উন্নয়ন

মাথাপিছু জিডিপির হিসেবে ভারতকে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ : আইএমএফ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: জিডিপির অগ্রগতিতে পাকিস্তানকে আগেই পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। আর চলতি বছরের মধ্যে ভারতকেও পেছনে ফেলতে যাচ্ছে। এমনটাই বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে হতে পারে ১,৮৮৮ ডলার। সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে হতে পারে ১,৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের চেয়ে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ।

এরপর থেকেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে ভারতের অর্থনীতি। কারণ, বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ভারত। বিশ্ব জিডিপিতে ভারতের অংশ যেখানে ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের অংশ মাত্র দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতির আকার ১০ গুণ বড়। তারপরও ভারতকে টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু লিখেছেন, যে কোনও বিকাশমান অর্থনীতির দেশের অগ্রগতির খবর অবশ্যই ভালো। কিন্তু এ খবরটি ভারতের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা। পাঁচ বছর আগেও যে দেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল ভারত, এখন সেই দেশের পেছনে।

আইএমএফ বলছে, ১৯৯০-এর দশকে অর্থনীতি উন্মুক্ত করার পর থেকেই চীনের দ্রুত সম্প্রসারণকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে ভারত। তিন দশক এই লক্ষ্যে চলার পর বাংলাদেশের পেছনে পড়ায় ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। চীনকে মোকাবিলায় কার্যকর অংশীদারত্ব চায় পশ্চিমারা। কিন্তু তারা চায় না সেই অংশীদার ভারত নিম্নমধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ুক। এ বিষয়ে নিম্ন দক্ষতা আত্মবিশ্বাসেও ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

তাহলে ভুলটা হল কোথায়? নিশ্চিতভাবে করোনাভাইরাস এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে নতুন সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছে মধ্য জুনে। কিন্তু দৈনিক শনাক্তের রেকর্ডের পর ভারতে তা কমতে শুরু করেছে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে করোনায় ভারতের চেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে। করোনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৬০০ জনের মতো মারা গেছে। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে আটগুণ বেশি হলেও করোনায় মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। সবচেয়ে ক্ষতি হলো করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে লকডাউন কার্যকর করায় ভারতের প্রবৃদ্ধি ১০.৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে বলে মনে করে আইএমএফ। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার প্রভাবে যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটির তুলনায় এই প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি।

আর্থিক সংকট, পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকা আর্থিক ব্যবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে ভীতি ভারতের কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে আরও বিলম্বিত করবে। আরও খারাপ খবর হল, এমনকি করোনা মহামারি ছাড়াও ভারত হয়তো বাংলাদেশের পেছনে চলে যেত। এই পিছিয়ে পড়ার সম্ভাব্য কারণ উঠে এসেছে পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও ভারতের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ানের একটি নতুন গবেষণায়। তারা এই গবেষণার নাম দিয়েছেন, ইন্ডিয়া’স ইক্সপোর্ট-লেড গ্রোথ: এক্সেমপ্লার অ্যান্ড এক্সেপশন (ভারতের রফতানি-নির্ভর প্রবৃদ্ধি: উদাহরণ ও ব্যতিক্রম)।

প্রথমে ভারতের প্রবৃদ্ধির ব্যতিক্রমবাদ বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশ ভালো করছে কারণ তারা আগের এশীয় টাইগারদের পথ অনুসরণ করছে। স্বল্প-দক্ষতায় উৎপাদিত পণ্য রফতানি দরিদ্র দেশের কর্মক্ষম মানুষের জন্য উপযুক্ত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে একটু এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। কিন্তু দু’টি দেশই চীনের দেখানো পথে রয়েছে। কয়েক দশক ধরে চীন নিজেদের জিডিপি বেশি ধরে রেখেছে নিজেদের শ্রমশক্তির আকার নয়, বরং স্বল্প-দক্ষতার পণ্য উৎপাদনে নিজেদের একাধিপত্যকে বজায় রেখে। কিন্তু ভারত হেঁটেছে অন্য পথে। তারা তাদের কর্মক্ষম ১০০ কোটি মানুষের জন্য কারখানায় চাকরি দিতে সক্ষম এমন পণ্য উৎপাদনে যায়নি। সৌমিত্র ও অরবিন্দ লিখেছেন, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্বল্প-দক্ষতার টেক্সটাইল পোশাক খাতে উৎপাদন ঘাটতি ১৪০ বিলিয়ন ডলার। যা ভারতের জিডিপির ৫ শতাংশ।

যদি ভারতের ২০১৯ সালের কম্পিউটার সফটওয়্যার রপ্তানির অর্ধেক বাতিল হতো তাহলে উন্মোদনা ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু ওই ৬০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি তেমন, যেমন প্রতি বছর স্বল্প-দক্ষতার পণ্য উৎপাদনে হয়। এটিই প্রকৃত অবস্থা কিন্তু কেউ তা নিয়ে কথা বলতে চায় না। নীতিনির্ধারকরা কখনও স্বীকার করতে চান না যে জুতো ও পোশাক কারখানা কখনও গড়ে উঠেনি বা জোর করে বন্ধ করা হয়েছে। এগুলো থেকেও ডলার উপার্জন করা এবং সাধারণের কর্মসংস্থান সম্ভব। এই খাত গ্রাম থেকে নগরে অভিবাসনের স্থায়ী পথ দেখাতে পারে, যা উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দরকার হয় এমন চাকরিতে এতো সহজে সম্ভব না। বাংলাদেশে কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মধ্যে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জন নারী রয়েছেন। এই হার ভারতের চেয়ে দ্বিগুণ। ভারতে এই হার ২১ শতাংশ।

ভারতের জন্য আরও বড় বিপদ হল সঠিকভাবে পদক্ষেপ না নিয়ে রাজনীতিকরা অতীতের ভুল স্বীকার না করে বরং স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যে সমাধান খুঁজতে পারেন।

ভারত কম্পিউটার সফটওয়্যারের মতো প্রচুর উচ্চ-দক্ষতায় উৎপাদিত পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে। চীন এক্ষেত্রে নিম্ন সারির পণ্য উৎপাদনে অন্য দেশকে সুযোগ দিচ্ছে। অথচ ভারতের সুযোগ প্রতিযোগিতামূলক সস্তা শ্রমের মধ্যেই নিহিত। বছর বছর ৮০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রাখলে করোনা পরবর্তীতে এই চ্যালেঞ্জই ভারতের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হওয়ার কথা।

সূত্র: এনডিটিভি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *