নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অবস্থান ইতিবাচক। তবে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে নতুন আইন পাস করার মতো সময় নেই। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি করে নতুন একটি আইনি কাঠামো তৈরির কথা জানিয়েছেন একাধিক নেতা।
কয়েকজন নেতা বলেন, তারাও নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানোর পক্ষে। অস্থায়ী ভিত্তিতে ইসি নিয়োগ ব্যবস্থার পরিবর্তন তারাও চান। সময়ের কারণে সংসদে নতুন আইন পাস সম্ভব না হলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব হতে পারে।
সংশ্নিষ্টরা অবশ্য বলছেন, নতুন ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় এখনও হাতে এক মাসের বেশি সময় রয়েছে। এর তুলনায় কম সময়ের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের নজির দেশে রয়েছে। জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা সবচেয়ে বড় বিষয়। অধ্যাদেশ জারি করে পরে সংসদে আইন পাস করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তারা।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলছেন, সরকার নতুন আইন প্রণয়নের পক্ষে। তবে এখন হাতে সময় কম। এত কম সময়ের মধ্যে নতুন আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান গত রাতে বলেন, ইসি গঠনে নতুন আইনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক। তবে এত কম সময়ের মধ্যে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
তিনি জানান, দলীয় প্রধান এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। বিশেষজ্ঞরাও মত দিয়েছেন, হাতে সময় কম। তবে অধ্যাদেশ জারির পরামর্শ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সার্চ কমিটি গঠনও রাষ্ট্রপতি করছেন। আবার অধ্যাদেশও রাষ্ট্রপতি জারি করবেন। এখানে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে তিনি মনে করেন না।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ইসি গঠনে আইন থাকবে। ওই আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার কমিশনারকে নিয়োগ করবেন। কিন্তু ৪৯ বছরে আইন না হওয়ায় গত দু’বার সার্চ কমিটির মাধ্যমে কাজী রকিব উদ্দীন এবং কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি গঠন করা হয়। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলো।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নতুন বছরের (শীতকালীন) সংসদ অধিবেশন বসে। এতে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন এবং তার ভাষণে ধন্যবাদ প্রস্তাব জানাতে অধিবেশনজুড়ে আলোচনায় অংশ নেন সদস্যরা। বছরের শুরুর এই অধিবেশন অনেক দীর্ঘ হয়। তবে এবারের অধিবেশনের মেয়াদ অনেক ছোট হবে। তাই এবারের অধিবেশন দ্বিতীয় সপ্তাহে বা তার পরে বসবে। গত ২৮ নভেম্বর সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন শেষ হয়। এক অধিবেশনের পরে আরেক অধিবেশনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের বেশি বিরতি দেওয়ার সুযোগ নেই। সে হিসাবে ২৮ জানুয়ারির মধ্যেই নতুন অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, একটা নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে সবার আগে মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন নিতে হয়। তারপর বিল আকারে সংসদের বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেটি পূর্ণাঙ্গ আইনে রূপ নেয়।
তিনি বলেন, একটি নতুন আইন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সংসদের কত সময়ের প্রয়োজন, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিতে না পাঠিয়েও বিল পাসের নজির রয়েছে। সর্বশেষ অধিবেশনে বিচারপতিদের ভ্রমণ ভাতা-সংক্রান্ত একটি বিল কমিটিতে না পাঠিয়ে পাস হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট করে সময় বলা সম্ভব নয়।
নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে নতুন আইন প্রক্রিয়ায় বাধা কোথায়- এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুজ্জামান বলেন, সরকারের নির্বাহী বিভাগের বিষয়ে আইনসভার সদস্যদের মন্তব্য করা কঠিন।
এ কমিটির সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী মনে করেন, সময় কোনো বাধা নয়। সরকারের সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার আইন চাইলে সংসদ অধিবেশন কখন ডাকা হবে, সেটাও জরুরি নয়। কারণ, এর আগে করোনাকাল বিবেচনায় ভার্চুয়াল কোর্ট আইনটি প্রথমে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। পরে তা সংসদের মাধ্যমে আইনে রূপান্তর হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় ইসি গঠনের আইনটিও অধ্যাদেশ আকারে আসতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে আইনে রূপান্তরিত হবে।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইসি গঠন হচ্ছে অস্থায়ী প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে। নতুন আইনে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসবে।
একই কমিটির সদস্য ও বিএনপিদলীয় সংরক্ষিত আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, এখন যে সময় রয়েছে, তার মধ্যে অবশ্যই আইন করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব দ্রুত আইন পাসের অনেক নজির রয়েছে।
তবে রুমিন ফারহানা বলেন, নতুন একটি আইন দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, সরকার যখন তার পছন্দের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে, তখন তার ইচ্ছার বাইরে ইসির পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, সেটা নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার নজির নেই।
সাবেক সিইসি ড. শামসুল হুদা কমিশনের সময় নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের উদাহরণ তুলে ধরে রুমিন ফারহানা বলেন, তখন ইসি থেকে নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিলেও সরকার তাতে রাজি হয়নি। আইনে যত কিছুই লেখা থাকুক, সরকার না চাইলে কিছুই হয় না।
গত দুই মেয়াদে নতুন ইসি গঠন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এবারও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ বা মতবিনিময় চলছে। ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সংলাপে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ১৩টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ছয়টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। প্রায় সব দলই ইসি গঠনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অংশ হিসেবে নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরীকত ফেডারেশনের নেতারা সংলাপ শেষে জানিয়েছেন, স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও চান নতুন আইন।
গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘যদিও আইনমন্ত্রী বলছেন- আইন প্রণয়নের যথেষ্ট সময় নেই, তবে পার্লামেন্টেই উদাহরণ আছে এর চেয়েও কম সময়ে আইন প্রণয়নের। এমনকি সংবিধানও সংশোধন হয়েছে।’
এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ শেষে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এমপি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি তাদের বলেছেন, আমি নিজেই সংবিধানের মানুষ। যেহেতু সংবিধানে আছে, একবার আইন হয়ে গেলে আর প্রশ্নের উদ্রেক হবে না।’ তরীকত চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি নিজেও চান দ্রুত আইন হোক।
এর আগে ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে ড. শামসুল হুদা কমিশনের পক্ষ থেকে ইসি গঠনে সংবিধান অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের জন্য খসড়া প্রকাশ করা হয়েছিল। পরে সেটা সরকারের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল। সর্বশেষ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ১৮ নভেম্বর আইনমন্ত্রীর হাতে ইসি নিয়োগে আইনের প্রস্তাবিত খসড়া তুলে ধরা হয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রস্তাবনা আইনমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও আইন প্রণয়নের কাজটি এড়িয়ে চলা হচ্ছে। এটি রহস্যজনক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি নতুন আইন হলেই সবকিছু সরকারের হাতের বাইরে চলে যাবে না। আইন করেও তারা ইসি গঠনে কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রাখতে পারে। তবে সরকার কেন আইন প্রণয়নে আগ্রহী নয়, তা বোঝা মুশকিল।
আরো পড়ুন:
ইসি গঠনে ওয়ার্কার্স পার্টির ৬ প্রস্তাব