ব্যক্তিত্ব

“জনতার বীরশ্রেষ্ঠ” জগৎজ্যোতি দাস

নবনীতা দত্ত তিথি :

জগৎজ্যোতি দাস, ডাকনাম শ্যামা, মুক্তিযুদ্ধে যাঁর “দাস পার্টি” ছিল ত্রাসের অপর নাম পাকবাহিনীর কাছে। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যিনি ছিলেন অনুপ্রেরণা।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারে ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল জন্ম নেন শ্যামা। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। তারপর ভর্তি হন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।

যুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতাকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে যোগ দেন তিনি। যুদ্ধের রণকৌশল রপ্ত করতে ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যান মেঘালয়ে। প্রায় ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ পর্বের মধ্যে ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডিউটি সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

নেতৃত্বের গুণাবলী থাকায় ৩৬ জন সাহসী যুবক নিয়ে গড়ে তোলেন “দাস পার্টি”। দাস পার্টির সহ-অধিনায়ক ছিলেন ইলিয়াছ।

জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধের অন্যতম সাথী আবদুল কাইয়ুমের বয়ানে জানা যায়, “দাস পার্টি নামটি জনগণের দেয়া নাম নয়, দাস পার্টির অফিসিয়াল দলিল ছিল এবং পার্টি কমান্ডার হিসেবে জগৎজ্যোতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।”

মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে প্রাণবাজি রেখে লড়ে যান দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।

শুধুমাত্র তাঁর সাহসী অভিযানের কারণে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, “এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না”। মাত্র ১৩ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচংয়ে পাক বাহিনীর ২৫০ সেনা ও দোসরদের অগ্রগতি রোধ করে দেন, যুদ্ধে প্রাণ হারায় পাক বাহিনীর ৩৫ জল্লাদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আল বদরদের কাছে জগৎজ্যোতি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বিশাল ভাটিবাংলায় পাক বাহিনীকে পরাভূত করতে দাবড়ে বেড়িয়েছেন তিনি।

জামালপুর মুক্ত করার অভিযানে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন জগৎজ্যোতি, হারাতে হয় তাঁর সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমকে। মাত্র ১০-১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি মুক্ত করেন শ্রীপুর। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুদের বার্জ। আগস্ট মাসে কোনো গুলি করা ছাড়াই দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে আটক করেন দশ সদস্যের রাজাকারের দলকে, যারা এলাকায় নির্যাতন চালাচ্ছিলো- খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিলো।

রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন পাক হায়েনাদের দোসর রাজাকারদের। ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জ থানা ও নৌবন্দর সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন জগৎজ্যোতি। স্বাধীন বাংলা বেতারে তার বীরত্বগাঁথা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রণকৌশল আর কূটচালে তাকে মূল টার্গেট করা হয়। সুযোগের সন্ধানে থাকে পাক-দোসর রাজাকাররা।

জ্যোতির নেতৃত্বে সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের বদলপুর ব্রিজ বিধ্বস্ত করা হয়। আর তাঁরই কৃতিত্বের কারণে দাস কোম্পানির যোদ্ধারা ভারতীয় কমান্ড বাহিনীর মেজর জিএস ভাটের প্রশংসা পায়। ১৭ আগস্ট পাহাড়পুরে কমান্ডার জগৎজ্যোতির রণকৌশল আর বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ নর-নারী। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তার বীরত্বগাথা প্রচার হয়। জগৎজ্যোতি একা হাতে একটি এলএমজি নিয়ে দখল করে নেন জামালপুর থানা যেখানে আস্তানা গেড়েছিল স্থানীয় পাকিস্তানি হায়নাদের দোসর রাজাকারেরা।

১৬ নভেম্বর, ১৯৭১। জগৎজ্যোতি জানতেন না এই দিনে তাঁর অন্তিম অভিযান পরিচালিত হবে। জগৎজ্যোতি ও তাঁর সঙ্গীদের লক্ষ্যস্থল ছিল বাহুবল মতান্তরে বানিয়াচং। কিন্তু লক্ষ্যস্থলে যাবার আগেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে ৩-৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছিল। দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হটতে থাকে কৌশলী রাজাকাররা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জগৎজ্যোতি, ভাবতেও পারেননি কী ফাঁদ তাঁর সামনে। সঙ্গী ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন রাজাকারদের। অদূরেই কুচক্রী পাকসেনাদের বিশাল বহর আর প্রচুর সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তারা।

অজান্তেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন জগৎজ্যোতি। আগে থেকে প্রস্তুত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিশাল বহরের ফাঁদে পড়ে যান জগৎজ্যোতি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। বর্তমানে শাল্লা উপজেলা সদর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থানায় পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ”দাস পার্টি”।

রণাঙ্গনে পরিস্থিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তাঁর দলকে বাঁচানোর জন্য রিট্রিট করার নির্দেশ দিয়ে একটিমাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে কাভারিং ফায়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন জীবন বাঁচিয়ে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার। এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন- জ্যোতি ও ইলিয়াছ।

তারা যুদ্ধ করতে থাকেন একটানা, কিন্তু হঠাৎ সহযোদ্ধা ইলিয়াস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দেন, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিকেলে জগৎজ্যোতি দাস নতুন ম্যাগজিন লোড করে পজিশন নিয়ে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই একটি বুলেট তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়। জগৎজ্যোতি তখন ‘আমি আর নাই, আমি গেলাম’ বলে কৈয়ারবিলের পানিতে ডুবে যান।

লোকমুখে শোনা যায়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অত্যাচার করতে করতে। তাঁর গায়ে পেরেক বিদ্ধ করে সেই ছবি খবরে ছাপানো হয়। আজমিরিগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তাঁর লাশ। তখন ছিল ঈদের বাজার। শত শত লোকের সামনে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তাঁর লাশকে।

রাজাকাররা থুতু ফেলতে থাকে তার উপর। এমনকি জগৎজ্যোতির মা-বাবাকেও ধরে আনা হয় বিভৎস লাশ দেখাতে। পরিবারে যখন স্বজন হারানোর কান্নার রোল তখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় জগৎজ্যোতির বাড়িতে। রাজাকারেরা ফটোগ্রাফার এনে ছবি তুলে রাখে জগৎজ্যোতির মৃতদেহের। ২৩ বছর বয়সী জগৎজ্যোতি পাকিস্তানিদের এতবড় ত্রাস ছিলেন যে তাঁর মৃতদেহের ছবি তুলতে হয়েছিল রাজাকারদের..

সারাদিন সীমাহীন অত্যাচারের পর ভাসিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভেড়ামোহনার জলে।

যুদ্ধক্ষেত্রে জ্যোতির শহীদ হবার সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। সেই সাথে তাঁর বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন:

“বীরগতিপ্রাপ্ত জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল একাধিকবার এবং তার বীরত্বগাঁথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাঁথা। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসেন বাংলাদেশ সরকার, কোন এক অজ্ঞাত কারণে। ১৯৭২ সালে জগৎজ্যোতিকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়।”

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় হবিগঞ্জের আরেক অকুতোভয় যোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদীর কথা। হবিগঞ্জ জেলার এই তরুণ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্ত বীরপ্রতীক খেতাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় দৈনিকে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ৪নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ছিল জালালপুর সাবসেক্টর। ১৯৭২ সালে খেতাব ঘোষিত হওয়ার পরই তিনি খেতাব প্রত্যাখ্যান করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। যদিও সে বিবৃতি ছাপা হয়নি সে সময়। ১৯৯২ সালে ২৩তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদক বিতরণ করলে, তিনি তা গ্রহণ করেননি।

এই বিষয়ে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সাদী বলেন,

“বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেয়েছেন যে সাতজন, তাঁদের সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাহলে কি সামরিক বাহিনীর সদস্যের বাইরে অন্য একজনও মুক্তিযুদ্ধে এমন মাত্রার বীরত্ব প্রদর্শন করেননি? আমি নিজে অন্তত তিনজনের কথা জানি, যাঁদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত বলে মনে করি। এরা হলেন আমার সাব-সেক্টরের দ্বিতীয় কমান্ডার শহীদ নিজাম উদ্দিন বীরউত্তম, তাঁর গাইড রফিক বীরপ্রতীক ও ৫নং সেক্টরের জগৎজ্যোতি দাস।’

সাদী সেই সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা বিভিন্ন পদক পেয়েছেন, তাঁদের বীরত্ব ও অবদানকে খাটো করি না। কিন্তু অন্য যারা আরও বেশি বীরত্ব ও অবদান রেখেও যথাযথ মূল্যায়ন পাননি, তাঁদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি খেতাব ও পদক বর্জন করি।’

বাংলাদেশ জগৎজ্যোতিকে দেওয়া তার কথা রাখেনি। এটা অবিচারেরই নামান্তর এই মহান মুক্তিযোদ্ধার সাথে!!

গ্যালিলিওর প্রতি করা অবিচারের জন্য ভ্যাটিকান চার্চ ক্ষমা চেয়েছিল তাঁর মৃত্যুর সাড়ে চারশ বছর পর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর এত বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তাই স্বাধীনতার এত বছর পর হলেও আমরা, সাধারণ জনগণ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ অনুরোধ রাখি বাংলাদেশ সরকার যেন এই মহান বীরের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করে তাঁর যোগ্য মর্যাদায় তাঁকে ভূষিত করে। তাঁকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁর সেই “বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব”, যে মর্যাদার যোগ্য তিনি।

আরো পড়ুন:

মালদ্বীপের শীর্ষ শত ব্যবসায়ীর তালিকায় স্থান পেলেন বাংলাদেশি মোত্তাকী

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *