নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: ফুসফুস ও শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ হলো নিউমোনিয়া। করোনা ও নিউমোনিয়ায় একসঙ্গে আক্রান্ত হলে রোগীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম কঠিন হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তারা বলছেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। তবে শীত মৌসুমে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। চলছে করোনার মহামারী। শুরু হয়ে গেছে শীতের আবহ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। তাই নিউমোনিয়ার কারণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকজুড়ে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ লাখের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ। রোগটি বাংলাদেশে শিশুদের অন্যতম বড় ঘাতক, যার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, ফুসফুসে স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া কিংবা শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) সংক্রমণ ঘটালে ফুসফুস ফুলে ওঠে, ভরে ওঠে পুঁজে বা তরল পদার্থে, যা অক্সিজেন গ্রহণ করে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তখন ফুসফুসে প্রদাহ হয়। সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং টিবি’র জীবাণুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া রোগ হয়ে থাকে।
নিউমোনিয়া মৃদু বা হালকা এবং কখন কখনও জীবন হানিকরও হতে পারে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের, যারা দীর্ঘদিন রোগে ভুগছেন অথবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা কম তাদের মধ্যে নিউমোনিয়া বেশী দেখা যায়। তবে তরুণ, অল্প বয়স্ক, স্বাস্থ্যবান লোকদেরও নিউমোনিয়া হতে পারে। শীতকালে বাচ্চাদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে যায়। তবে নিউমোনিয়া সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্যে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। সঠিক চিকিৎসা নিলে বেশির ভাগ রোগীই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।
নিউমোনিয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ধূমকেতু বাংলাকে জানান, নিউমোনিয়া রোগীর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে জ্বর থাকতে পারে। সবুজ, হলুদ বা রক্তযুক্ত কফ বের হতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্লান্তিবোধ, ক্ষুধামান্দ্য ও বুকে তীব্র ব্যথা দেখা দেয়। দ্রুত শ্বাস ও হৃৎস্পন্দনের কারণে ঠোঁট নীল হবে এবং শরীর প্রচুর ঘেমে যাবে।
চিকিৎসার বিষয়ে ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, কারো নিউমোনিয়া হয়েছে কি না, তা বুঝতে বুকের এক্স-রে করানো হয়। বিশেষ করে লক্ষণগুলোর উন্নতি না হলে, লক্ষণগুলো বারবার ফিরে এলে, ধূমপায়ী হলে, বয়স ৪০-এর বেশি হলে অবশ্যই এক্স-রে করানো উচিত। ইদানীং এইচআরসিটি বা সিটিস্ক্যান করানো হচ্ছে বেশি, যাতে সংক্রমণের মাত্রা বোঝা যায় ভালোভাবে। কারো নিউমোনিয়া শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
নিউমোনিয়ার ধরন, অসুস্থতাবোধ, বয়স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য অবস্থার ওপর ভিত্তি করে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করা হয়। নিউমোনিয়া হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স গ্রহণ করুন। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণজনিত নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দারুণ কাজ করে। হঠাৎ অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিলে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। কোর্স শেষ করার দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত কাশি থাকতে পারে এবং ক্লান্ত বোধ করতে পারেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, কোভিড-১৯ হলো ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ভাইরাল নিউমোনিয়া হলে চিকিৎসক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেন। অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো ডোজ শেষে ডাক্তার আবার বুকের এক্স-রে করে দেখবেন সংক্রমণ কমেছে কিনা। কাশির মাধ্যমে এবং নাক দিয়ে শ্লেষ্মা বের করার চেষ্টা করুন। নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি ভালো উপায়।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, যে কোনো মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে যাদের বয়স ৫০ বছর বা তার বেশি, যাদের ফুসফুস, হার্ট, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস রয়েছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের এই রোগ ও রোগজনিত জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। মাদকাসক্তরাও এই রোগের শিকার হয় সহজে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে ব্যাক্টেরিয়া এবং ফাঙ্গাল দুই রকম নিউমোনিয়াই হতে পারে।
নিউমোনিয়ার কারণে নানা সমস্যা হতে পারে। যেমন- কিডনির ওপর এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। লিভার ফাংশন এবং ব্লাড প্রেসারের ওপর এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সুতরাং সবদিক মাথায় রেখে একজন চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করে থাকেন। এছাড়া খুব যত্নসহকারে অ্যান্টিবায়োটিক নির্ণয় করতে হয়। কাজ না হলে বারবার পরিবর্তন করার দরকার পড়ে। রোগীর আত্মীয়রা ভাবেন চিকিৎসক বারবার অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করছেন কেন। কিন্তু এটা দরকার। কারণ বেশিরভাগ সময় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে।
বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় বিপুল সংখ্যক শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বিদ্যমান : ইউনিসেফ
আগামী দশকজুড়ে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ লাখের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ইউনিসেফ। সংস্থাটির নতুন এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশুকে নিউমোনিয়া ও অন্যান্য বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে। জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি আজ এই বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, যখন ৯টি শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য ও শিশুদের সংস্থা বার্সেলোনায় শৈশবকালীন নিউমোনিয়া বিষয়ক প্রথম বৈশ্বিক ফোরামের আয়োজন করেছে।
পূর্বাভাস অনুযায়ী, নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সেবা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় জোরদার করার মাধ্যমে আনুমানিক ৪৮ হাজার শিশুর মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, নিউমোনিয়া মোকাবিলায় প্রচেষ্টা জোরদার করা হলে তা এর বাইরে একটি ‘রিপল ইফেক্ট’ তৈরি করতে পারে, যা একই সঙ্গে অন্যান্য বড় ধরনের শৈশবকালীন রোগে আরও ৯২ হাজার শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে পারে। শিশুদের পুষ্টির উন্নতি, অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান ও টিকাদানের আওতা বাড়ানো এবং স্তন্যপানের হার বাড়ানো– এই পদক্ষেপগুলো নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এই হস্তক্ষেপগুলো ডায়রিয়া (২৫ হাজার), সেপসিস (৩ হাজার) ও হামের (৩৩ হাজার) মতো রোগে হাজার শিশুর মৃত্যুও ঠেকাতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ এই প্রভাব এতো ব্যাপক হবে যে শুধুমাত্র নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ লাখ ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের কারণে নিউমোনিয়া হয় এবং এই রোগে আক্রান্ত হলে শিশুদের ফুসফুস পুঁজ ও তরলের ভরে যায়, যার কারণে তাদের নিঃশ্বাস নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। এই রোগটি বাংলাদেশে শিশুদের অন্যতম বড় ঘাতক, যার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিকার মাধ্যমে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ এবং স্বল্প-মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে সহজেই চিকিৎসা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সী অনেক শিশুকে টিকা দেওয়া হয়নি এবং এই রোগের লক্ষণে ভোগা সত্ত্বেও অর্ধেকের বেশি সংখ্যক শিশু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পায় না।
আরো পড়ুন:
ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর