লাইফস্টাইল

হাজংদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [২য় পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাস করে। হাজং জাতিগাষ্ঠী তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ জেলার বেশ কিছু উপজেলায় তাদের বসবাস। হাজংদের সমাজ ব্যবস্থা কয়েকটি ধাপে বিভক্ত এবং পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ শাসিত। তারা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। কৃষি তাদের প্রধান উপজীবিকা। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার শতাধিক গ্রামে বসবাসরত হাজংদের জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। রাষ্ট্রীয় জীবনে সুনাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রত্যশা করে তারা। যুগে যুগে রাষ্ট্র বিপ্লদাদিতে তারা আজ বিপর্যস্ত। অতীতে হাজংরা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক ছিল। বর্তমানে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতি ও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে তারা। আধুনিক জটিল সমাজনীতি, যান্ত্রিক অগ্রগতি ও সভ্যতা এবং ভাগ্য বিপর্যয় তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। তবে তাদের স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বৃহত্তর নেত্রকোনা অঞ্চলে বিট্রিশবিরোধী টঙ্ক আন্দোলন বা হাজং বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, হাজংদের বংশোদ্ভব ও আদি নিবাস সম্পর্কে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি।

ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর ও কলমাকান্দা থানা, সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা, তাহেরপুর, বিশম্ভপুর ও দোয়ারা বাজার উপজেলা, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি ও শ্রীবর্দী থানা এবং ভারতের মেঘালয়, আসাম, অরূণাচল, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার রাজ্যে তাদের বসবাস।

হাজং মাতা রাশিমনি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মতিলাল হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, ১৯৪৬ সালের পূর্বেও এ সকল অঞ্চলে ৩৬০টি গ্রামে হাজংদের বসবাস ছিল। তখন বাংলাদেশে হাজংদের মোট জনসংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি। হাতিখেদা বিদ্রোহ, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, টঙ্ক প্রথা ও জমিদার প্রথা বিরোধী আন্দোলনের কারণে অসংখ্য হাজং পরিবার ভারতে পালিয়ে গেছে।

বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচালার একাডেমির পরিচালক গীতিকার ও কবি সুজন হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, ব্রিটিশ বিরোধী, জমিদার বিরোধী এসব আন্দোলনে অনেক বিখ্যাত হাজং ব্যক্তিত্বরা অবদান রেখেছেন। কুমুদিনী হাজং ও যাদুমনি হাজং টঙ্গ আন্দোলন ও জমিদার বিরোধী আন্দোলনে ব্যপক ভূমিকা রাখেন। ওই আন্দোলনে রাশিমনি হাজং প্রথম শহীদ হন। অশ্বমনি হাজং এবং ভদ্রমনি হাজং লেংগুড়া বাজারের ঐতিহাসিক টঙ্গ বিরোধী মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হন এবং তাদের বারো বছরের জেল হয়। এই আন্দোলনে হাজংদের বীরত্ব ইতিহাসে অবমূল্যায়িত বা গোপন রয়ে গেছে। তাদের ওপর হওয়া নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র রয়ে গেছে আড়ালে।

সমাজ ব্যবস্থা:

বিরিশিরি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীর পরিচালক গীতিকার ও কবি সুজন হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজংদের সমাজ ব্যবস্থা কয়েকটি ধাপে বিভক্ত এবং পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ শাসিত। পিতা বা বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ পরিবারের কর্তা। তারা সব সময় একজনের নেতৃত্বে দলবন্ধভাবে বাস করে। এভাবে দলবদ্ধতা ‘বসতপাড়া’ নামে আখ্যায়িত। নেতা বা প্রধা্নের উপাধি ‘গাঁওবুড়া’। এই উপাধি পেয়ে থাকেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি, তিনি অবশ্যই সমাজের প্রতিপত্তিশালী। হাজং নিয়মে কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি গ্রাম এবং কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি চাকলা বা জোয়ার। আবার কয়েকটি চাকলা নিয়ে গঠিত হয় একটি পরগণা। গ্রামের প্রধান মোড়ল, চাকলার প্রধান সব মোড়ল এবং পরগণার প্রধান থাকেন রাজা। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় গাঁওবুড়া এবং সব মোড়লদের গুরুত্ব বেশি। পাড়া তথা সমাজের উন্নতি-অবনতি, আচার-অনাচার বলতে গেলে গাঁওবুড়ার বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। কোনো ব্যক্তি অন্যায় কাজ করলে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ক্ষমতা গাঁওবুড়ার থাকে। এক ব্যক্তি ইচ্ছে করলেই অন্য পাড়ায় গিয়ে বসবাস করতে পারে না। এজন্য তাকে ওই পাড়ার গাঁওবুড়ার অনুমতি পেতে হয় এবং বিধি সম্মতভাবে পাড়ার সদস্যপদ নিতে হয়। সদস্যপদ না থাকলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার যেমন অধিকার থাকে না, তেমনি সামাজিক সহযোগিতাও পাওয়া যাবে না। অসামাজিক কাজে অভিযুক্ত নারী/পুরুষ পাড়া ও চাকলার সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে তার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে সমাজ। এতে তার জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। পাড়া এখতিয়ার এধরনের সামাজিক অবরোধকে গাঁও বাইহা বলে।

ধর্ম :

লেখক হাজং নিখিল রায় ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজংরা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তবে কখন, কোন যুগে তারা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে কিংবা সনাতন হিন্দু ধর্মই তাদের প্রাথমিক ধর্ম ছিল কিনা তা বলা সম্ভব নয়। তারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। হিন্দু ধর্মের বিভাগসমূহ, যেমন শক্ত ও ভক্ত, ‍উভয় বিদই হাজংদের মধ্যে রয়েছে। তবে তারা সাধারণত কামাখ্যা দেবীর ‍উপাসক এবং নিজ হাতে কামাখ্যা দেবীর অর্চনা করে। কামাখ্যা পূজারী শ্রেণী, দেবর্ষী উপাধি ধারণ করে। কামখ্যা ভিন্ন অন্য দেবদেবীর পূজারীকে বলে ‘নংটাং’। নংটাং শুদ্ধচারী ব্যক্তি। হাজংরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। জাত কর্ম্, মৃতাশোচ্য, প্রায়শ্চ্যিতাদি প্রভৃতির ক্ষেত্রে ক্ষৌর কর্মের প্রযোজন পড়ে। নির্দিষ্ট স্থানে (শ্রেণিভেদে একাদশ ও ত্রয়োদশ দিনে) শৌচ্য কার্যাদি না করলে সমাজে পতিত হতে হয়। সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানাদি বিশেষ করে পূজা পার্বণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌথভাবে পালিত হয়ে থাকে। হাজং সমাজে অনেক বিশ্বাস সংস্কাররূপে এবং নীতি ধর্মীয় অঙ্গ হিসেবে প্রচলিত আছে। যেমন, সূর্য ডোবার সন্ধিক্ষণে কালসন্ধ্যাকে এর উপাসনা ও সৎ ভাবনার সময় বলে চিহিৃত করেছে। বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রত্যেককেই হাত মুখ ধুয়ে পবিত্র হতে হয় এবং এ সময় খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। নিতান্ত আহারের প্রয়োজন হলে উপাসনা সেরে নিতে হয়। বাইরে থেকে এসে বাইরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিয়ে তারা ঘরে ঢুকে না এবং ঢুকতে দেয় না। পাশে থাকা ঘুমন্ত মানুষকে না জাগিয়ে তারা আশেপআশের কোনো পোকা মাকড় হত্যা করে না। তারা বিশ্বাস করে, ঘুমন্ত অবস্থায় আত্মা (অবচেতন বাসনা) বিভিন্ন আকৃতিতে বেরিয়ে আসতে পারে।

আধুনিক ডাক্তারি চিকিৎসা প্রচলনের পূর্বে বিভিন্ন দেব-দেবীর ক্রোধ প্রশমন ও সন্তুষ্টি বিধান করে এবং কবিরাজি ভেষজ ও মন্ত্র চিকিৎসা সমাজে প্রচলন ছিল। অপ-দেবতা, মন্দ আত্মার প্রভাব, যাদু ক্রিয়া প্রভৃতি নির্ণয়ের জন্য বিশিষ্ট কাউকে মাধ্যম করে তাতে মন্ত্র শক্তিতে দেবতার বা উক্ত সত্ত্বার আবেশ ঘটানো এবং জনসমক্ষে আবিষ্টের স্বীকারোক্তি শ্রবণ করানো হয়। হাজংরা আত্মার অবিনাশিতায় বিশ্বাসী। দেহ ত্যাগের পরেও আত্মার সক্রিয়তায় তারা বিশ্বাস করে।

জীবনযাত্রা :

হাজাং মাতা রাশিমনি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মতিলাল হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজং পরিবার পিতৃতান্ত্রিক ও যৌথ পরিবার। অবশ্য আর্থিক চাপে পড়ে বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠেছে। পরিবারের সদস্যরা কর্তার নির্দেশ মেনে চলে। হাজংরা সূর্য উঠার আগেই শয্যা ত্যাগ করে এবং গৃহিনী বা মহিলারা সবার আগে ঘুম থেকে উঠে উঠানে গোবর সরা দেয়। তারপর তারা বাসন-কাসন পরিষ্কার করে। মেয়েরা গৃহের কাজে এবং পুরুষেরা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনে মেয়েরাও মাঠে পুরুষদের সহযোগিতা করে। স্বামীর আগে স্ত্রী খাবার গ্রহণ করে না। তারা সমতলভূমির অধিবাসী এবং তাদের জীবনযাত্রা কৃষিভিত্তিক। কৃষির উপর ভর করে তাদের অর্থনৈতিক জীবন চলে।

হাজংরা আমোদপ্রিয়। অবসর সময়গুলোতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বিশেষ করে নাচ গানের আয়োজন করে তারা। তাদের সমাজ রক্ষণশীল। রক্ত সম্পর্কের নিকটতম আত্মীয় ছাড়া নারী পুরুষ ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করতে পারে এবং অবাধ প্রশ্নে সমাজ সচেতন। তাদের প্রতিটি পরিবারেই পূজামণ্ডপ থাকে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর সন্ধ্যায় তারা মণ্ডবে প্রণতি জানায়। এসময় হাজং গ্রামগুলো কাসর ঘণ্টা ও উলু ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। কাজের ফাঁকে হাজং মেয়েরা জখা নিয়ে মাছ ধরে।  

পোশাক-পরিচ্ছদ:

বিরিশিরি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীর পরিচালক গীতিকার ও কবি সুজন হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজংদের পোশাক পরিচ্ছদে খুব বেশি বৈচিত্র্য না থাকলেও ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিছুদিন আগেও তারা নিজেদের তৈরি কাপড় পরিধান করত। ‘বোনা’ নামে পরিচিতি তাদের তাঁত খুব সাদাসিদে ধরনের। কার্পাস থেকে নিজেরা সূতা কাটতো এবং উদ্ভিদ থেকে ভিন্ন রং তৈরি করে নিত। পুরুষেরা বানার তৈরি মোটা সাদা থান ধুতির মতো পরে। এর নাম ফটা। পুরুষের তাঁতের তৈরি জামার নাম ফতুয়া।

মেয়েরা হাটুর নিচে গোঁড়ালীর উপর পর্যন্ত বুকে কাপড় পরে। এই কাপড়ের নাম পাতিন। ‘পাতিন’ বিচিত্র্য রংয়ের ডোরা টানা মোটা পাড় হয়। গায়ে চাদরের মত ব্যবহৃত কাপড়ের নাম্ আর্গন। ডোরা টানা হলেও বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকে। কাজের সময়ে মেয়েরা প্রস্থে জোট কস্পেশাকৃতি কোমড়বন্ধ ব্যবহার করে। বিয়ে ও অন্যান্য উৎসবে ব্যবহৃত কাপড়গুলোর রং এর মধ্যে থাকে এবং মেয়েরা  ওড়না ব্যবহার করে। আজকাল পুরুষেরা ধুতি এবং মেয়েরা শাড়ি পরে। হাজং মেয়েরা কবজি ভর্তি শাখা ও চুড়ি পরে। মেয়েরা দুল, বাজুবন্ধ, নখ, চিরি, পায়ের পাতা, খারু, কোমড় বিসা, বাক পুঞ্জনী ইত্যাদি অলংকার পরে।

উত্তরাধিকারী :

বিরিশিরি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীর সাবেক পরিচালক স্বপন হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হিসেবে হাজং সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন ছেলে সন্তানেরা। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ নির্বিশেষে প্রত্যেক পুত্রই সমানাধিকারী। কেবল অপুত্রক অবস্থাতেই কন্যা সন্তানেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। পর্যায়ক্রমে কন্যার ধারায় উত্তরাধিকার বাহিত এবং পুনরায় কন্যা কন্যাহীন অবস্থায় পুত্র সন্তান রেখে মারা গেলে পুনঃউত্তরাধিকার পুত্র ধারায় চালিত হয়। হাজং সমাজে দত্তক নেয়ার প্রথা আছে। দত্তককে বলে ‘পুঙহা’। বিধি ব্যবস্থায় দত্তক গৃহিত হলে দত্তক সন্তান পূর্ণ স্বত্তাধিকার ভোগ করতে পারে। পরিবারের যে কোনো সদস্যের বৈধ উপায়ে নিজ নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উপার্জনের অধিকার আছে এবং আপন সম্পত্তি হস্তান্তরের অধিকার রয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা বা কারো নামে সম্পত্তি হস্তান্তর বা উইল করে দিতে পারে।

বিয়ে:

লেখক হাজং নিখিল রায় ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজং সমাজ পুরুষ প্রধান। একজন নারী স্বভাবতই একজন পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হয়। ঘরজামাই যাওয়াকে তারা লজ্জাকর বলে মনে করে। সমাজে বহুবিবাহ ও বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ। তবু বহু স্ত্রী গ্রহণ নিতান্তই বিরল। প্রয়োজনে বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাদের সমাজে খুব বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ দেয়া যায় না। তাদের সমাজে বিবাহ বা বিচ্ছেদ কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন-স্বাভাবিক বিয়ে, দায়পড়া ও ডাঙোহামা। অভিভাবকদের সম্মতিতে বর-কনে পক্ষের মতামতে যে বিয়ে তা স্বাভাবিক বিয়ে। বিধবার পরিণয়কে হাঙা বলা হয়। বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকদের মতামতই চূড়ান্ত। অনেক সময় অভিভাবকদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত প্রেমিক প্রেমিকা পারস্পরিক ভালবাসায় গৃহত্যাগ করে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলে তা দায়পড়া বলে আখ্যায়িত হয়। এধরনের দম্পত্তিকে সামাজিক স্বীকৃতি লাভের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা মেনে নিতে হয়। প্রেমিক প্রেমিকা তাদের স্বাভাবিক পরিণয়ে প্রতিবন্ধকতা অনুভব করলে প্রেমিকা সরাসরি প্রেমিকের বাড়িয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এই অবস্থার পরিণয় সংঘটনকে ‘ডাঙোহামা’ বলে। এক্ষেত্রে দণ্ড প্রদানের বাধ্যবাধকতা আছে। চরম পর্যায়ে প্রেমিক কর্তৃক প্রতারণার সম্ভাবনা দেখা দিলে প্রেমিকা প্রতিরোধ নিতে পারে। ডায়পাড়া ও ডাঙোহামা দম্পতিরা এবং তাদের উত্তরসূরিগণ ও হাঙার নারী অনেক সামাজিক অধিকার হারায়। হাঙার নারীর বেলায় খুবই সীমিত। মোট কথা যাহু (ঘটক) এর মাধ্যমে বর-কনের সম্মতিতে অভিভাবকদের সমর্থনে বিয়ে সমন্ধিস্থ হতে হয়। সম নিকনি ও গোত্রে হাজংদের বিয়ে চলে না। বর কনের ভিন্ন নিকনি ও আত্মীয়তার গুরুত্ব থাকতে হবে এবং তাদের মধ্যে যেন রক্ত সম্পর্ক না থাকে। নিকনি ও গোত্র দু’টি ভিন্ন বিষয়। গোত্র প্রবহিত হয় পিতৃধারায় এবং নিকনি হয় মাতৃধারায়। সমাজ জীবনে নিকনি কেবল বৈবাহিক আওতায় সীমিত। হাজং সমাজে জারজ সন্তান মাতার স্থান নেই এবং সতীত্বের প্রশ্ন সর্বাগ্রে।

চাষাবাদ :

লেখক হাজং নিখিল রায় ধূমকেতু ডটকমকে জানান, কৃষি হাজংদের প্রধান উপজীবিকা। সমতল অঞ্চলের অন্যান্য জাতির মতই তারা চাষাবাদ করে থাকে। চাষাবাদকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যময় রীতিনীতি পরিলক্ষিত হয়। জমিতে হাল চালনের পূর্বে অনুষ্ঠিত হয় বাস্তুভীটির রক্ষক ও মঙ্গলকারক ‘বাস্তুদেবতার পূজা’। তারপর শুভ দিনক্ষণ দেখে হল মাত্রা করা হয়। নবান্ন ভোগের জন্য প্রথম ‘কামিজালা’ বপন এবং গৃহিনী কর্তৃক ক্ষেতে ফসল দেবীর পূজো করে প্রথম কামি ধানের রোপন উদ্বোধন করা হয়ে থাকে। সাধারণত মেয়েরা রোপনকাজ সমাধান করে। রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজেও তারা এসময় আনন্দে গান গায়। একে ‘রোয়া লাগা গান’ বলে। ক্ষেত রোপনের শেষ দিনে গৃহস্থলীর বাড়িগুলোতে পর্যায়ক্রমে ভোজের আয়োজন করা হয়, যাকে বলে ‘শেষ রোয়া ধান’ বা ‘হাল দুকা ধান’। নবান্ন উৎসবের পূর্বে গৃহিনী কর্তৃক কামি ধানের ক্ষেতে ‘আগ’ নেয়া হয় এবং উৎসবের পরদিন ঘরে দেয়ালে ‘হাদা’ ছিটানো হয়।

শিক্ষা:

বিরিশিরি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীর পরিচালক গীতিকার ও কবি সুজন হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, হাজং সমাজে স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। প্রায় প্রতিটি ঘরেই স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রত্যাশিত হারে না হলেও এক যুগ আগের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হাজং শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। আর্থিক দুরাবস্থার কারণেই অনেক মেধাবী হাজং ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ এবং সুযোগ পায় না। সুজন হাজং আরো জানান, হাজং ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষাতেই বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করে এবং অন্য সমাজের লোকজনের সঙ্গে হাজংরা বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এটি তারা নিজেদের মধ্যেই ব্যবহার করে। হাজং ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *