জীবন ও পরিবার

ম্রোদের কোনো ধর্মগ্রন্থ, ধর্মগুরু ও মন্দির নেই

“নারী-পুরুষ উভয়ই কানে রিং ব্যবহার করে”

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [১২তম পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে ‘ম্রো’ অন্যতম। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে তাদের বসবাস। তারা মুরং নামেও পরিচিতি। স্বভাবে তারা শান্তিপ্রিয়। তাদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তারা মূলত প্রকৃতি পূজারী এবং তাদের একাংশ খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনেতিক অবস্থা চরম হুমকির মুখে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, অন্য সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মতই ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থা ভালো না। তাদের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে। তাদের জনসংখ্যা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। দুই দশকের ম্রো জনসংখ্যার হিসাবই নেই সরকারের খাতায়। অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে আসছে এই জাতি। এই জাতি অতীতে তাদের শত শত একর ভূমি হারিয়েছে উন্নয়নের নামে। তাদের প্রথাগত জুম জমির ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা, অন্যান্য স্থাপনা। তাদের পবিত্র সমাধি যে আছে, পূর্বপুরুষের বিচরণক্ষেত্র ছিল এই সব স্মৃতিচিহ্ন। সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারা দেশের অন্য সব নাগরিকের মত করে বাঁচতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন জাতি এবং বান্দরবান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম  এই জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সকলের এগিয়ে আসা  উচিত বলে মনে করেন সঞ্জীব দ্রং।

ম্রো নেতা সিং ইয়ং ম্রো ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, ম্রো জাতি মূলত প্রকৃতি পূজারী এবং তাদের একাংশ খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। তাদর দৈনন্দিন জীবনযাপনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে। তাদের তিনজন দেবতা রয়েছে। তুরাই দেবতা হলো বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা, পাহাড়ের দেবতার নাম সাংতুং এবং ওরেং হলো নদীর দেবী। কোনো কিছু শুরুর আগে তারা তুরাই-এর নামে শপথ নেয়। সাংতুং-কে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং জুমচাষে ভালো ফসল পাবার আশায় তারা এই পাহাড় দেবতার কাছে প্রার্থনা করে থাকে।

গ্রামবাসীদের মঙ্গল কামনায় এবং মহামারী ও অশুভ শক্তিকে বিতাড়নের জন্য তারা দলগতভাবে ওরেং-এর পূজা করে। তারা পরজন্মে বিশ্বাসী নয়। আর তাই তাদের সব কর্মকান্ড বর্তমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ম্রোদের মতে মৃত্যু হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি। ম্রোদের কোনো ধর্মগুরু নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই এবং কোনো মন্দিরও নেই।

পোশাক পরিচ্ছদ:

বান্দরবানের লঙনাং ম্রো ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, সময়ের প্রয়োজনে ম্রো জাতির পোশাক পরিচ্ছদেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। জাতিগত পোশাক পরিচ্ছদের কথা বলতে গেলে ম্রো পুরুষরা নেংটি পরে। একখন্ড কাপড় দুই উরুর মাঝখান দিয়ে কোমরে জড়িয়ে রাখে। মেয়েদের পোশাকের নাম ওয়াঙলাই। মাঝখানে এমব্রয়ডারি করা ওয়াঙলাই-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রস্থ হচ্ছে মাত্র ৬ ইঞ্চি। তারা মাথার পেছনে বামপাশে চুল বাঁধে। পুরুষরা বাজারে যাওয়ার সময় লুঙ্গি ও জামা পরে এবং মেয়েরা শরীরের উপরের অংশে একখন্ড কাপড় পরে নেয়।

পুরুষরা লম্বা চুল রাখে এবং কপালের উপর পেঁচিয়ে রাখে। তারা মাথায় পাগড়ি পরে। ম্রোরা তাদের শরীর বিভিন্ন রং দিয়ে সাজাতে পছন্দ করে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই তাদের ঠোঁটে রং লাগায়। নৃত্যের সময় তারা তাদের গাল, ঠোঁট এবং কপাল লাল রঙে রঞ্জিত করতে পছন্দ করে। মেয়েরা মাথায় ও কানে ফুল পরে এবং গলায় পুঁতির মালা পরতে ভালোবাসে। মেয়েদের কানে রূপার বিশেষ অংলংকার (রামচেং) এবং বাহুতে ধাতুনির্মিত বালা পরে। মেয়ে-পুরুষ উভয়ই কানে রিং ব্যবহার করে। বাঁশের পাইপ দিয়ে তারা যে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে তার নাম প্লং। নাচের সময় পুরুষরা লাল কাপড় এবং মাথায় পালক ও পুঁতিসজ্জিত পাগড়ি পরে আর মেয়েরা ফুল, পুঁতি আর মুদ্রা দিয়ে নিজেদের সাজায়।

ম্রো সমাজেও আধুনিক পালাবদলের ছোঁয়া লেগেছে। আর তাই, সপ্তাহের হাটবারে বাজারে যাবার সময় পুরুষদের লুঙি ও জামা এবং মেয়েদের তোলা জামা পরতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বাইরের পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরুষদের শার্ট প্যান্ট ও নারীদের সালোয়ার কামিজ পরতে দেখা যায়।

সামাজি রীতিনীতি:

আদিবাসী নেতা রেং ইয়ং ম্রো ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, ম্রো পল্লীতেও চলে নানা সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। বছরে দু’বার ম্রোরা পূজা করে। পূজাকে ম্রো ভাষায় খাং বলে। জুমের নতুন ফসলে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি করা হয়। পাড়ায় তিন দিন ধরে এই উৎসব চলে। বছরে দুবার- ফাল্গুন ও আষাঢ় মাসে সারা পাড়ায় তিনদিনব্যাপী কেরাই/কাংনাত পূজা করা হয়। মহামারী আকারে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তারা বসুমতি পূজা করে।

ম্রোদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের প্রধান তাই পিতা। কিন্তু তাদের সমাজের নারীদের মূল্যায়ন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পুত্ররাই মূলত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তবে জ্যেষ্ঠ পুত্রের বদলে কনিষ্ঠ পুত্র পায় সম্পত্তির সিংহভাগ। ম্রো সমাজের রীতিনীতি অনুযায়ী বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা থাকেন কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একক পরিবার দেখা গেলেও ম্রো সমাজে যৌথ পরিবারের চলও আছে।

কান ফুটো করার রীতি আছে ম্রো সমাজে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই এ রীতি ম্রো সমাজে প্রচলিত। ম্রোদের ভাষায় এর নাম ‘রইক্ষারাম।’ এর আয়োজন করা হয়ে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর ভোজের মাধ্যমে। জুমচাষে ফসল তোলার পর অবস্থাপন্ন ম্রো পরিবার এক উৎসবের আয়োজন করে থাকে, যার নাম ছিয়াছত-প্লাই। সাধারণত বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস মিলিয়ে এই আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। মেয়ে ও ছেলেরা ম্রোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এবং পুং বাঁশিও বাজিয়ে থাকে। তিনদিন ধরে এই উৎসবে জুমের নতুন ফসল দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি করা হয়।

বিয়ে:

ম্রো নারী নেত্রী রুমপাও মুরং ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে ম্রো সমাজেও রয়েছে নিজস্ব রীতিনীতি। তরুণ ম্রোদের নিজস্ব সঙ্গিনী বাছাই করার অধিকার দেয় ম্রো সমাজ। তবে সঙ্গিনী পছন্দ বা বাছাই হলেও উভয় পক্ষের পিতামাতার অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।

বিয়ের আগে অবাধ মেলামেশায় তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়ে গেলে অতিসত্ত্বর বিয়ে করানো হয়। ম্রোদের বিয়ে হয় বেশ সংক্ষিপ্ত একটা নিয়মে। বিয়ের দিন একটা ওয়ামা বা মোরগ দা দিয়ে চেপে মারা হয়। মোরগের গলা থেকে বের হওয়া ফিনকি দেয়া রক্ত থেকে পরিবারের একজন বয়স্ক পুরুষ তার মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে খানিকটা রক্ত নিয়ে মেয়ে আর ছেলের মাথায় তিলক এঁকে দেয়। এভাবেই মূলত বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে।

অল্প বয়সে বিবাহিত ম্রো দম্পতিরা মূলত বিয়ের পর কনে বা কনের পরিবারের সাথেই বসবাস করে। বিবাহিত দম্পতিদের বাচ্চা হলে পরে তাদেরকে আলাদা বাসা বানাতে হয়। আবার, যদি কোনো কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে স্বামী হতে প্রাপ্য সবকিছুই স্ত্রীকে ফেরত দিতে হয় এবং স্ত্রী তার সমস্ত গয়না-পাতি পিত্রালয়ে ফেরত নিয়ে যান। যদিও প্রথম স্ত্রী মারা গেলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি পায়; কিন্তু নারীদের বেলায় এমনটা সাধারণত ঘটে না।

বাল্যবিবাহ দেখা গেলেও বহুবিবাহ বা বহুস্বামী গ্রহণ সমাজে অপ্রচলিত। ম্রো সম্প্রদায়ের কারোর বাচ্চা হলে নদীর কিনারায় চারটি বাঁশ রাখে তারা। তারপর সেখানে একটি মুরগি জবাই করে সেটার রক্ত বাঁশে রাখা হয়। গ্রামবাসীরা মিলে এক বিশেষ প্রার্থনা করে।

ম্রোদের অবস্থান ও ভাষা:

আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক পল্লব চাকমা ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে তাদের বসবাস। বান্দরবান জেলার তোইন, মঙ্গু, তৈনফা, লুলোইং, উত্তরহানগড়, দক্ষিণ হানগড়, তঙ্কাবতী, হরিণঝুড়ি, টেকের পানছড়ি, রেনিখ্যং, পানতলা, থানখ্যং, সোয়ালক, তিনডো, সিংপা, আলীখং এবং ভারিয়াতালি মৌজায় তারা বাস করে।

ভাষা ম্রোরা, ম্রু ও মুরং নামেও পরিচিত। তাদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও পূর্বে বর্ণমালা ছিল না।ইদানীং ম্রোদের নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। ম্রোরা তিববতী-বর্মী গ্রুপের একটি বিশেষ ভাষায় কথা বলে। বতর্মানে এদের নিজস্ব ভাষায় ও বর্ণমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই প্রণীত হয়েছে।তবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিজস্ব ভাষায় শিক্ষাদানে তেমন গতি নেই বলে জানা পল্লব চাকমা।

আরো পড়ুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *