কৃষি-মৎস্য

হারিয়ে যাওয়া পুষ্টিকর মাছ ‘কাকিলা’ আবার এলো ফিরে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: বত্রিশ বছর ধরে তিতাস নদীতে মাছ ধরছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসপাড়ের কৃষ্ণ কুমার দাস। এক সময় নদীর পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে কাকিলা মাছ (কাইক্কা মাছ নামে অধিক পরিচিত) খেলা করতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু এ মাছের দেখা তিনি আর পান না। কৃষ্ণ বলেন, শুধু দিন-মাস বছর নয়, প্রায় যুগ ধরে কাকিলা মাছের দেখা মেলে না। নতুন প্রজন্মের অনেকে হয়তো জানেই না- কাকিলা মাছ দেখতে কেমন। তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। বিলুপ্তপ্রায় কাকিলা মাছসহ ৩১ প্রজাতির মাছ কৃত্রিম প্রজননে তারা সফল হয়েছেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সূত্র জানায়, হারিয়ে যাওয়া স্বাদু পানির কাকিলা মাছ আবার ফিরছে। সংস্থাটির কোর গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় তিন বছর গবেষণার পর এ সফলতা এসেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিলে দেশীয় মাছের মধ্যে অন্যতম কাকিলা মাছ। মানবদেহের জন্য মাছটি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ। কাঁটা কম থাকায় সবার কাছে প্রিয়। এক সময় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এর বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হতে থাকে। হারিয়ে যেতে থাকে সুস্বাদু মাছটি। তবে বদ্ধপরিবেশে অভিযোজন ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছটি ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

জানা গেছে, কাকিলা মাছের দেহ সরু, ঠোঁট লম্বাটে ও ধারালো দাঁতযুক্ত। মিঠা পানির মাছ কাকিলাকে কাইকল্যা, কাইক্কা, কাখলে নামেও ডাকা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Xenentodon cancila. ইংরেজিতে মাছটিকে Freshwater garfish বলা হয়। কাকিলার দেহ লম্বা ও সামান্য চাপা। প্রায় সিলিন্ডার আকৃতির। এগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার হয়। এটি শিকারী মাছ। মূলত ছোট মাছ খেয়ে থাকে। জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচে ও ভাসমান শেকড়ে এরা ডিম পাড়ে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মাছটি পাওয়া যায়। তবে রঙ ও আকারে কিছু পার্থক্য রয়েছে। জানা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কাকিলা মাছে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ প্রোটিন, ২ দশমিক ২৩ শতাংশ লিপিড, ২ দশমিক ১৪ শতাংশ ফসফরাস এবং শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যা অন্যসব ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি।

গবেষণাটি পরিচালনা করেন মৎস্যবিজ্ঞানী ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন, মো. শরীফুল ইসলাম ও শিশির কুমার দে। তাদের মতে, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- চাষের জমিতে লাগামছাড়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। বৃষ্টির জলে ধুয়ে সে সব নদী-খাল-বিলে পড়ছে। এতে বহু মাছ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, তবে হারিয়ে যাওয়া ৩১টি মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এসব মাছ এখন ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে।

গবেষক দলের প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রবিউল আউয়াল হোসেন জানান, কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন বাংলাদেশেই প্রথম। বিশ্বের কোথাও এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের তথ্য পাওয়া যায়নি। গবেষক দলের সদস্য ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানান, পদ্মা নদী থেকে কাকিলা ব্রুড (মা-বাবা মাছ) মাছ সংগ্রহ করে যশোরে পুকুরে ছাড়া হয়। পরে বিভিন্ন ডোজে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা ডিম থেকে ২৫ আগস্ট পোনা বের হয়। এতে কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, দেশের বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ৩০টি মাছের কৃত্রিম প্রজননে ইতোমধ্যে আমরা সফলতা লাভ করেছি। সফলতার ধারায় ৩১তম মাছ হিসাবে কাকিলা মাছ যুক্ত হলো। তিনি আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে সব বিপন্ন প্রজাতির মাছকে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা হবে। এজন্য ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *