নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: দেশে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ছোট মাছ ১৪৩ প্রজাতির। এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ ছিল বিলুপ্তপ্রায়। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যম বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ ফিরিয়ে আনছে। এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ৩১ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন। বাঙালির পাতে ফিরছে কুর্শা, লইট্যা ট্যাংরা ও বটিয়া পুইয়া নামে আরও তিন প্রজাতির দেশি ছোট মাছ।
এছাড়াও নতুন করে কাজুলি, হিরালু, দেশি শোল, বাছা মাছ নিয়ে চলছে গবেষণা। আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ে এসব মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্ভব হবে বলে আশা। পাবদা, গুলশা টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, গজার, রানি, বাতাসি, পিয়ালিসহ ৩১ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্য চাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বিএফআরআই’র গবেষকরা।
উদ্ভাবিত এসব মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলে। পাশাপাশি রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতি আহরণসহ নানাবিধ কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমে কমছে।
বিএফআরআই সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ সালে পুকুরে দেশি ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ মেট্রিক টন, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ গত ১০ বছরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। দেশের মৎস্য উৎপাদনে দেশি ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। চাষাবাদ বাড়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতে দেশি মাছের পোনা ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। পোনা প্রাপ্তি সহজতর হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কৈ মাছ চাষ হচ্ছে ব্যাপক পরিসরে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতি হলেও গত এক দশকে বাংলাদেশে এর প্রবৃদ্ধির ধারা ৯.১ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ তিন হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে এক লাখ ১৯ হাজার টন বেশি।
আগে শুধু বিএফআরআই ময়মনসিংহের স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রেও বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা গত জুন-জুলাই মাসে বিলুপ্তপ্রায় তিনটি মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেওয়া স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান বলেন, সম্প্রতি আমরা কুর্শা, লইট্যা ট্যাংরা, বটিয়া মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি। কিছু মাছ তো হারিয়ে যাওয়ার পথে। এখন তাদের বাসস্থান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব মাছ তাদের নতুন প্রজন্ম তৈরি করার মতো জায়গা পাচ্ছে না, সেজন্য এসব মাছ ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে।
‘এখন আমাদের ফিশারিজ পরিবারের দায়িত্ব এগুলো ধরে রাখা। ইতোমধ্যে ৩১ প্রজাতির মাছ আমরা ফিরিয়ে এনেছি। এরমধ্যে সৈয়দপুরে উপকেন্দ্রই ফিরিয়ে আনতে পেরেছি নয়টি প্রজাতি। তিস্তা নদী থেকে এসব মাছ সংগ্রহ করা হয়। আমাদের পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন হওয়ায় ভবিষ্যতে এসব মাছ হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলো।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে অনেকগুলোই আমরা ফিরিয়ে এনেছি। গত জুন-জুলাই মাসে আরো তিনটি মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন আমাদের গবেষকরা। আগামী জুন-জুলাইয়ে বর্ষা মৌসুমে আরও কয়েকটি জাত ফিরবে। আমরা আরও চারটি জাত নিয়ে কাজ করছি।
‘মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রতি জোরদার করা হয়েছে এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গবেষণার। পর্যায়ক্রমে সব দেশি মাছ পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি মাছ পর্যায়ক্রমে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনাই এসব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।’
জানা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরে দেশে প্রথমবারের মতো বিএফআরআইয়ে দেশি মাছের লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশি প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে এ লাইভ জিন ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রতিষ্ঠিত এ লাইভ জিন ব্যাংকে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাগনা, দেশি কই, নাপিত কই, গুলশা, খলিশা, লালখলিশা, মাগুর, বোয়ালিপাবদা, সরপুঁটি, পুঁটি, শিং, মহাশোল, রুই, বুজুরি টেংরা, ভিটা টেংরা, বাটা, রিটা, মলা, পুইয়াগুতুম, পাহাড়ি গুতুম, ঠোঁটপুইয়া, শালবাইম, টাকি, ফলি, ঢেলা, চেলা, লম্বা চান্দা, রাঙাচান্দা, লালচান্দা, পিয়ালি, বৈরালি, দারকিনা, ইংলা, কেপ চেলা, রানি, কাকিলা, কাজলি, ভাচা, বাতাসি, আঙ্গুস, কানপোনা, ঘাউরা, ভেদা, কাকিলা, বাঁশপাতাসহ মোট ৮৮ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে সব দেশি মাছ এ ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে। দেশব্যাপী এ সংরক্ষণ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত।
মাছের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক একটি আধুনিক ধারণা। জিন ব্যাংক মূলত কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক উপাদানের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন জিন ব্যাংকের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক উৎসে কোনো দেশি মাছ হারিয়ে গেলে সেসব মাছ পুনরুদ্ধারের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক থেকে ব্যবহার করা যাবে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির মাছের চাষপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে সরকার কাজ করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ৩১ প্রজাতির দেশি বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। আরও বেশ কিছু প্রজাতির দেশি মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন নিয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা চলমান।
‘দেশি মাছ সংরক্ষণে প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহে ‘লাইভ জিন’ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ময়মনসিংহে অবস্থিত এই জিন ব্যাংকে ইতোমধ্যে ৮৮ প্রজাতির মাছের জিন সংরক্ষণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশি সব মাছ এই ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হবে। সরকারের উদ্যোগের ফলে বাজারে এখন বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাঙালির পাতে ফিরে আসছে নানা স্বাদের দেশি মাছ।’
আরো পড়ুন: