নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: চলছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বসত নির্মাণ। কমেছে অরণ্য। হারিয়ে যাচ্ছে নদী। জলাধার সংকুচিত। ন্যাড়া হচ্ছে পাহাড়। ফলে বনের বৃহৎ প্রাণী হাতির চলাচলের পথ হারিয়ে গেছে। বাসস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। সেসঙ্গে নেই প্রজনন ভূমি। ফলে বড় ধরনের বিপদে পড়েছে হাতি। ঝুঁকি বেড়েছে মানুষেরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতিকে উন্নয়নের সাথী করতে হবে। তার বসতি ও বিচরণ এলাকা রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে। না হলে দেশে কোনো রকমে টিকে থাকা হাতি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রাকৃতিক খাবার সংকট, আবাসস্থলে মানুষের বসবাস বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় বন্যহাতিকে খাবার ও পানির সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ১৮ বছরে দেশে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ৯০টি হাতি। করোনাকালেও ১২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত হাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছে ৪০ জন।
এ পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে হাতি দিবস। হাতির জন্য টেকসই পরিবেশ, তাদের খাদ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দিবসটিকে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
২০১৭ সালে বন বিভাগ এবং আইইউসিএনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের আবাসিক হাতির বিচরণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। দেশের বনাঞ্চলে আবাসিক বন্যহাতি আছে ২৬৮টি। এ ছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩ থেকে ১০৭টি পরিযায়ী হাতির বিচরণ করে।
গবেষণায় ৯টি বিভাগীয় বন অফিসের আওতায় হাতি চলাচলের ১১টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছিল, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫১৮ কিলোমিটার। কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে হাতির বিচরণের পথ দ্রুত কমে আসছে। গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের তিনটি করিডোর। এসব কারণে নিয়মিত চলাচলের পথ ব্যবহার করতে পারছে না হাতি। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ি বনাঞ্চলে ছিল বেশ কিছু হাতি চলাচলের করিডোর। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নষ্ট হয় এগুলো। কক্সবাজারে গত তিন বছরে প্রাণ গেছে সাতটি বন্যহাতির।
তবে বন বিভাগ বলছে, হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর তৈরির কাজ চলছে। এর ফলে গত এক বছর ১৬টি হাতির বাচ্চা প্রসব হয়েছে কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন বনাঞ্চলে। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট একটি হাতির প্রসব হয় টেকনাফের হোয়াইক্যং বনে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, গত দুই অর্থবছরে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৭৪০ একর বনভূমিতে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়নের কাজ হয়েছে। পাশাপাশি নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বেশ কিছু হাতির চলাচলের করিডোর চিহ্নিত হয়েছে। প্রজেক্টটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে হাতি চলাচলের জন্য যে দুটি পথ রয়েছে তার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত পথটি অন্যতম। কিন্তু হাতি চলাচলের শতবর্ষ প্রাচীন এই পথের ওপর গত কয়েক বছরে শত শত রাবার বাগান, লোকালয়, বাণিজ্যিক বন বাগান গড়ে ওঠায় প্রতি বছরই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি, জারুল্যাছড়ি, লেম্বুবছড়িসহ আশপাশের এলাকায় হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটিকে হাতির জন্য আরেকটি বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। রেলপথটি গেছে বন্যহাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্র চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। এই প্রকল্পে পড়েছে হাতি পারাপারের অন্তত ২১টি পথ।
‘সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি এ এন এম মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ইকো সিস্টেম ধ্বংস করে উন্নয়ন করা যাবে না। হাতির চলাচলের পথ ঠিক রেখেই উন্নয়ন করতে হবে। সরকার বা বন প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু বা দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে হাতি হত্যার সাজা হিসেবে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ৭ বছরের সাজার বিধান থাকলেও এই আইনে কারও সাজা হয়েছে বলে জানা নেই।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল তৈরি এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে হাতির আবাসস্থল বিনষ্ট ও বিভক্ত হয়েছে। ফলে বন্যহাতি পথভ্রষ্ট হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে মানুষের হাতে মারা যাচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ময়নাতদন্ত করে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। বন্যহাতি হত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি জোরদার করা হবে।
আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন বলেন, বাংলাদেশে হাতির সুরক্ষার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা দরকার। তাদের বসতি ও বিচরণ এলাকা রক্ষা করতে হবে। নয়তো দেশে টিকে থাকা হাতি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে।
প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে হাতির চলাচলের পথ সুরক্ষিত রেখেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়। একটি রাস্তা করতে হলে যে পথে হাতি চলাচল করে, তার নিচ দিয়ে চলাচলের রাস্তা অক্ষত রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা একেবারেই উপেক্ষিত। হাতি ও মানুষের সহাবস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের পরিকল্পনা করা দরকার।