নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: নীল আকাশের বুকে একরাশ সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে এলো ঋতুরানী শরৎ। শুরু হলো শিউলির মোহনীয় গন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার দিন। শরৎ বাংলা ঋতুর আবর্তনের তৃতীয় ঋতু। ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস শরৎকাল। শরতের কোমল স্নিগ্ধ, শুভ্র রূপের কারণে তাকে ডাকা হয় ঋতুরানী নামে।
শরৎ প্রভাতের শিশির ভেজা কোমল ঘাস আর শিউলি ফুলের সুগন্ধে মন ভেজেনি এমন বাঙলি পাওয়া দুষ্কর। মাথার উপরে নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘের ছোটাছুটি, পায়ের নিচে নরম সবুজ ঘাস, নদী, খালবিল আর দিঘির স্বচ্ছ পানি, কাশবন ছাওয়া তুলতুলে সাদা ফুল যেন অপরূপ রূপে সাজিয়ে তোলে এই ঋতু রানীকে। শরৎকালে বিলেঝিলে ফোটা শাপলা আর পদ্মফুলের শোভা যেন আরো রূপসী করে তোলে প্রকৃতিকে। এসময়ে জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের উজ্জ্বলতা যেন মখমলের পরশবুলিয়ে যায়। জোনাকির মেলা মনকে দিশেহারা করে তোলে। প্রকৃতির এমন কমনীয় রূপ আর অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।
মোহিনী শরৎ তার এই রূপের ছটায় দোলা দিয়েছেন বহু শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকের হৃদয়ে। শরৎ এলেই বেড়ে যায় শিল্পীদের ক্যানভাসে রঙ তুলির খেলা। শরতের রূপ ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।
শরৎকালে নদীর টলটলে জলে ঢেউয়ের তরঙ্গ, আর তার দুধারের সারি সারি কাশফুলের শোভা, ঋতুবতী ধানের ক্ষেতে রোদ্র-ছায়ায় খেলায় মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল প্রায় সব যুগের কবি সাহিত্যিকই মন হারিয়েছেন। শরৎপ্রেমে সিক্ত হয়ে সাজিয়েছেন বহু পংক্তিমালা। শরৎ রূপে মুগ্ধ হয়ে মহাকবি কালীদাস লিখেছেন-
“প্রিয়মত আমার, ঐ চেয়ে দেখ,
নব বধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত”
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগেও শরৎবন্দনায় মেতছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বহু কবি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবিতাসহ তাঁর নানা রচনায় এই ঋতুরানী স্থান দখল করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
“শরতে আজ কোন্ অতিথি
এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়,
আনন্দগান গা রে।
নীল আকাশের নীরব কথা
শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
বেজে উঠুক আজি তোমার
বীণার তারে তারে”।
ঋতুরানীর এতো রূপলাবণ্যের ভিড়েও ভাদ্রের গরম যেন তাঁর এক টুকরো কলঙ্ক। অনেকেই ভাদ্রের এই গরমকে তালপাকা গরম বলে থাকে। তালপাকা গরম আর অবিশ্রান্ত বর্ষণে অস্থির হয়ে প্রবীণেরা ভাদ্রের নাম দিয়েছেন ‘পচা ভাদ্দর’।
প্রকৃতির রানী শরৎকালকে ফুলের ঋতু বললেও ভুল হবে না। শরৎকালের শিউলি, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতীসহ আরো অনেক ফুলই মানব হৃদয়ে ভালোবাসা জাগায়। তাইতো কবি নজরুল গেয়েছেন- “এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে”।
সৌন্দযর্ের পাশাপাশি উৎসবের ঋতুও শরৎকাল। এসময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পুজাসহ, জন্মাষ্টমী, লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে। তাছাড়া চারপাশে চলতে থাকে শরৎ বন্দনায় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রামবাংলায় বধুরা এইসময় নাইওর যায় অর্থাৎ বাবার বাড়িতে যায়, তাই ঘরে ঘরে পড়ে যায় উৎসবের আমেজ।
ভ্রমণপিপাসু আর প্রকৃতিপ্রেমি মানুষের বেড়ানোর জন্য শরৎকাল উত্তম সময়। অনেকেই নৌকার পালে বিলাসী হাওয়া লাগিয়ে নদীর বুকে ভাসতে চলে যান। কেউবা যান শাপলা-পদ্মের বিলে সাপ আর ভোমরের খেলা দেখতে। কেউ বেড়িয়ে পড়েন পাহাড়ের বুক বেয়ে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ছুঁতে।
শরৎকাল প্রকৃতিকে করে তোলে স্নিগ্ধ মনোরম। তার সাথে শরৎ যেমন কবি মনে প্রেম জাগানিয়া ঋতু তেমনি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকের মনে আশা জাগানিয়া ঋতু। ফসল ভরা সবুজ ধানের শীষে চোখ রেখে বাংলার কৃষকেরা আগত নবান্নের স্বপ্ন দেখে।