জীবন ও পরিবার

হারিয়ে যাচ্ছে খিয়াংদের ভাষা, সংস্কৃতি || সংরক্ষণে দরকার উদ্যোগ

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু বাংলা’র বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো ১৬তম পর্ব।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো খিয়াং সম্প্রদায়। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তাদের বসবাস। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের বড় অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাদের বড় সামাজিক উৎসবের নাম ‘হেনেই’। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও তাদের সমাজে ঘরজামাই যাওয়ার প্রচলন রয়েছে। নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় জাতি।

বাংলাদেশে বসবাসরত খিয়াং জাতিগোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে খিয়াং কল্যাণ সংস্থার সহ-সভাপতি অংথুই খিয়াং ধূমকেতু বাংলাকে জানান, খিয়াংদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আছে। কিন্তু তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য আর পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে শিক্ষাকে বিসর্জন দিতে হয় খিয়াং ছেলেদের। মেয়েরা পারিবারিক ও সরকারিভাবে শিক্ষার সুযোগ পেলেও তাদের অনেকে অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ের বন্ধনে জড়িয়েছেন। এতে কমেছে খিয়াংদের সংখ্যা, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোথাও নেই খিয়াংদের জনপ্রতিনিধি।

অংথুই খিয়াং আরও জানান, বাংলাদেশে  রাঙ্গামাটি জেলার  রাজস্থলী উপজেলায় খিয়াং জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। রাজস্থলী উপজেলার কুক্যাছড়ি, জিম্রম, ধনুছড়া, আরাছড়ি মৌজায় এবং চন্দ্রঘোনা মিশন পাড়ায় তাদের সংখ্যা বেশি। এছাড়া বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং থানচি উপজেলায়ও কিছুসংখ্যক খিয়াং বসবাস করে। ১৯৮১ এবং ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে খিয়াং জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫,৪৫৩ এবং ১,৯৫০। তবে তাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় চার হাজার হবে বলে খিয়াং সম্প্রদায়ের নিজস্ব জরিপ দাবি করে আসছে।

ধর্ম:

বাবলা খিয়াং বলেন, অতীতে প্রকৃতি পূজারী খিয়াং সম্প্রদায় পরবর্তীতে বৌদ্ধ গ্রহণ করে। বর্তমানে ওই জাতিগোষ্ঠীর বড় অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে তাদের জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়াও তাদের একটা অংশ এখনও সনাতন ধর্ম পালন করেন। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণকারী খিয়াংরাও আদিবাসী সংস্কৃতি ও প্রথা এবং প্রকৃতি পূজাসহ রীতিনীতি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি। আর খ্রিস্টান ধর্মের খিয়াংরা সবচেয়ে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে খ্রিস্টমাস বা বড়দিন পালন করেন। সনাতন খিয়াংরা দুজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী- পেটিয়ান ও খোজিং।

পেশা ও অর্থনৈতিক অবস্থা:

আদিবাসী ফোরামের নেতা পল্লব চাকমা ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, খিয়াংদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। যেখানে জুমের জন্য ভালো জায়গা পাওয়া যায় এবং ফসল ফলানোর সম্ভাবনা থাকে সেখানে তারা গিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকার উপযোগী ঘরবাড়ি তৈরি করে নেয়। তাদের কারো কারো জমিও আছে। এছাড়া তারা গাছ, বাঁশ, লাকড়ি প্রভৃতি কেটে বিক্রি করেও জীবনধারণ করে। জুম চাষ ব্যতীত খিয়াংরা ফলের বাগানও করে। শিক্ষিতের হার কম থাকায় সরকারি-বেসরকারি অফিসে খিয়াং কর্মজীবীর সংখ্যা তেমন নেই। ‍তবে আগের তুলনায় শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের খিয়াংরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মানুসারী। ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠীতে ৩ জন এমবিবিএস চিকিৎসক আছেন। তবে এখন পর্যন্ত নেই কোনো বিসিএস কর্মকর্তা।

সামাজিক রীতিনীতি ও উৎসব:

খিয়াং কল্যাণ সংস্থার সহসভাপতি অংথুই খিয়াং ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, খিয়াং জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। তাদের প্রধান উৎসবের নাম  ‘হেনেই’ বা নবান্ন উৎসব। এ উৎসবের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ নেই। ফসল ঘরে এলে তারা এই উৎসব উদযাপন করে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা সবাই মিলে সারারাত ধরে মাংস রান্না করে। পরদিন ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। পাশের গ্রামের লোকদেরও এই উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খিয়াং সম্প্রদায়ের ভাষা কুকি ও চীন দলভুক্ত। এ ভাষায় লোকগাথা গান ও প্রবাদ কাব্য চালু থাকলেও লিখিত সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় না। তাদের মধ্যে নৃত্যগীতের যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে। পূজা-পার্বণের অথবা উৎসবাদিতে নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়। বিবাহে তেমন কোনো বাঁধাধরা নেই। তাদের কোনো প্রথাও নেই। বরপক্ষ বা কনেপক্ষ কাউকে পণ দিতে হয় না। ছেলেরা সাধারণত অল্প বয়সে বিয়ে করে। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী এবং স্ত্রী মারা গেলে স্বামী  আবার বিয়ে করতে পারে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও তাদের সমাজে ঘরজামাই যাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

খিয়াং সমাজে সচরাচর দুই প্রকার বিবাহ দেখা যায়। যেমন- সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ ও পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ। বিধবা বিবাহ ও বহু বিবাহের ক্ষেত্রে সমাজে দাবি পূরণ করতে হয়। নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে কঠোর দন্ড দেওয়া হয়।

খিয়াং সমাজের নেতাকে বলা হয় কার্বারী। অপরাধ ও অন্যায় কাজে অভিযুক্ত সদস্য/সদস্যাকে সমাজের বিদ্যামান রীতিনীতি অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন কার্বারী। তাদের সমাজে কোনো লোক মারা গেলে দাহ করা হয়ে থাকে। গ্রামবাসী মৃত লোকটির বাসায় একত্রিত হয়। মৃত লোকটিকে দাহ করার পর মহিলা হলে ৫ দিন এবং পুরুষ হলে ৬ দিন ধরে মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতি কামনা করে গ্রামমবাসীদের নিয়ে ছেলে বা মেয়েরা শ্রদ্ধা ক্রিয়ার জন্য ভোজের আয়োজন করে।

খিয়াংরা মূলত পিতৃসূত্রীয় এবং যৌথ পরিবার গঠন করে থাকে। তবে বর্তমানে খিয়াংরা আধুনিক জীবনধারায় যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন করার সংখ্যা বেড়েছে। এই সমাজে শিশু জন্ম নিয়ে অনেক আচারঅনুষ্ঠান করা হয়। গর্ভবর্তী মেয়েদের গর্ভাবস্থায় চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ দেখা নিষিদ্ধ।

পুরুষেরা নেংটি এবং নিজেদের হাতে সেলাই করা এক ধরনের জামা পরে। পুরুষেরা কোমর তাঁতে বোনা সাদদা জামা ও ধূতি পরিধান করে। তবে তাদের অনেকে  এখন বাঙালী ও আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও সামাজিক আচরণে পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়েছে।

খিয়াং নারীদের উত্তরাধিকার:

সুস্মিতা চাকমার লেখা  ‘প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থা’ শীর্ষক পুস্তকে বলা হয়েছে, খিয়াং সমাজভুক্ত কোনো একটি পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়দায়িত্ব পালনের সাথে মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত। তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউপি চেয়ারম্যান/কার্বারি/পৌর চেয়ারম্যান। সার্কেল চিফের কাছ থেকে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণপূর্বক ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী খিয়াং পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যয়িত অর্থ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবি পরিশোধ বা নিস্পন্ন করার পর খিয়াং সমাজে উত্তরাধিকারযোগ্য স্থাবর সম্পত্তি ভাগবণ্টন হয়ে থাকে। খিয়াং জনগোষ্ঠীর লাইতু উপদলের/শাখার প্রচলিত রীতি অনুসারে মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যারা সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। মৃত পিতার নামীয় সম্পত্তি থেকে পুত্ররা ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং কন্যারা ২ ভাগের ১ ভাগের উত্তরাধিকারী হয়। পুত্রের অবর্তমানে কন্যাসন্তানরা মৃত পিতার সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হলে তার স্ত্রীর সহোদর ভাই, ভাইয়ের অবর্তমানে ভ্রাতুস্পুত্ররা মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রসন্তানরা মৃতের সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার লাভ করে। দত্তক পুত্র পালক পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। দত্তক পুত্র গ্রহণের পর যদি পালক পিতার ঔরসে পুত্রসন্তান জন্মায়, সেক্ষেত্রে নিজ সন্তানের ন্যায় দত্তক পুত্রও মৃতের সম্পত্তির ৪ ভাগের ১ অংশের উত্তরাধিকারী হয়। অবৈধ সন্তান এবং সমাজচ্যূত সন্তান যদি সামাজিক বিচারে স্বীকতি পায়, তাহলে মৃত পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। পুত্ররা মাতার সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকারী হয়। পুত্র না থাকলে কন্যার মাতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। দান বা উইলের মাধ্যমে পিতা-মাতার কাছ থেকে কন্যা অথবা স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী সম্পত্তি পেতে পারেন।

আরো পড়ুন:

জীবিকা সংকটে শান্তিপ্রিয় খুমিরা || দরকার বিত্তবানদের সহযোগিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *