শেখ হাসিনা ::
অনেক রাত হবে। দোতলায় মায়ের ঘরে খাটে আমরা সবাই। আম্মা, আব্বা, ভাই, বোন-কেউ শুয়ে, কেউ বসে খুব গল্প করছি। আব্বাও অনেক কথা বলছেন, আমরা শুনছি। সেই আগের মতো ৩২নং বাড়িটায় সবাই আছি। বাড়িটা একদম বিধ্বস্ত। এখানে ওখানে গুলির দাগ। আমার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘরে আলনা ও একটা আলমারি রাখা আছে। বড় একটা আয়না রয়েছে। ঐ আয়নায় গুলি করেছে ফলে অর্ধেক আয়না ভেঙে গেছে। বাড়ির ইটগুলি অনেকখানি বেরিয়ে আছে। এদিকে দরজায় একটা শাড়ি ছিঁড়ে দু’টুকরো পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। মায়ের কোলের কাছে শুয়েছিলাম আমি। উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে ঢুকলাম…
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার হাতে পিতার পতাকা
হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। কেন যেন মনটাই ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। স্বপ্নটা পুরো দেখা হল না। ফোনটার উপরই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রায়ই এমন স্বপ্ন দেখেছি যে সেই আগের মতো সবাই একসঙ্গে ঐ বাড়িতে, মনে হয় যেন এই উনিশটি বছর আমাদের জীবনে আসেনি। মনে হয় মা-বাবা-ভাইদের স্বপ্নে দেখি ও কাছে পাই বলেই বুঝি বেঁচে আছি। সারাটা দিন নানা কাজে ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সভা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থেকে কাটিয়ে দিই। কিন্তু রাতে যখন ঘুমুতে যাই, তখন চলে যাই অন্য জগতে। সে জগৎ শুধু আমার একান্ত, আমার উনিশ বছর পূর্বের জীবন।
অনেক স্মৃতিভরা ধানমন্ডি ৩২নং সড়কের বাড়ির জীবনে যেন চলে যাই। সেই আগের মতো সবাই আছে। একসঙ্গে হাসছি, কথা বলছি, কখনো রাগ করছি, ভাইবোনে খুনসুটি করছি। কখনও মিছিল আসছে, কত স্মৃতি। স্মৃতি বড় মধুর! আবার স্মৃতি অনেক বেদনার, যন্ত্রণার! ঘুম ভেঙে বাস্তবজগতে এলেই সেই যন্ত্রণা কুরে কুরে খায়। যতদিন বেঁচে রব এ যন্ত্রণা নিয়েই বাঁচতে হবে।
ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি। আগামী ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি মিউজিয়াম হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। কাজ চলছে। মিউজিয়াম করতে গেলে অনেক পরিবর্তন করতে হয়। সে পরিবর্তন কমিটি করাচ্ছে। আমি প্রায়ই যাই দেখতে। দেয়ালগুলিতে যখন পেরেক ঠোকে, জিনিসপত্রগুলি যখন সরিয়ে ফেলে বুকে বড় বাজে, কষ্ট হয় দুঃখ হয়। মনে হয় ঐ পেরেক যেন আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। মাঝে মাঝেই যাচ্ছি, ঘুরে দেখে আসছি যতই কষ্ট হোক। এই কষ্টের মধ্যে ব্যথা-বেদনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ হল আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পারছি। জনগণের সম্পত্তি হবে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমাদের বড় তৃপ্তি।
আমরা তো চিরদিন থাকব না কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণের সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে। এখানেই আমাদের সান্ত্বনা। আমরা ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর এই বাড়িটিতে আসি। তারপর থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ সভা এই বাড়িতে হয়েছে। এই ১৯৬১ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত কত ঘটনা এই বাড়ি ঘিরে। মাঝখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ’৮১ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বাড়ি বন্ধ ছিল। আব্বা শাহাদাত বরণ করার পর ওরা বাড়িটি সিল করে দেয়। তারপর আর কেউ প্রবেশ করতে পারেনি।
মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মণি ভাই এই বাড়ি থেকে নিদের্শ নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব। আমি ও কামাল পেছনের শোবার ঘরে থাকি, মাঝখানে বাথরুম, তারপরই মার শোবার ঘর। তখনও বাড়িটি সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা যখন এ বাড়িতে এসে উঠি, তখন কেবল দুটো শোবার ঘর আর মাঝের বসার ঘরটা হয়েছে। ওর অর্ধেকটায় খোকা কাকা, স্নো ভাই, মণি ভাইসহ অনেক আত্মীয়স্বজন থাকত। মাঝখানে পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা বসার ঘর তখনও অসমাপ্ত। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, দেখি বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি, তার মধ্যে পুলিশ। জানালার পাশে একজন দাঁড়িয়ে আর একজন অত্যন্ত সতর্কভাবে গুটি শুটি পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি পর্দার পাশে, ঘর অন্ধকারই তাই আমাকে দেখতে পায়নি। তাড়াতাড়ি কামালের খাটের কাছে গেলাম। ওকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে চেষ্টা করলাম। ও চোখ খুলল, ‘হাস্পা কি?’
আমি বললাম, ‘পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ এ কথা বলেই তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে মাকে ডাকলাম। মা ও আব্বা যখন টের পেয়ে গেছেন। মা বললেন, “তোমার আব্বাকে ওরা অ্যারেষ্ট করবে।” ঐ বাড়ি থেকেই আব্বাকে বন্দি করে নিয়ে গেল। প্রায় পাঁচ ছয় মাস আব্বা জেলে থাকেন।
১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচতলাটা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়। মনে আছে আমাদের সে কি উত্তেজনা। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা কাকা অপেক্ষা করে আছি। বড় ফুফু, মেজ ফুফু তখন আমাদের বাসায়। আব্বা তখন ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচার কাজে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহ্কে প্রার্থী করা হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। বাসায় আমাদের একা ফেলে মা হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাছাড়া এখনকার মতো এত ক্লিনিকের ব্যবস্থা তখন ছিল না। এসব ক্ষেত্রে ঘরে থাকারই রেওয়াজ ছিল। ডাক্তার-নার্স সব এসেছে। রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট মানুষটা আর কত জাগবে। জামালের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, তবুও জেগে আছে কষ্ট করে নতুন মানুষের আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়।
এদিকে ভাই না বোন! ভাইদের চিন্তা আর একটা ভাই হলে তাদের খেলার সাথী বাড়বে, বোন হলে আমাদের লাভ। আমার কথা শুনবে, সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরানো যাবে, চুল বাঁধা যাবে, সাজাব, ফটো তুলব, অনেক রকম করে ফটো তুলব। অনেক কল্পনা মাঝে মাঝে তর্ক, সেই সঙ্গে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমরা প্রতি মুহূর্ত কাটাচ্ছি। এর মধ্যে মেজো ফুফু এসে খবর দিলেন ভাই হয়েছে। সব তর্ক ভুলে গিয়ে আমরা খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম। বড় ফুফু রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন। কি নরম তুলতুলে। চুমু খেতে গেলাম, ফুফু বকা দিলেন। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, ঘাড় পর্যন্ত একদম ভেজা। আমি ওড়না দিয়ে ওর চুল মুছতে শুরু করলাম। কামাল, জামাল সবাই ওকে ঘিরে দারুণ হইচই।
দোতলায় ওঠার সিঁড়িগুলো তখনও প্লাষ্টার হয়নি। মা খুব ধীরে টাকা জমিয়ে এবং হাউস বিল্ডিংয়ের লোনের টাকা দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেন। কাজেই অত্যন্ত কষ্ট করেই মাকে এই বাড়িটা করতে হয়েছে। আব্বা মাঝে মাঝেই জেলে যেতেন বলে সব কাজ বন্ধ হয়ে যেত। যে কারণে এ বাড়ি শেষ করতে বহুদিন লেগেছিল। আন্দোলনের সময় বা আব্বা বন্দি থাকা অবস্থায় পার্টির কাজকর্মে বা আন্দোলনে খরচের টাকাও মা যোগাতেন। অনেক সময় বাজার-হাট বন্ধ করে অথবা নিজের গায়ের গয়না বিক্রি করেও মাকে দেখেছি সংগঠনের কাজের জন্য অর্থের যোগান দিতে। কাজেই ধীরগতিতেই বাড়ির কাজ চলছিল। দোতলায় সিঁড়ি আমার খুবই প্রিয় জায়গা ছিল। হাতে একটা বই নিয়ে সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়তে খুব ভালো লাগত। কেন তা আজও জানি না। আরজু বা শেলী আসলে আমরা সিঁড়িতেই বসতাম, গল্প করতাম। কি যে একটা আনন্দ ছিল! চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ওখানে গিয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতাম।
স্কুল ছুটি হলেই বরিশাল থেকে আরজু আসত। আর ছোট ফুপার বদলির চাকরি। আব্বার ভগ্নিপতি বলে আইয়ুব-মোনায়েম সব সময় তার প্রতি এমন দৃষ্টি রাখত ঘন ঘন বদলি করত। কোথাও সাত মাস, কোথাও নয় মাস-যখন যেমন ইচ্ছা। হবিগঞ্জ থেকে রামগড়, রামগড় থেকে ঠাকুরগাঁও থেকে হবিগঞ্জ- এমনি বদলি চলতই। ঢাকা হয়েই যাবার পথ ছিল। রাস্তাঘাট তখন এত ছিল না। প্রায়ই ওরা ঢাকায় আসত, তাছাড়া ছুটিতে তো আসতই। স্কুল ছুটির সময় মেজো ফুফু, খালা সবাই আসতেন। মাটিতে ঢালাও বিছানা। বারান্দায় চুলা পেতে রান্না। আর সব মিলে লুকোচুরি খেলা। দিনরাত খেলার আর শেষ নেই। যেহেতু বাড়ির কাজ শেষ হয়নি। কাজ চলছে, কাজেই লুকোবার জায়গাও অনেক ছিল। বাসায় যখন বেশি ভিড় হতো, মিটিং থাকত, আমি ও শেলী ছাদের উপর বসে পড়তাম। অনেক সময় পানির ট্যাঙ্কির উপর বসে পা ঝুলিয়ে গলা ছেড়ে জোরে জোরে পড়তাম। বড় হয়ে গেলেও অনার্স ক্লাসের পড়াও এভাবে পড়েছি।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধের পূর্বে ১৯৬৪ সাল ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হলো। দাঙ্গায় বহু মানুষকে এ বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হল। দেশে শান্তি স্থাপনের এবং দাঙ্গা থামাবার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে পরিশ্রম করলেন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনলেন। এটা ছিল সরকারের একটা চাল। সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেবার এক কৌশল। এখনও ঐ একই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কত ঘটনা যে মনে পড়ে। এই বাড়ি যখন তৈরি হয়, ইট ভেজানোর জন্য পানির হাউজ তৈরি করা ছিল। চাচি হেলাল, মিনাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। রেহানা, জামাল, হেলাল, মিনা সারাদিন বারান্দায় খেলা করত।
আমি বারান্দায় মোড়ায় বসে বই পড়ছি আর হেলাল বারান্দায় রাখা কাঠের দরজা-জানালায় পাল্লার স্তূপের উপর বসে খেলছে। একবার নামছে, একবার উঠছে। এর মধ্যে হঠাৎ ও হাততালি দিয়ে উঠল ‘মিনা সাঁতার কাটে, মিনা সাঁতার কাটে’ বলে- জামাল দেখল, মিনা হাউসে পড়ে গেছে। হাউসে নেমে মিনাকে টেনে তুলল। আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে এলাম, বেশি পানি খায়নি, তবে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেল। মিনা আমাদের সবার অত্যন্ত আদরের। আব্বা ওকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তিনি এই খবর শুনলেই আমাদের উপর দিয়ে যে কি যাবে ভাবতেও পারছি না।
১৯৬৬ সালের কথা মনে আছে। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথম বর্ষের কয়েকটা বিষয়ের পরীক্ষা, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি! মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানে। একবার পড়তে বসি আবার ছুটে এসে জানালার পাশে বসে মিটিং শুনি। সবাইকে চা বানিয়ে দেই। যাক সেসব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হয় ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বার ফিরতে বেশ রাত হল।
আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে জনসভার গল্প শুনলাম। সেই জনসভায় আব্বাকে ছয় দফার উপর একটা সোনার মেডেল উপহার দেয়া হয়েছিল। রাত বারোটায় আব্বা শুতে বিছানায় গেলেন। আমি পড়তে বসলাম। ঐ বছরই বাড়ির দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই দোতলার পেছনের উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার। দক্ষিণের বড় জানালা। আমি খুব জোরে পড়তাম ঘুম তাড়ানার জন্য। এর মধ্যে নিচ থেকে মামার চিৎকার শুনি ‘পুলিশ এসেছে’। বাড়িতে ঢুকতে চায়।
গেটের তালা খুলতে বলে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে মামা দাঁড়িয়ে। আমি পুলিশ অফিসারকে বললাম, “আব্বা অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন। এখন রাত দেড়টা বাজে, এখন কি করে ডাকব? তাছাড়া সকালের আগে কি করে বন্দি করবেন? আপনারা অপেক্ষা করুন।” আমি তাদের গেটের বাইরে চেয়ার দিয়ে বসতে বললাম। আর এখন কিছুতেই ডাকতে পারবে না বলে জানালাম। আমি বারান্দা থেকে ঘর পেরিয়ে মাঝের বসার ঘরে এসেছি। শুনি টেলিফোন বাজছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাঝের ঘরের ছোট জানালা খোলা, আব্বা কথা বলছেন টেলিফোনে। ওপার থেকে কী বলছেন শুনছি না, তবে শুনলাম আব্বা বললেন, ‘তোমাকে নিতে এসেছে তবে তো আমাকেও নিতে আসবে।’ আমি জানালার পাশ থেকে বললাম, ‘নিতে আসবে না আব্বা, এসে গেছে অনেক আগে।’ আব্বা উঠে দরজা খুললেন।
ততক্ষণে বাড়ির সবাই জেগে আছে। রাসেল খুবই ছোট্ট। শুধু ও ঘুমিয়ে আছে। দোতলায় চায়ের ঘরে গিয়ে ইলেকক্ট্রিক কেটলিতে চায়ের পানি চাপালাম। চোখের পানি বাঁধ মানে না। মাও চোখের পানি চেপে রাখার চেষ্টা করছেন আর আব্বার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দিলেন, অনেকগুলি এরিনমোর তামাকের কৌটা দিলেন-পরে পাঠাতে অসুবিধা হয় বলে, লেখার জন্য কাগজ, কলম, খাতা সাথে দিলেন। কিছু বইপত্র এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী, মা সব গুছিয়ে দিলেন। আব্বাকে ওরা নিয়ে গেল।
ছোট্ট রাসেল অবুঝ, অঘোরে ঘুমুচ্ছে। কিছুই বুঝবে না, জানবে না। সকাল হয়ে গেল। পড়াশনা আর হল না, মনে হল বাড়িটা বড় শূন্য ফাঁকা। এতদিনের কর্মচাঞ্চল্য হঠাৎ করে যেন থেমে গেল। সারাটা দিন কারও খাওয়া-দাওয়া হল না। আত্মীয় স্বজন যারা খবর পেল, দেখা করতে এলো। আবার এতদিন যাদের দেখেছি অনেক চেনামুখ আর দেখা গেল না। তবে সুখ-দুঃখের সাথী যারা তারা ঠিকই দেখা করল। একে একে আওয়ামী লীগের বহু নেতা কর্মীকে ওরা গ্রেফতার করল।
১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনমতে তিনটা কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্মও বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়। ড্রেসিং রুমে সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাতা হয়। লাইব্রেরির কামরায় টাইপরাইটার মেশিন। আব্বা আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন বন্দিখানা থেকে মুক্তি পাবার পর। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সব নেতা ‘এবডো’ ছিলেন, অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাই ছাত্রদের সংগঠিত করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়।
আব্বা অবশ্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। সেখানে দলকে সংগঠিত করার কাজ ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জেলা, মহকুমা, থানায় গোপন সেল গঠন করেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রতি দলকে সুসংগঠিত করার কাজ গোপনে চলতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠছে। ১৯৬২-তে বহু ছাত্র গ্রেফতার হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এ বাড়িতে এসেছে গোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিতে ও আলোচনা করতে। এখন অনেকের অবস্থানই ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্মে বলে আমি কারও নাম নিতে চাই না।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আব্বাকে ঢাকা জেলাখানা থেকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ১৮ জানুয়ারি আমরা জেলগেটে গিয়ে আব্বার দেখা পাই না, কোথায় নিয়ে গেছে (বেঁচে আছেন কি না তাও জানি না।) ছোট্ট রাসেল, অবুঝ রাসেল কিছুই বুঝে না। ‘আব্বা আব্বা’ করে কেবল কাঁদে। জেলগেট থেকে ফিরে এসে এই বাড়িরে মেঝেতে গড়িয়ে আমরা অনেক কেঁদেছি। এরপর শুরু হল মিথ্যা মামলা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আব্বাকে ফাঁসি দেবার ষড়যন্ত্র। গর্জে উঠল বাংলার মানুষ। শুরু হল আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান।
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের চাপে আব্বাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। সেদিন এই বাড়ির সামনে মানুষের ঢল নেমেছিল। সমস্ত বাড়িই যেন জনতার দখলে চলে যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এসে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যেত। আব্বা কখনও গেটের পাশে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে, কখনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। আমরা আব্বার পাশে এসে দাঁড়াতাম, হাজার হাজার মানুষের ঢল নামত তখন এই বাড়ির সামনে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছিল এই বাড়িটি। রাত ১২.৩০ মিনিটে আব্বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিলেন। আর সেই খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পৌছে দেয়া হল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা তা প্রচার শুরু করলেন। এই খবর পাকিস্তানী সেনাদলের হাতে পৌঁছল। তারা আক্রমণ করল এই বাড়িটিকে। রাত ১.৩০ মিনিটে তারা আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আজও মনে পড়ে সে স্মৃতি। লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণের যে দরজা তারই পাশে টেলিফোন সেটটি ছিল ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছেন। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
২৬ মার্চ পুনরায় এই বাড়ি হানাদারবাহিনী আক্রমণ করে। মা, রাসেল, জামাল ও কামাল কোনোমতে দেয়াল টপকিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী বাড়িতে ঢুকে লুটতরাজ শুরু করে। প্রতিটি ঘর তারা লুট করে, ভাংচুর করে, বাথরুমের বেসিন কমোড আয়না সব ভেঙে ফেলে। কয়েকজন সেনা বাড়িতে থেকে যায়- দীর্ঘ নয় মাস ধরে এই বাড়ি লুট হতে থাকে। পাকসেনারা এক গ্রুপ লুট করে যাবার পর আর এক গ্রুপ আসত। সোনাদানা জিনিসপত্র সবই নিয়েছে। আমরা এক কাপড়ে সব বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমার আর মার যে গহনা লকারে ছিল সেগুলি বেঁচে যায় কিন্তু চাবি হারিয়ে যায়।
ছয় দফা দেবার পর অনেক সোনা-রূপার নৌকা, ৬ দফার প্রতীক প্রায় ২-৩ শত ভরি সোনা ছিল। এগুলি আমার ঘরেই স্টীলের আলমারিতে রাখা ছিল। সব লুট করে নিয়ে যায়। যাক, ওসবের জন্য আফসোস নেই, আফসোস হল বই। আব্বার কিছু বইপত্র, বহু পুরনো বই ছিল। বিশেষ করে জেলখানায় বই দিলে সেগুলি সেন্সর করে সিল মেরে দিত। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বানার্ড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।
জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পর পর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলিতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মার সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।
১৯৮১ সালে আমি ফিরে এসে বাড়িটি খুলে দিতে বলি, কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান অনুমতি দেয়নি। এমনকি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতিও পাইনি। মিলাদ পড়ানোর জন্য বাড়ির দরজা জিয়া খুলে দেয়নি। রাস্তার উপর বসেই আমরা মিলাদ পড়ি। জেনারেল জিয়া সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে থাকার জন্য বাড়ি দেবার প্রস্তাব পাঠান। আমি একজন স্বৈরশাসকের হাত থেকে কিছু নিতে অস্বীকার করি। আমাদের দেশে প্রচলিত নিয়ম আছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির পরিবারকে একটি বাড়ি, একটি ফোন, ভাতা, গাড়ি ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র দিয়ে থাকে (যেমন- জে. এরশাদ সরকারের কাছ থেকে তার স্ত্রী ও পরিবার গ্রহণ করতেন)। আমরা কোনদিনই কোন কিছুই গ্রহণ করিনি।
জেনারেল জিয়া নিহত হবার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার এই বাড়ির দরজা খুলে দেন। দেশে যখন আবার মার্শাল ল’ জারি হয় তখন এই বাড়িটি বিরোধী দলের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ছিল। যদিও দোতলা বা সিঁড়ি আমরা ব্যবহার করিনি কখনও, কেবল বসার ঘর আর লাইব্রেরি ঘরটা ব্যবহার করেছি, মিটিং করেছি। অনেক জরুরি পরিস্থিতিতে বহু মিটিং হয়েছে এখানে। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি আমি এই বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে মার্শাল ল’র প্রকাশ্য বিরোধিতা করি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনার নীরব সাক্ষী। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণসহ বহু ঘটনা এই বাড়িতে ঘটেছে।
আবার ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর গ্রেফতার করে আমাকে এই বাড়িতে আনা হয়। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন পর্যন্ত এই বাড়িতে গৃহবন্দি হিসেবে অবস্থান করে আমি রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাই। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের সকল কাজ এই বাড়িতে বসেই করি।
এই বাড়িটি যখন ১২ জুন, ১৯৮১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের নির্দেশে খুলে দেয়া হল তখন বাড়িটির গাছপালা বেড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। মাকড়সার জাল, ঝুল, ধুলোবালি, পোকামাকড়ে ভরা। ঘরগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুলির আঘাতে লাইব্রেরি ঘরের দরজা ভাঙা, বইয়ের আলমারিতে গুলি, কাচ ভাঙা, বইগুলি বুলেটবিদ্ধ, কয়েকটা বইয়ের ভেতরে এখনও বুলেট রয়েছে। একটা বই, নাম ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। বইটির উপরে কবি নজরুলের ছবি, বইটির ভিতরে একখানা আলগা ছবি একজন মুক্তিযোদ্ধার- বুলেটের আঘাতে বইটি ক্ষতবিক্ষত। মুক্তিযোদ্ধার ছবিটির বুকের উপর গুলি। ঠিক ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে এ বাড়িতে যে আক্রমণ হয়, তা হল ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। এ বইটির দিকে তাকালেই যেন সব পরিস্কার হয়ে যায়। কেন ওরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে? মনে হল যেন পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। মায়ের ঘরের আলমারির সব জিনিস বিছানার উপর স্তূপ করা। ঘরের মেঝেতে বড় বড় গুলির আঘাত। দোতলায় মার শোবার ঘর।
এই ঘরেই খুকী, রোজী, জামাল, রাসেলকে খুনিরা হত্যা করেছে। মা দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন, মাকে ওখানে গুলি করেছে। আব্বার বিছানার পাশের টেবিলটায় রক্তের ছোপ এখনও শুকিয়ে আছে। পূর্ব দিকের দেয়াল জুড়ে রক্তের দাগ। ছাদের উপর মাথার ঘিলু গোছা গোছা চুলসহ লেগে আছে। এই ঘরেই হত্যাকারীরা ঐ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারপর দুহাতে ঘর লুটপাট করেছে। দোতলায় সিঁড়িতে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে। দোতলায় জামালের ঘরের বাথরুমের বড় আয়নাটায় গুলির আগাতে বড় একটা গর্ত হয়ে আছে। আয়ানাটা ভেঙেছে, দোতলার বসার ঘরের পশ্চিম পাশের ঘরটা প্যান্ট্রি ঘরের মতো, ওখানে ইস্ত্রি করার টেবিলটা। পাশে ডিনার ওয়াগান, কাচের ও রূপার জিনিসপত্র ভরা, উত্তর দিকে একটা সেলফ যেখানে মায়ের হাতের আচারের বৈয়ামগুলি।
এখনও সেই আচারের ঘ্রাণ রয়েছে। একটা টিনে কিছু আতপ চাল ছিল, সাত বছর পরও চাল তেমনই রয়েছে। মিটসেপে সব জিনিসপত্র। পাশে একটা আলমারির ভিতরে তোয়ালে ও বিছানার চাঁদর থাকত, ঠিক সেভাবেই আছে। শুধু ঘরের মধ্যে মাটিতে স্তুপীকৃত কাপড় আর তুলা। তুলা ও কাপড়চোপড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। এই ঘরে কেন এত রক্তমাখা কাপড়? জানি না সেদিন কি ঘটেছিল? ঐ খুনিরাই বলতে পারে যাদের এতটুকু হাত কাঁপেনি এভাবে গুলি চালাতে। মার বিছানা ও বালিশ গুলিতে ঝাঁঝরা। জামালের ঘরের বিছানা ও বালিশ গুলির আঘাতে আঘাতে ফুটো হয়ে আছে। অনেক দুর্লভ ছবি, জরুরি কাগজপত্র, দলিল, ব্যাংকের চেকবই সব খুনিরা নিয়ে গেছে। ছবিগুলো সব নষ্ট করেছে, ছিড়েছে, পরবর্তী সময়ে পোকায় কেটেছে।
১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ আমাকে এই বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। সমস্ত বাড়ির জিনিসপত্র ১২ বছরে একদম নষ্ট হয়ে যায়। কারণ খুনিরা শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ড করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা হত্যার পর লুটপাটও করেছে। এই লুটপাট কয়েকদিন ধরে চলেছে। মা, রেহানা ও জামালের ঘরেই লুটপাটের চিহ্ন। মার ঘরের আলমারির সমস্ত কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিছানার ওপর ছড়ানো। তোষক-বালিশগুলি একদিকে বুলেটে ঝাঁজরা আবার অনেকগুলি বালিশ ছেঁড়া। দীর্ঘদিনের অযত্নের ফলে মাকড়সার জাল, পোকা ও ধুলায় সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আব্বা ও মা’র ঘরে পাশে যে ড্রেসিংরুমে আলমারিতে যেসব কাপড় ছিল তার সব দলা করে রাখা ও পোকায় খাওয়া। মনে হয় যেন আলমারি খুব ঘাঁটাঘাঁটি করেছে? কেন? অনেক মুল্যবান জিনিসপত্র এমনকি শাড়িগুলি পর্যন্ত খুনিরা নিয়ে গেছে। মেঝে ভর্তি পুরু ময়লা, পোকামাকড়, আরশোলা। সমস্ত ঘর ও আলমারিতে উঁইপোকা। সব কিছুর উপর দিয়ে কি যে ঝড় বয়ে গেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করে বোঝাবার শক্তি আমার নেই।
এই ঘরবাড়ির সর্বত্র আমার মায়ের হাতের ছোঁয়া। কিন্তু দস্যু-দানবদের হাতে সব আজ এলোমোলো হয়ে ছড়ানো-ছিটানো। সর্বত্র মনে হয় নারকীয় পিশাচের হিংস্র উল্লাস ও লুণ্ঠনের স্পর্শ। এই বাড়িতেই আমি বন্দি। ধুলায় জমে যতই দিন যাচ্ছে ততই নষ্ট হচ্ছে। বাড়িটাকে একদিন মিউজিয়াম করব, তার আগে পরিস্কার করা দরকার। মনকে শক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। জিনিসপত্রগুলোতে হাত দেয়া কি যে বেদনাদায়ক তা লিখে বোঝানো যাবে না। শুধু যারা এভাবে সব হারিয়েছেন তারাই হয়তো বুঝতে পারবেন।
আমার মা অত্যন্ত পরিপাটি গোছানো স্বাভাবের ছিলেন। প্রতিটি জিনিস অত্যন্ত সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখতেন, যাতে প্রয়োজনে সবকিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়। শীতের কাপড় এক আলমারীতে গোছানো, গরমের কাপড় অন্য আলমারীতে। তেমনি আটপৌরে কাপড়, স্যাণ্ডেল, জুতা পর্যন্ত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। মা যখন আলমারি খুলতেন দারুণ কৌতুহল হতো সবকিছু দেখার। অনেক সময় আমিও আলমারি খুলতাম, তবে মা যা বের করতে বলতেন তাছাড়া অন্য কিছুতে হাত দিতাম না। তবে মা খুললেই হাত দিতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু সব আবার গুছিয়ে রাখতে পারব না বলে হাত দেয়া হতো না। আমার মায়ের হাতের সেই সুন্দর গোছানো সবকিছু আজ দানব-খুনিদের হাতে লণ্ডভন্ড হয়ে আছে। মনকে মানিয়ে একসময় বালতি ভর্তি পানি, সাবান কাপড় ঝাড়ু নিয়ে সব ঘর পরিস্কার করতে শুরু করলাম। এত ময়লা যে একটা ঘর পরিস্কার করতে দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কাজ করেও পাঁচ-ছয় দিন সময় লেগেছে।
নিজের হাতে সব পরিস্কার করে আমার মা যেভাবে যে জিনিস যেখানে রাখতেন ঠিক সেভাবে রাখতে চেষ্টা করেছি। দু’হাতে ময়লা সাফ করেছি আর চোখের পানি ফেলেছি। শুধু মনে হয়েছে, এই জন্যই কি বেঁচে ছিলাম। কী দুর্ভাগ্য আমার। সবাই চলে গেল। আমি হতভাগিনী শুধু চোখের জলে ভাসছি আর এই বেদনা যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যেত। কাজ বন্ধ রেখে অনেকক্ষণ আকুল হয়ে কেঁদে নিতাম, আবার একসময় মনকে শক্ত করতাম। একটা জিনিসও অক্ষত রেখে যায়নি। যা পেয়েছে লুট করেছে, যা রেখে গেছে ক্ষতবিক্ষত করে রেখে গেছে। ফটোগুলো ছিঁড়েছে, কাগজপত্র ডায়েরি দলিলপত্র সব নষ্ট করেছে। যে ঘরে যত ধুলা ময়লা ছিল কিছুই ফেলিনি। বড় বড় পলিথিনের ব্যাগে ভরে রেখেছি। কেন যেন ফেলতে পারলাম না। মনে হল যেন সব কিছু, সবাই ছিল, এইমাত্র বাইরে গেছে, আবার আসবে, আবার আসবে।
সব ঘরই আমি পূর্বের মতো করে সাজাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আম্মা যেটা যেভাবে যেখানে রাখতেন ঐ ভাঙাচোরা জিনিসপত্র আবার সেইভাবে রাখতে চেষ্টা করেছি, আমার মায়ের মতো করে। যখনই কোন জিনিসে হাত দিয়েছি, বিশেষ করে মায়ের আলমারি খুলে গোছাতে গেছি- মনে হয়েছে, এইমাত্র বুঝি মা পাশে এসে দাঁড়াবেন, বকবেন ‘ঘাঁটাঘাঁটি করিসনে, গোছানো জিনিস নষ্ট হবে’ বলে সাবধান করবেন, পর মুহূর্তে মনে হয়েছে, মা তো আমার নেই। সব আছে, এই ঘর এই বাড়ি- মনে হয় মার নিঃশ্বাস যেন শুনতে পাই, পাশ থেকে তাঁর মমতার স্পর্শ যেন অনুভব করি।
অনেক স্মৃতিভরা ৩২নং সড়কের এই বাড়িটি। বাড়িটি আমাদের থাকবে না। ওটা এখন জনগণের সম্পত্তি। ট্রাস্ট করে জনগণের জন্য দান করে দিয়েছি। আমার আব্বা শুধু তো আমাদের ছিলেন না, তার থেকেও বেশি ছিলেন- জনগণের। আমরা সন্তান হিসেবে তাঁকে যতটুকু পেয়েছি, এদেশের জনগণ তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে। জনগণের কল্যাণে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। আমরা আর কতটুকু তাঁকে কাছে পেয়েছি! তাই এই বাড়িটি এত স্মৃতিভরা, এ ভার বইবার ক্ষমতা আমার নেই, রেহানারও নেই। তাই আজ আমরা আনন্দিত এ বাড়িটি জনগণকে দান করে দিতে পেরে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের। আমরা আজ গৌরববোধ করতে পারি আমাদের বহু স্মৃতিবিজরিত এই বাড়িটি আজ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রিয় তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
১০ আগস্ট, ১৯৯৪
লেখাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।