পর্যটন ও পরিবেশ

স্বল্প সময়ে মুগ্ধ হতে চলে যান টাঙ্গুয়ার নীল জলরাশিতে

লিমন নন্দী :

পাহাড়, হাওর, বন, ঝর্ণা, টিলা, বাগান এবং নদী সব যে জায়গায় মিশে একাকার তার নাম সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ হচ্ছে সিলেট বিভাগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা আর এই আকর্ষণের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে নীলাভ পানির টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। হাওরের রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো আর তারার মেলায় আপনি হারিয়ে যাবেন কোনো এক অজানায়, আর এই পূর্ণিমা রাতটি হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রাতগুলির মধ্যে একটি।

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরণা) এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির।

২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ (Ramsar site) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন।

শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দা’র ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন। এসময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা —রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়। কান্দাগুলো এখন (২০১২) আর দেখা যায় না বলে স্থানীয় এনজিও ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড।

টাংগুয়ার হাওরের জন্য সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর বাজার-টাংগুয়ার হাওর-টেকেরঘাট এই রাস্তাটি অধিক ব্যবহৃত। তবে আরেকটি বিকল্প রাস্তাও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ইদানীং, সেটি হলো “মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা-মধ্যনগর-টাংগুয়ার হাওর-টেকেরঘাট”। যারা ট্রেনে ভ্রমণ পছন্দ করেন, তারা ময়মনসিংহ এবং ঢাকা থেকে “হাওর এক্সপ্রেস” এবং “মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস” এ দুটি ট্রেনেও করে আসতে পারবেন টাংগুয়ার হাওর ভ্রমণে। এসি, ফার্স্ট ক্লাস, শোভন চেয়ার এগুলো চেয়ার কোচ বাসের চেয়ে নিঃসন্দেহে আরামদায়ক ভ্রমণ করতে পারবেন।

আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট দশ দিন আগ থেকেই পাওয়া যায়। তাই সুবিধামত সময়ে আপনারা টিকিট কেটে ফেলবেন। আর ফেরার জন্য মোহনগঞ্জ স্টেশনে নেমেই সাথে সাথে সেদিন রাত এগারটা ত্রিশের (১১:৩০) ট্রেন ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের’ টিকিট কেটে ফেলবেন। এটি ময়মনসিংহ পৌঁছে রাত আড়াইটায় আর ঢাকা পৌঁছায় সকাল ৬.৩০ এ।

মোহনগঞ্জের ৫ কিলোমিটার দূরে ধর্মপাশা উপজেলা। ব্যাটারিচালিত অটো কিংবা সিএনজি দিয়ে অল্প সময়েই সেখানে পৌঁছে যাবেন। পার হেড ভাড়া ৩০ টাকা বা এর কিছু কম। পৌঁছানোর পর হাওরের নৌকা-ট্রলার ইত্যাদির জন্য আপনাকে পৌঁছাতে হবে ধর্মপাশা উপজেলার “মধ্যনগর বাজারে”। মধ্যনগর, ধর্মপাশা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার ভেতরে, যেখানে সিএনজি রিজার্ভ করে যাওয়াই উত্তম। এক সিএনজি ৩০০-৩৫০ টাকা নেবে। সেখান থেকে পছন্দমত আকারের ট্রলার রিজার্ভ করে রওনা দেবেন টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। প্রায় তিন ঘণ্টার এই জলযাত্রা নিঃসন্দেহে মন-জুড়ানো। আর এটিই হাওর ভ্রমণের মূল আকর্ষণ। চারপাশে পানির মাঝেই ঘরবাড়ি, ইউনিয়ন পরিষদ এসব একটা নতুন ফিল এনে দেবে। ভেনিস শহরের মত নৌকাই এদের ছয় মাসের প্রধান বাহন। অল্প সময় পরে দৃষ্টি-জুড়ে মেঘালয়ের পাহাড় দেখাটা সবচেয়ে সুন্দর দিক।

৮ জনের একটি ট্রলার সারাদিনের জন্য নিলে ভাড়া নেবে ৩০০০-৪০০০ টাকা। এর বেশি চাইলে যাত্রীবাহী লঞ্চে মধ্যনগর বাজার থেকে তাহিরপুর বাজার যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে ফেরার পথে ঝুঁকি আছে। রাতের ট্রলার তাহিরপুর বাজার থেকে ছাড়ে রাত এগারটায়।

মধ্যনগর থেকে হাওরের ভেতর দিয়ে টেকেরঘাট যাওয়ার পর সেখানেই দেখে নিতে পারবেন জাদুকাটা নদী আর নিলাদ্রি নামক দুটি স্পট। সাহস করে ভারতের মাটিতেও এক দু’মিনিটের জন্য পা রেখে আসতে পারেন। টেকেরঘাটেই ভাতের হোটেলে হাওরের মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। কিংবা নিজেরা রান্না জানলে (অথবা নৌকার মাঝিকে বলে) মধ্যনগর বাজার থেকেই মাছ কিনে নিয়ে পোর্টেবল স্টোভে চড়িয়ে দেবেন মাছ ভুনা!

একেবারে বাংলাদেশ বর্ডারে অবস্থিত টেকেরঘাট মূলত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলনের জন্য বিখ্যাত ছিল। ইন্ডিয়ার মেঘালয় ঘেঁষে থাকা কালোপাথর যুক্ত টিলাগুলিও হাইকিং লাভারদের ভালো লাগবে। পাহাড়ের চূড়া থেকে পানিভর্তি টাংগুয়ার হাওরের ভিউ, মহেশখালি পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগরের ভিউ মনে করাতে পারে। সেই সাথে জাদুকাটা নদীর স্টার্টিং পয়েন্টও দেখে নিতে পারেন।

টেকেরঘাটে হাইকিং শেষে খাওয়াদাওয়া করা বেটার। তাই মধ্যনগর বাজার থেকে স্ন্যাকস কিনে নেবেন, মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায়। খাওয়ার পর এলাকাতেই পায়চারি করে আবার ব্যাক করতে শুরু করবেন। সন্ধ্যার দিকে সিএনজি ক্রাইসিস থাকে, তাই যাত্রাপথের সিএনজি চালকের সাথেই আগে আলাপ করে রাখা ভাল। একেবারে মধ্যনগর বাজার থেকে মোহনগঞ্জ স্টেশন চলে আসবেন। সেখানে স্টেশনেই “মনপুরা হোটেলে” খাওয়া দাওয়া করে অপেক্ষা করতে পারবেন ওয়েটিং রুমে। রাতে হাওরে না থাকলে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ব্যাক করাই উত্তম। আর হাওরে থাকলে সেক্ষেত্রে পরদিন সকাল ৮টার হাওর এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে রাখতে হবে।

পরিশেষে, হাওর অঞ্চল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের এলাকা। কক্সবাজার কিংবা সিলেটের মত “বাণিজ্যিক পর্যটন এলাকা” নয় এটি। তাই মানুষজন তুলনামূলক সরলও। তাই মিষ্টভাবে তাদের সাথে দামদর করে রওনা দিন মেঘালয়ের কন্যা টাংগুয়ার হাওর ঘুরে আসতে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *