স্বাস্থ্য

নীরব ঘাতক এইডস প্রতিরোধে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পরামর্শ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: নীরব ঘাতক এইচআইভি প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভয়াবহ হয়ে উঠছে এইচআইভি সংক্রমণের হার। দৃশ্যমান অবস্থা সহনীয় পর্যায়ে, কম মনে হলেও আশঙ্কামুক্ত নয়। দেশে দ্রুত হারে এইচআইভি সংক্রমণের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বিদ্যমান। সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা না গেলে সংক্রমণের এই হার ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। গোপনে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এইডস রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। বিশ্বে প্রায় চার কোটি মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। আর বাংলাদেশে ২০২০ সাল পর্যন্ত এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, এইচআইভি হচ্ছে এক ধরনের ভাইরাস। এইচআইভি এর পূর্ণ রূপ হলো ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’। এটি মানব প্রতিরক্ষা অভাব সৃষ্টিকারী ভাইরাস ‘লেন্টিভাইরাস‘ গোত্রের অন্তর্গত এক ধরনের ভাইরাস, যার সংক্রমণে মানবদেহে এইডস রোগের সৃষ্টি হয়। এইচআইভি নিজে একটি রোগ নয় এবং এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করা মাত্রই এইডস হয় না। একজন এইচআইভি ব্যক্তি এইডস হওয়ার আগে বহু বছর সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবজনিত ক্যান্সারসহ নানা সুযোগসন্ধানী রোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই ভাইরাস মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বদা এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্রবিশেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এরপর বহুদিন কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি যেমন যক্ষ্মায় যেমন আক্রান্ত হতে পারেন, তেমনই সুযোগসন্ধানী সংক্রামক ব্যাধি এবং টিউমারের শিকার হতে পারেন, যেগুলি কেবলমাত্র সেসব লোকেরই হয়, যাদের দেহের  রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করে না। এইচআইভি সংক্রমণের এই পর্যায়টিকেই এইডস বলা হয়।

এই পর্যায়ে প্রায়শই রোগীর অনিচ্ছাকৃতভাবে ও অত্যধিক পরিমাণে ওজন হ্রাস পায়। যেহেতু একবার সংক্রামক এইচআইভি শরীরে ঢুকলে তাকে পুরোপুরি দূর করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই এইচআইভি সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। তবে বিনা চিকিৎসায় এইডস পর্যায়ে পৌঁছতে যদি গড়ে দশ বছর লাগে, তবে চিকিৎসার দ্বারা তাকে আরো কিছু বছর পিছিয়ে দেওয়া যায়।

ইউনিসেফ এর প্রতিবেদন :

এইডসে সংক্রমিত হওয়ার এর কারণ এবং তা থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে  জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ  এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ যারা সাধারণত ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে মাদক গ্রহণ করেন, এ জন্য এইডস ভাইরাস বেশি তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। একই সিরিঞ্জ একাধিক জনে ব্যবহার করলে এইচআইভি হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি আছে। এটা দ্রুত দেহে ছড়িয়ে পড়ে।

যৌন মিলন:  এইডস ভাইরাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌন মিলন। এইডস থেকে বাঁচতে নিরাপদ যৌন মিলনের বিকল্প নেই। অপরিচিত কারো সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত না হওয়াই এ থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়।

এইচআইভি ভাইরাসের রক্ত গ্রহণ:  এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যদি কেউ শরীরে গ্রহণ করে তবে তারও এইডস হতে পারে। তাই শরীরে রক্ত গ্রহণের আগে অবশ্যই তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।

একাধিক যৌনসঙ্গী: একাধিক অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মিলন এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এ ধরনের যৌন মিলন থেকে দূরে থাকতে হবে।

সুঁচ ব্যবহার:  একই সুঁচ একাধিক ব্যক্তির শরীরে ব্যবহার করলে এইডস হতে পারে। এ জন্য প্রত্যেকবার নতুন সুঁচ ব্যবহার আবশ্যক।

সংক্রমিত মা থেকে ছড়ায় এইডস: কোনো মায়ের দেহে যদি এইচআইভি সংক্রমণ হয়ে থাকে তবে তার গর্ভের সন্তানের এইডস হতে পারে। এছাড়া জন্মের পরে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে এই সংক্রমণ ঘটে।

এইডস এর লক্ষণসমূহ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর শুরুর কয়েকটি সপ্তাহের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাব দেখা দিতে পারে, হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীরে র‍্যাশ দেখা দিতে পারে।  অন্যান্য লক্ষণগুলো দেখা দেবে যখন ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করাই এইচআইভির মুল বিপদ। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকলে কাশি, ডাইরিয়া, লিম্ফ নোড বা চামড়ার নিচে ফুলে যাওয়া গোটার মতো দেখা দেবে, ওজন কমে যাবে। কোনও লক্ষণ দেখা না দিলে এইচআইভি আক্রান্ত নন এটিও ভুল ধারণা। এই জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার পরও একজন ব্যক্তির শরীরে দীর্ঘদিন কোন রকমের লক্ষণ দেখা নাও দিতে পারে।

ভুল ধারণা :

বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইডস  কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। একই বাতাসে নিশ্বাস নিলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে, একই পাত্রে খাবার খেলে, পানি খেলে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সামগ্রী ব্যবহার করলে, তার ব্যবহৃত টয়লেট ব্যবহার করলে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ে যদি অন্যকে কামড়ায় তাহলেও এটি ছড়াতে পারে সেটি ভুল ধারনা। যৌন মিলনের পর স্নান করলে এইচআইভি ভাইরাস পরিষ্কার হয় এই ধারনাও একেবারেই ভুল। ত্বকের স্পর্শ বা মুখের লালায় এটি ছড়ায় না। যদিও রক্ত দ্বারা এই ভাইরাস ছড়ায় কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মশা বা রক্ত খায় এমন কিট দ্বারা আপনি আক্রান্ত হবেন না।  তার দুটি কারণ। একটি হল- একজনের শরীর থেকে রক্ত খেয়ে এটি সেই রক্ত দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির শরীরে ইনজেকশন দেয়ার মতো করে রক্ত ঢুকিয়ে দেয় না। আর মশা বা অন্য কিটের শরীরে এই জীবাণু খুব সামান্য সময় বেঁচে থাকে।

আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ওরাল সেক্স অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এইচআইভি পজিটিভ নারী বা পুরুষের সাথে ওরাল সেক্সের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু এর হার খুব বিরল। কনডম ব্যবহার করলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার কোনই সম্ভাবনা থাকে না এমন ধারনাও ঠিক নয়। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌন মিলনের সময়ে কনডম ফুটো হয়ে গেলে বিপদে পড়তে পারেন। আক্রান্ত প্রতি চারজনের একজন ব্যক্তি সে আক্রান্ত কিনা সেটি জানে না। তাই ইদানীং এর প্রতিরোধ বিষয়ক প্রচারণায় শুধু কনডম ব্যবহারে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে তা নয়, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হচ্ছে।

কোনও লক্ষণ দেখা না দিলে এইচআইভি আক্রান্ত নন এটিও ভুল ধারণা।  এই জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার পরও একজন ব্যক্তির শরীরে দীর্ঘ দিন কোনও রকমের লক্ষণ দেখা নাও দিতে পারে। এভাবে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি দশ থেকে পনেরো বছরও বেঁচে থাকতে পারেন। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর শুরুর কয়েকটি সপ্তাহের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাব দেখা দিতে পারে, হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীরে র‍্যাশ দেখা দিতে পারে। অন্যান্য লক্ষণগুলো দেখা দেবে যখন ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে বলে বিবিসি’র প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি :

বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো এইচআইভি এইডস ভাইরাসে সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। বর্তমানে দেশে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে চিকিৎসার আওতায় এসেছে মাত্র আট হাজার ৩৩ জন। ২০২০ সালে দেশে নতুনভাবে এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে ৬৫৮ জনের শরীরে। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ পুরুষ ও নারী ২১ শতাংশ ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী তিন শতাংশ। ২০২০ সালে ১২৪ জন রোহিঙ্গার শরীরে এইডসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রাম সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

আরো পড়ুন:

স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *