নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন। কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিস করানোর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সংকট রয়েছে।
চিকিৎসা সুবিধার অভাবে আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমান মোট রোগীর মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। তাছাড়া কিডনি রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা করালে শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তাই কিডনি নিরাপদে রাখতে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। প্রতি বছর কিডনিজনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়েছে উঠেছে। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা খুব সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিসি ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে।
কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি ধূমকেতু ডটকমকে জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাটাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনিতে পাথরের কারণে হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। তবে ভালো খবর হলো এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। এ দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশুদ্ধ খাবার খেতে হবে ও পানি পান করতে হবে। রক্ত ক্ষরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিতে হবে। ইনফেকশন হলে তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হবে।
তিনি আরও জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস খরচ অনেক। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৮শ’ টাকা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে লাগে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য।
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দু’দিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দু’টি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দু’টি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এ ছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দুটি ইনজেকশন দিতে হয়। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে বলে ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। তাই ওই দুটি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা।
কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, পৃথিবীব্যাপী কিডনি রোগের হার অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোনও না কোনও কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয় বহুল বিধায় এ দেশের শতকরা ১০ জন রোগীও এ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অর্থাভাবে অকালে প্রাণ হারান সিংহভাগ রোগী। পক্ষান্তরে, একটু সচেতন হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের উপস্থিতি ও এর কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা।
কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ হারুন অর রশিদ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, দেশে ব্যাপক সংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম মাত্র ৯৬টি এবং ১৮ হাজার হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে ২ বার করে ডায়ালাইসিস পায়। বেসরকারী সেন্টারগুলোতে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিস মূল্য রাখা হয়। তিনি বলেন, সাউথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায় বাকি বিশাল সংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। তাই বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে সরকারী বেসরকারীভাবে বাস্তবিক উদ্যোগ নিতে হবে।