নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: হাইড্রোলিক হর্নের যন্ত্রণার পাশাপাশি উচ্চ শব্দের হুটার বা সাইরেনের অহেতুক ব্যবহার মানুষের অস্বস্তির কারণ হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বক্তারা হাইড্রোলিক হর্নের যত্রতত্র ব্যবহারে অতিষ্ট হওয়ার কথা তুলে ধরে তা বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদক্ষেপ চেয়েছেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নিসচার উপদেষ্টা ম হামিদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এটা চালকদের ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দেয়, তাদের বেপরোয়া করে তোলে।“
পরে নিজের বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ম হামিদ যথার্থই বলেছেন। এর আগে ঢাকার পুলিশ কমিশনারের আহ্বানে অনেক গাড়িচালক ও মালিক হাইড্রোলিক হর্ন খুলে ফেলেছিলেন।
এখন তা কেন আবার যুক্ত করা হচ্ছে তার কারণ তিনি খুঁজে দেখবেন। তিনি বলেন, “হাইড্রোলিক হর্নের পাশাপাশি উচ্চ শব্দের হুটার বা সাইরেনের অহেতুক ব্যবহার মানুষের অস্বস্তির কারণ হচ্ছে।“
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ধানমণ্ডির যে বাসায় থাকি, সরকারি বাসা সেখানে রাত আড়াইটার সময় শুনি ট্যা ট্যা শব্দ। একটা অ্যাম্বুলেন্স বোধ হয় যাচ্ছে। অথচ রাস্তা ফাঁকা, কোনো পথচারী নেই। তবুও সে সাইরেন বাজিয়েই চলেছে। আমাদের ঘুম ভাঙাল, পথচারী বা অন্য যারা রয়েছে কারও প্রতি ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই।“
নিসচার ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার এ অনুষ্ঠানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ৫০টি পরিবারকে একটি করে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবে সেই মেশিন বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নিসচার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।
২৮ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি।
আন্দোলন শুরুর সময়কার স্মৃতিচারণ করে ইলিয়াস বলেন, “তখন লোকে আমাকে পাগল বলেছিল। বলেছিল বউয়ের (মৃত্যু) শোকে আমি পাগল হয়ে গেছি। আমাকে অনেকে বোঝাতে এসেছিলেন যে দুর্ঘটনা হলো কপালের লিখন।
“কিন্তু এই ২৮ বছর পর এসে এখন সবাই জানেন দুর্ঘটনার কারণগুলো। এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনাও কমে আসবে। আমরা এ কথাটাই সবাইকে বলতে চাই, বোঝাতে চাই।“
ইলিয়াস কাঞ্চন পরিবহনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবহন কর্মীদের সন্তানদের অর্ধেক খরচে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান।
‘গভীর রাতেও হাইড্রোলিক হর্ন’
নিসচার উপদেষ্টা ম হামিদ বলেন, হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। ফলে যাদের জন্য এসব নির্দেশনা জারি হয় তারা অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন।
“আমাদের গাড়ির চালক ও মালিকদের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। যত আইনই করা হোক না কেন তারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারেন, দেখিয়ে যাচ্ছেন। গভীর রাতেও হর্ন বাজিয়ে চলেছেন চালকেরা। ছোট শিশুরা কেঁদে উঠছে।“
এমন প্রবণতায় একসময় সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে হতাশার সুরে তিনি বলেন, “সবাই ধরে নিচ্ছে যে এভাবেই আমাদের জীবন কাটবে। হাইড্রোলিক হর্নটা রাস্তার মধ্যে মানুষকে যেন ধমক দিয়ে বলে, ‘এই তুই সর এখান থেকে, আমি আসছি’।“
‘সব দায়িত্ব ও কেষ্টা ব্যাটা’
সড়ক নিরাপদ করার জন্য নিসচা এর আগে ১১১টি প্রস্তাব সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। সেটি সড়ক মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “১১১টি প্রস্তাব আপনারা যেটা সড়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন সেই দায়িত্বটাও সড়কমন্ত্রী আমার ঘাড়েই চাপিয়েছেন। কথায় বলে না ‘যা কিছু ঘটে গিন্নী বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’- আমার অবস্থা হয়েছে সেই রকম। যা কিছুই ঘটে সবই আমার কাছে আসছে।“
তিনি বলেন, এই ১১১ দফা বাস্তবায়ন এক বা দুই বছরের কাজ নয়। এটা দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রক্রিয়া।
দেশে ক্যান্সার-হৃদরোগের মতো রোগে ভুগে যে পরিমাণ মানুষ মারা যান, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষ মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে সরকারও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। শুধু যে চালক বা রাস্তার কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে তা নয়। আরও অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
আইন ভঙ্গ করার প্রবণতায় যতদিন রাশ টানা সম্ভব না হবে, ততদিন নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করা কষ্টই হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান ও নিসচার উপদেষ্টা আইয়বুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যত লোক মারা যান, আহত হন তার চেয়ে কয়েকগুণ। আর নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর চেয়ে আহত হয়ে পঙ্গু লোকদের বেদনার গল্পগুলো কম মর্মান্তিক নয়।
সভায় গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপের প্রতিনিধি সাইফুর রহমান বলেন, ইংরেজিতে সাধারণত বলা হয় ‘রোড ক্রাশ’। দুর্ঘটনা বললে তাতে মনে হয় যে এটা অনিচ্ছাকৃত, অলঙ্ঘনীয়। কিন্ত এখন সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো শনাক্ত হয়েছে।
তার মতে, বিশ্বজুড়ে প্রমাণিত কিছু ব্যবস্থা বা পদ্ধতি গ্রহণ করলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
আরো পড়ুন: