আ ন ম আমিনুর রহমান অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের সীমান্তবর্তী কুরমা চা-বাগানে দুটি অধরা পাখির ছবি তুলে চা-বাগানের গেটের পাশে রূপকের ঝুপড়ি দোকানে চা খাচ্ছি। এমন সময় রাধানগরের হিমকুঁড়ি বন বাংলোর কর্ণধার প্রকৃতিপ্রেমী আসিফ সাজিলের ফোন, ‘স্যার, শ্রীমঙ্গলে কখন এলেন? আমার এখানে তো উঠলেন না?’ আমি বললাম, ‘আমি যে এখানে, তুমি তা জানলে কীভাবে?’
‘ফেসবুকের মাধ্যমে, স্যার’, আসিফ বলল। পাশে থাকা শ্রীমঙ্গলের পক্ষীসঙ্গী খোকন থুয়ানাউজামকে বললাম, ‘তুমি কি ফেসবুকে আমাদের ছবি আপলোড করেছ?’
‘জি স্যার, মাত্রই করলাম,’ খোকন বলল।
তাহলে এত দ্রুত আসিফের ফোন পাওয়ার কারণ এটাই। আসিফ নাছোড়বান্দা, এবার তার ওখানে না উঠলেও কাল সকালে ব্রেকফাস্টে যেতেই হবে, কোনো অজুহাত চলবে না।
পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) সহকর্মী ড. মো. রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে রাধানগরের টিলাময় প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা আসিফের হিমকুঁড়ি বন বাংলোয় হাজির হলাম। গল্পে গল্পে ব্রেকফাস্ট সেরে পুরোটা বাংলো ঘুরে দেখলাম। হঠাৎ বন বাংলোর পাশের বাগানে একটি পাখি এসে নামল। আসিফ বলল, পাখিটিকে সে সব সময় দেখে। আমি ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখতেই পাখিটি বাগান থেকে আমগাছের ডালে এসে বসল। বাগানের চেয়ে আমগাছে আলো বেশ কম। তাই ক্যামেরার শাটার স্পিড কমিয়ে এবং আইএসও বাড়িয়ে বেশ কটা ক্লিক করলাম। ছবি খারাপ হলো না। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর ঘটনা এটি। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের ব্যাংছড়ির মারমা পাড়ার পাশ থেকে ওর প্রথম ছবিটি তুলেছিলাম ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে।
শ্রীমঙ্গলের হিমকুঁড়ি বন বাংলোয় দেখা প্যাঁচাটি এ দেশে সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি কালি প্যাঁচা। পশ্চিমবঙ্গে খুঁড়ুলে প্যাঁচা নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম এশিয়ান বার্ড আউলেট বা বার্মিজ বার্ড আউলেট। স্ট্রিজিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Glaucidium cuculoides। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক কালি প্যাঁচা লম্বায় ২২-২৫ সেন্টিমিটার। ওজনে প্যাঁচা ১৫০-১৭৬ গ্রাম ও পেঁচি ২৪০ গ্রাম। দেহের ওপরের হলদে ও নিচের ফ্যাকাশে পালকের ওপর বাদামি বর্ণের ঘন ডোরা রয়েছে। পেটের নিচে রয়েছে বাদামি দাগছোপ। লেজে চওড়া আড়াআড়ি সাদা ডোরা দেখা যায়। গলার নিচ ও পেটের মাঝে সাদা কিছু পালক রয়েছে। পালক ও ডানার নিচের অংশে হলদে ডোরা থাকে। চোখ লেবু-হলুদ। চঞ্চু হলদে-ধূসর ও পা ধূসরাভ। প্যাঁচা-পেঁচির পালকের রঙে পার্থক্য না থাকলেও আকারে পুরুষ ছোট। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথার চাঁদি, ঘাড়ের পেছন ও কাঁধ-ঢাকনিতে হলদে তিল থাকে।
কালি প্যাঁচা মূলত ঢাকা বিভাগের পাতাঝরা এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বন ও চা-বাগানের বাসিন্দা। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। দিন ও রাতে সমান তৎপর। নিচু জায়গা থেকে চারদিকে শিকার খোঁজে। মূলত কীটপতঙ্গভোজী হলেও ইঁদুর, টিকটিকি এবং ছোট পাখিও খেতে পারে। দিনের বেলা অনেক সময় গাছের উন্মুক্ত ডালে বসে থাকে। সচরাচর ঝিঁঝি পোকার মতো করে ট্রররররররররর শব্দে ডাকে। অনেক সময় উচ্চ স্বরে উ-উ-উ-উ-উ-উ-শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে জুনে প্রজননকালে গাছের কাণ্ডের প্রাকৃতিক খোঁড়লে বাসা বানায়। অনেক সময় কাঠঠোকরা বা বসন্তবাউরির বাসা দখল করে ব্যবহার করে। স্ত্রী ৩-৫টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ২৯-৩১ দিনে। প্যাঁচা-পেঁচি মিলেমিশে ডিমে তা দেয় ও ছানাদের লালনপালন করে। আয়ুষ্কাল তিন-চার বছর।
লেখক: অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর।