার কবি’ হিসেবে। মোটা দাগে অনেকের কাছে মনে হতে পারে এই বিশেষণগুলো জাতীয় কবির সাথে ঠিক যায় না। তিনিতো বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের নায়ক। অথচ বাস্তবতাটা এই যে নজরুলের যে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, তা সচেতনভাবে ধারণ করতে না পারলে নজরুলকে চেনা কখনই পরিপূর্ণ হতে পারে না।
সেই কবে কোন কাল থেকে চাঁদ রাতে বিটিভিতে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ……’ শুনে শুরু হয়ে আসছে বাঙালির ঈদ উৎসব, আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। ভাবা যায়, ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে……’ এর মত গজল যাঁর লেখা, সেই নজরুলেরই লেখা ‘রক্তাম্বর পরো মা এবার ছিঁড়ে ফেল ঐ শ্বেতবসন, দেখি ঐ করে বাজে মা কেমন বাজে তরবারি ঝনন ঝন……’ বেজে উঠে দুর্গা পুজায় বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে? নজরুল বিদ্রোহী কারণ তিনি বাঙালি আর অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কখনই আপোস করেননি। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে ‘উন্নত মম শীরে’ ধারণ করতে যেয়ে তিনি রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দুর কাছে হয়েছেন নাস্তিক আর রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান তাকে বলেছে কাফের।
নজরুল নিজেও বলেছেন, ‘আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
একইভাবে অভিভক্ত বাংলায় বিশ্বাসী কাজী নজরুল, এমন কি ভারতভাগেরও বিরোধী ছিলেন। এজন্য মহাত্মা গান্ধী কিংবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেউই তাঁর কাছে সমালোচনার বাইরে ছিলেন না। দৈনিক নবযুগের ১৯৪৩-এর ২ নভেম্বরের উপসম্পাদকীয়তে নজরুল লিখেছেন ‘এই স্যুট-প্যান্টধারী জিন্নাহ ভারতের মুসলমানদের নেতা, আর এই হাঁটুর উপর ধুতি তোলা গান্ধী ভারতের হিন্দুদের নেতা – এ কথা ভাবতে দুঃখ লাগে।’ তার লেখা ‘বাঙালির বাঙলা’য় তিনি লিখছেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোট বেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও – এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির – আমাদের। …… বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’ এই ছিল কাজী নজরুলের জীবন দর্শন। তাঁর লেখাতেই আছে, ‘এই গোলমালের মধ্যে কতকগুলি হিন্দু ছেলে আসিয়া গোঁফ দাড়ি কামানো দাঙ্গায় হত খায়রু মিয়াকে হিন্দু মনেকরিয়া ‘বল হরি হরিবোল’ বলিয়া শশ্মানে পুড়াইতে লইয়া গেল এবং কতকগুলি মুসলমান ছেলেগুলী খাইয়া দাড়িওয়ালা সদানন্দ বাবুকে মুসলমান ভাবিয়া, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পড়িতে পড়িতে কবর দিতে নিয়া গেল। মন্দির ও মসজিদ চির খাইয়া উঠিল… …’
যে চার মূলনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ তার অন্যতম স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ প্রবাদপুরুষ কাজী নজরুল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-এ কবি নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তাঁকে সপরিবারে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়, দেয়া হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। বিশাল ক্যানভাসে আঁকা নজরুলের জীবন থেকে ছোট্ট এক টুকরো নজরুলকে এই লেখায় উঠিয়ে আনায় আমার এই যে চেষ্টা, তার কারণ একটাই- এদেশের সারি সারি নজরুল ভক্ত তাঁকে আরো একটু ভালো করে চিনুক-জানুক। মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ যখন জামায়াত-হেফাজতের কালো মেঘে ঢাকা পরে উজ্জ্বল সূর্যালোক, তখন আবারো যে আমাদের ওঠে-দাঁড়িয়ে-লড়ে ফিরে আসা তাতো বঙ্গবন্ধু কিংবা কাজী নজরুলের মত মহামানবদের ভরসাতেই।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।