ডেস্ক প্রতিবেদন, ধূমকেতু বাংলা: হালদা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র। অনন্য এই নদী নিয়েই কাজ করছে ‘হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি’। গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া। তরুণ একদল গবেষকের নেতৃত্বেও দিচ্ছেন তিনি। তারা সম্প্রতি উন্মোচন করেছেন হালদা নদীর রুই-জাতীয় চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য। জানা যাক হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরীয়া ও তার গবেষণাকেন্দ্রের বৃত্তান্ত:
হালদাপাড়ের একটা গ্রাম সুয়াবিল। ফটিকছড়ির এই গ্রামেরই ছেলে মনজুরুল কিবরীয়া। ছোটবেলা থেকেই তাই হালদার প্রতি টান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আর প্রগাঢ় হয়েছে এই টান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ শেষে ২০০৩ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। শিক্ষকতা জীবনেও শুধু ক্লাসরুমে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি কিবরীয়া। ছুটে গেছেন হালদায়, ঘুরেছেন পাড়ে পাড়ে। মিশেছেন নদীনির্ভর মানুষদের সঙ্গে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন হালদা বিশেষজ্ঞ।
হালদা নিয়ে আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা হয়ে আসছিল। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই মূলত এই গবেষণাগুলো হয়ে আসছিল। তাদের অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। কিবরীয়া ভাবলেন, তারাও তো একদিন অবসরে যাবেন। হালদা নিয়ে গবেষণা কি তারপর থেমে যাবে? অনন্য এই নদীর কাছে ছুটে আসবেন না গবেষকেরা? দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র নদীটির দীর্ঘদিনের লোকজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই বা কী হবে? তাও কি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে? দখল-দূষণে ধুঁকতে থাকা নদী রক্ষাই বা করবে কারা? এসব প্রশ্ন মনজুরুল কিবরীয়াকে বিচলিত করত। হালদা নিয়ে স্থায়ী কিছু করার ইচ্ছা হতো। তার থেকেই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চিন্তা।
সেই চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে কিবরীয়াকে পেরোতে হয়েছে অনেকটা বন্ধুর পথ। সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। অনেক জায়গা থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে, তবে হার মানেননি মনজুরুল কিবরীয়া। ধৈর্যের ফলও পেয়েছেন। সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে পিকেএসএফ ও আইডিএফ। তখন আবার আরেক সমস্যা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি সহায়তা নেবে কী করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর ইতিবাচক মনোভাবে সে জটিলতারও অবসান হয়। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করে ‘হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি’। পাবলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একক নদী নিয়ে এ ধরনের গবেষণাগার দেশে এই প্রথম।
গবেষণাগারটি করার পেছনে ছিল পাঁচটি উদ্দেশ্য। হালদা নদীর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিশেষ গবেষণা। হালদা নদীর সম্পদ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ। হালদা নদীর প্রচলিত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সংরক্ষণ। হালদা নদীর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। এবং এই গবেষণাকেন্দ্রকে দেশের নদী গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জীববিজ্ঞান অনুষদের তিনতলার একটি পরিত্যক্ত কক্ষে গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়। হালদা গবেষণাকেন্দ্র কেন হালদাপাড়ে নয়, তারও উত্তর দিলেন নদী গবেষক ও গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা মনজুরুল কিবরীয়া, ‘ইচ্ছা ছিল হালদাপাড়েই এ কেন্দ্র করব। সেটি হলে চমৎকার হতো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে তা আরও বেশি কার্যকর হবে। কেননা শিক্ষার্থীরা পড়ার সময়ই এ ধরনের গবেষণাগার দেখে গবেষণা করতে আগ্রহী হবেন। এই চিন্তা থেকে হালদাপাড়ে না করে ক্যাম্পাসে এই কেন্দ্র স্থাপন করি। এখন গবেষণাকেন্দ্রের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী এবং গবেষকেরা হালদা নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। অন্যান্য নদীর ব্যাপারেও সচেতন হচ্ছেন তারা। এটি অনেক বড় একটি অর্জন।’
গবেষণা কেন্দ্রে যা আছে
এক হাজার বর্গফুটের ওপর স্থাপিত এই গবেষণাকেন্দ্রে তিনটি শাখা রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি। এর আওতায় আছে পানির গুণাগুণ পরীক্ষা এবং নদীর জৈবিক বিশ্লেষণের আধুনিক যন্ত্রপাতি।
নদী জাদুঘর ও আর্কাইভ শাখায় হালদা নিয়ে এখন পর্যন্ত যত ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে, তার নথিপত্র, প্রকাশিত প্রবন্ধ, প্রকল্পের কাগজপত্র রাখা হচ্ছে। হালদা নদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বড় আকারের মা মাছ। এর নমুনা, ডলফিন ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে শুধু হালদার নয়, দেশের অন্যান্য নদীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্পদের তথ্যও সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা। গবেষক, সরকারি নীতিনির্ধারক বা আগ্রহী যে কেউ অল্প সময়ে হালদা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।
আর তৃতীয় শাখা হচ্ছে ডিজিটাল কনফারেন্স সেন্টার। যেখানে একসঙ্গে ৫০ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে বৈজ্ঞানিক আলোচনা, প্রেজেন্টেশন ও ভিডিও-তথ্যচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে।
হালদা একটি অনন্য নদীর নাম
মিঠাপানির মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চট্টগ্রামের হালদা নদী বিশ্বে অনন্য। খাগড়াছড়ির রামগড়ের মানিকছড়িতে হালদার উৎপত্তি। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ নদী বন্দরনগরীর মোহনায় এসে কর্ণফুলীতে মিশেছে। প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীতে প্রতিবছর প্রথম ভারী বর্ষণের সময় (যখন বজ্রপাত হয়) মা মাছ ডিম ছাড়ে। জোয়ার-ভাটার এই নদী থেকে রুই, মৃগেল, কাতলা, কালবাউশ প্রভৃতি কার্পজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা হয়। এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই হালদার অনন্যতা।
আছে সাফল্যের গল্প
প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করে। আর মাত্র চার বছরের মধ্যেই এল সবচেয়ে বড় সাফল্য। হালদা নদীর কার্প বা রুইজাতীয় চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্স) করেছেন বাংলাদেশের একদল গবেষক। এ গবেষণায় নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এম জে জোনায়েদ সিদ্দিকী।
দেশের রুইজাতীয় মাছের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই নদীর রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ যেমন দ্রুত বাড়ে, স্বাদেও তেমনি অতুলনীয়। জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলে এই মাছগুলোর ‘বিশেষত্ব’র দিকগুলো জানা সম্ভব হবে। গাঙ্গেয় ডলফিনসহ মৃগেল ও কালবাউশের জীবনরহস্য উন্মোচন এটাই প্রথম।
চার প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জীবনরহস্য উন্মোচনেই সীমাবদ্ধ নেই এই গবেষণাগারের সাফল্য। দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদাকে গত বছরের ডিসেম্বরে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। হালদা নদীর জন্য করা হয়েছে ২০ বছর মেয়াদি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। এই স্বীকৃতি এমনি এমনি আসেনি। দীর্ঘদিনের দাবির ফসল এই স্বীকৃতি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী এই গবেষণাগারের অধীনে হালদা নদী নিয়ে গবেষণা করেছেন। দুজন করে গবেষক এমফিল ও পিএইডি করছেন। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। আর হালদা ছাড়া দেশের বিভিন্ন নদী নিয়ে এই গবেষণাগারে নিয়মিত সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্যরা।
হালদা নদী নিয়ে এত কর্মযজ্ঞের মধ্যেও কিছু কষ্টের খবর পান তারা। মারা যাচ্ছে একের পর এক ডলফিন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৩১টি ডলফিন মারা গেছে এই নদীতে। এই মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে ইতিমধ্যে দুটি ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এই গবেষণাগারে, যা বাংলাদেশে প্রথম।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য হালদার দিকে নজর দিয়েছিল ওয়াসা। কিন্তু পানি উত্তোলনে নদীর কী কী ক্ষতি হবে, তা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরে এই গবেষণাকেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত সে প্রকল্প থেকে সরে আসে ওয়াসা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হালদা নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অন্য একটি গবেষণাকাজে যুক্ত হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এই আক্ষেপ মনজুরুল কিবরীয়ার থেকে যায়। ১৮ বছর আগে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে হালদা। গবেষণাগার করার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ঘুচেছে আক্ষেপ। এখন তাঁর প্রত্যাশা, এই গবেষণাকেন্দ্র একদিন দেশের নদীগুলো রক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হবে।
সূত্র: প্রথম আলো।
আরো পড়ুন:
আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন রফিকুল আলম