তাপস হালদার :
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন মূলত ক্রিকেট নির্ভর।আন্তর্জাতিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনের যা কিছু অর্জন তার সবকিছু এসেছে ক্রিকেট থেকে। সঙ্গত কারণে ক্রিকেটকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয় ফুটবল কিংবা অন্য খেলাগুলোতে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। সদ্য সমাপ্ত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও পাকিস্তানের সাথে সিরিজে বাংলাদেশের পারফরমেন্সে ক্রীড়ামোদী বাঙালিরা খুবই আশাহত হয়েছিল। কিন্তু বাংলার বাঘিনীদের বিজয়ে বিজয়ের মাসে এক নতুন আনন্দে ভাসছে দেশ।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ফুটবলে কোনও ধূমকেতু নেই।এক সময়ের প্রবল জনপ্রিয় খেলাটি একপ্রকার হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু ফুটবলে আশার আলো জাগিয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা।গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মাঠে চমক দেখালো বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব -১৯ নারী ফুটবল দল।বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে শক্তিশালী ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে পরাজিত করে শিরোপা অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের মেয়েরা শুধু ফাইলানেই নয় পুরো টুর্নামেন্টেই দাপট দেখিয়াছে। পুরো টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষের জালে ২০টি গোল দিলেও নিজেরদের একটিও হজম করতে হয়নি। তাদের এই অসামান্য নৈপুণ্যই ষ্টেডিয়ামে দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিলো।গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বহুদিন পর ফুটবলে বাংলাদেশ দল দর্শকদের বিজয় উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। বিজয়ের মাসে ফাইনাল দেখতে গ্যালারি উপচে পড়ে দর্শক। হাজার হাজার দর্শকের হাতে ছিল লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। কণ্ঠে ছিল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চিৎকার।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে নারীদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সাফ অনুর্ধ্ব-১৯ ফুটবল। আগের লড়াইয়ে নেপালকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল বাংলাদেশই। সেবার অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল। নাম বদলে এবার সেই টুর্নামেন্টই অনুর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপ।
রাউন্ড রবিন লীগ পর্বে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে নেপালের সঙ্গে গোলশুন্য ড্র করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করলেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভুটানকে ৬-০ গোলে, শক্তিশালী ভারতকে ১-০ গোলে এবং লীগ পর্বের শেষ ম্যাচে শ্রীলংকাকে ১২-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে গ্রুপ সেরা হিসেবে ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলার বাঘিনীরা। ফাইনালে ভারতকে আবারও ১-০ গোলে পরাজিত করে শিরোপা দখল করে নেয়।
বাংলাদেশ নারী জাতীয় দল ভারতের বিপক্ষে কখনোই জয় লাভ করে নি। কিন্তু বয়সভিত্তিক ফুটবলে ভিন্ন চেহারার বাংলাদেশ। এই ম্যাচের আগে যে নয়বার বিভিন্ন বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ভারতের মুখোমুখি হয়েছে, এর পাঁচবারই জিতেছে বাংলাদেশ। ৩টি ম্যাচ ড্র। একবার হার বাংলাদেশের। ২০১৭ সালেও এই কমলাপুর স্টেডিয়ামে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ।
এখনও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে নারী হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত । গ্রামের মেয়ে বা নারীরা ফুটবল খেলবে, সেটি এখনও চিন্তাও করা যায়না।অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই তাকে এগিয়ে আসতে হয়। পরিবারের ছেলে সন্তানটির জন্য যে ব্যবস্থা থাকে, পরিবারের মেয়ে সন্তানটির জন্য একই ব্যবস্থা থাকে না। মেয়েদেরকে ছোট বেলা থেকেই পরিবার থেকে বলা হয় এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। মানসিক ভাবেই দুর্বল করে রাখা হয়।
এখনও একজন নারীকে সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে দেখতেই বেশি অভ্যস্ত সমাজ! অস্বীকার করার উপায় নেই একজন মেয়েকে ছেলের সমকক্ষ হিসেবে দেখার পরিপূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজে এখনো তৈরি হয় নি। আসলে ছোট বেলা থেকেই মেয়েদেরকে এমন সব খেলায় অভ্যস্ত করা হয়, যেগুলোতে মেয়েদের শারীরিক শক্তির প্রয়োগ কম হয়, আর দিনের পর দিন শারীরিক ও পেশী শক্তির খেলায় অনভ্যস্থতার কারণে তারা একসময় নিজেরাই নিজেদেরকে দুর্বল ভাবতে শুরু করে। এসব থেকে উত্তরণের সময় এসেছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাতে হবে।নারীদেরকেও প্রতিরোধের বেড়াজাল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বছরের পর বছর নেই কোনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বর্তমানে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৬। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানির দিকে। অনূর্ধ্ব -১৯ নারীরা দেখিয়ে দিল, তাদেরকে সঠিকভাবে সুযোগ সুবিধা দিলে তারাও বাংলাদেশ ফুটবলকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবে।
বাংলাদেশে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল হোক একজন প্লেয়ারকে বোর্ড কিংবা সরকার প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেয়।দেয়াটাও স্বাভাবিক, তারা আমাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে, দেশের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। কিন্তু এখনও সেভাবে মেয়েদের খেলার পিছনে বিনিয়োগ করা হয় না।বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব -১৯ নারী ফুটবল দলের মেয়েরা অধিকাংশই সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদেরকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই এখানে আসতে হয়েছে।রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পরিবারকে আর্থিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যত প্রজন্ম ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ক্রীড়া বান্ধব প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি খেলোয়াড়দের কাছে তিনি মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।ক্রীড়া মন্ত্রনালয় ও ফুটবল ফেডারেশনকে শুধু উদ্যোগটা নিতে হবে। সাফ অনূর্ধ্ব -১৫ বিজয়ের পর এই খেলোয়াড়দের লোকাল বাসে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল।দেশের প্রতিটি মানুষ বোর্ড কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছিল। এরা বাংলাদেশের জাতীয় বীর তাদের সেভাবেই সম্মান জানোনো দরকার।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীর এই বিজয়ের মাসে নারী ফুটবলারদের শিরোপা অর্জন নিঃসন্দেহে আমাদের বিজয়র আনন্দে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এটি বাংলার বাঘিনীদের বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয়। বাংলার বীর বাঘিনীদের স্যালুট, অভিনন্দন।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা। ইমেইল:haldertapas80@gmail.com
আরো পড়ুন: