বিনোদন

তারকা নয়, আমার বড় পরিচয় আমি একজন বাবা

চঞ্চল চৌধুরী :

তারকা নয়, আমার বড় পরিচয়- আমি একজন বাবা, যে বাবা সন্তানের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারে। যশ-খ্যাতি তুচ্ছ হয়ে যায় সন্তানের ভালোবাসার জন্য। আমার একমাত্র ছেলে শৈশব রোদ্দুর শুদ্ধ। ২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিদ্ধেশ্বরীর এক ক্লিনিকে তার জন্ম। চোখে ভাসে ১২ বছর আগের সেই দিনটির কথা, যখন আলো ছড়িয়ে পৃথিবীতে এসেছিল শুদ্ধ। ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আমি প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলাম, সন্তানের জন্মমুহূর্তে। নার্স এসে সন্তানকে আমার কোলে তুলে দিলেন। বাবা হওয়ার আনন্দ তখন ছুঁয়েছিল আমায়; সন্তান কান্না করছে। আমি কোলে নিয়ে তাকে আদর করলাম, বুঝলাম, সে আমার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। তখন বুঝতে পেরেছি- সন্তান মা-বাবার কাছে যতটা ভালো থাকে, অন্য কারও কাছে তা থাকে না। রক্তের সম্পর্ক আস্তে আস্তে দৃঢ় হয়। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা আরও বাড়ে। সন্তানের মঙ্গল-অমঙ্গলের ওপরই নির্ভর করে বাবা-মায়ের ভালো-খারাপ থাকা। শুদ্ধর যদি শরীরটা খারাপ থাকে, তখন আমার রাতে আর ঘুম হয় না। তার হাসিমুখ, যে কোনো প্রাপ্তি আমার ভালো লাগে। তার এখন ১২ বছর চলছে। অনেক কিছু বোঝে। এখন সে আমার কাজ আইডেন্টিফাই করে। ভালো সিনেমা দেখতে পছন্দ করে; আমাকেও দেখতে উৎসাহিত করে। মাঝেমধ্যে আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প-গুজব করি। সে খায় আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। তাতেই বেশ শান্তি। ধীরে ধীরে সে আমার বন্ধু হয়ে যাচ্ছে।

চোখের সামনে প্রতিটি দিন-রাত সে বড় হচ্ছে। শুদ্ধ গান ভীষণ পছন্দ করে। ৯ বছর বয়সে সে আমার সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গেয়েছে। ভিডিওটি ফেসবুকে প্রকাশ করার পর অনেকেই প্রশংসা করেছেন। শুদ্ধ একেবারে ছোট্টবেলা থেকে আমার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। ওর সঙ্গে আমি কণ্ঠ মিলিয়েছি। অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালো লাগা। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের অনুভূতি কিংবা বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের অনুভূতি- এর কোনো তুলনা হয় না। সন্তান যখন বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকে; তাদের মধ্যে যে অভাববোধ হয়, এখন তা ভালোভাবে বুঝি।

অধিকাংশ মা-বাবারই স্বপ্ন থাকে সন্তান যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা সাধারণ চাওয়া। প্রতিষ্ঠিত মানুষ যে কোনোভাবেই হতে পারে। সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক- এটা অনেকেই ভাবেন না। প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানেই মানুষ হওয়া নয়। আমি চাই আমার সন্তান মানবিক গুণাবলি নিয়ে মানুষ হোক। ছেলের যোগ্যতা তাকে কতদূর নিয়ে যাবে- এটা আমি স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। সে কী করবে তা নির্ভর করবে তার মেধার ওপর। তার ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। শুধু বলব, ‘একজন ভালোমানুষ হ বাবা।’ পরিবারের প্রতি, দেশের প্রতি যেন তোর দায় আর ভালোবাসাটুকু থাকে আমৃত্যু। করোনাকালে এখন বাসায় বেশিরভাগ সময় কাটে। ঘরবন্দি থাকার সুবাদে পিতা-পুত্রের মধুর সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে। গত দেড় বছরে ছেলেকে যে সময় দিয়েছি, গত ১০ বছরে তা দিতে পারিনি। শুদ্ধ শিশু থেকে কিশোর হচ্ছে। তার শারীরিক পরিবর্তন ঘটছে। তার যে বয়স চলছে, এই বয়সে মা-বাবাকে তার বেশি দরকার। চেষ্টা করছি সন্তানকে ছায়ার মতো আগলে রাখতে। ‘পিতৃস্নেহে অন্ধ’ কথাটা এখন প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারি। জন্মের পর থেকে এত বছর পর্যন্ত, একসঙ্গে একটানা এতদিন একাত্ম হয়ে অহর্নিশ মিশে থাকা হয়নি, যে সুযোগটা করোনা করে দিয়েছে। জন্মের পর থেকে শুদ্ধ শুধু আমাকে বাবা হিসেবে নয়, পেয়েছে বন্ধু হিসেবে, যা আমরা পাইনি। যখন আমরা বাবাকে বন্ধু হিসেবে পেলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আনন্দ-আবদারের চেয়ে তার সুস্থতা নিয়েই তখন উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছে বেশি। পড়ালেখা, খেলাধুলা, স্কুল, আরও কতকিছু- ছন্দময় একটা সময় ছিল আমাদের সন্তানদের! করোনায় গত দেড় বছরে সেই ছন্দের পতন ঘটেছে। এভাবে বেড়ে ওঠা, পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য কতটা শঙ্কার- সেটা ভেবেও বিচলিত হই। এই দুর্যোগ কেটে যাক। শুদ্ধ স্বাভাবিক সময় পার করে মানুষ হয়ে উঠুক- এটাই প্রার্থনা।

লেখক: অভিনেতা  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *