নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। দেশের মানুষের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়ে ২৭ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে খরচ করেন। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও বীমা কোম্পানি বহন করে।
চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দেশের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগ কেন্দ্রিক। জটিল জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের মাত্রাও অনেকগুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও অনেক বেড়েছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ জটিল ধরনের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়।
সুস্বাস্থ্য এখনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জিআইজেড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দক্ষ ও ফলপ্রসূ ব্যবহারের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়, সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং সংস্কার করার জন্যে প্রচলিত সরকারি নীতিমালা সময়সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় সেটি প্রায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে উঠে। পর্যাপ্ত জনবল, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ প্রয়োগধর্মী জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কর্মসূচী, সেবা প্রদান ও গরীববান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন এবং গবেষণার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বিঘ্নিত হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্দেশ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার এখনো যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য জনশক্তির আগ্রহ ও দক্ষতার অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অপ্রতুলতা বেশ দৃশ্যমান।
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওষুধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা ও প্রশাসনের জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেডারেল পদ্ধতি না থাকায় স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে অর্থের সংকুলান ও ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত। বাজেটের মাত্র ৭ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়ে থাকে, যা জিডিপি’র মাত্র ১ শতাংশ।
বর্তমানে সরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের পরিমাণ মাথাপিছু ৫ ডলার মাত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দির্দেশনা অনুসারে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবায় মাথাপিছু ৩৪ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। এভাবে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কয়েকটি বিষয় চিহিৃত করেছে। সেগুলো হচ্ছে, সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও সেবার দুর্বল গুণগতমান। আর সেবা গ্রহীতার তথা চাহিদার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের অসামর্থ্যতা, জ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ না করা।
সুস্বাস্থ্য এখনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের সক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ভূমিকা এখনো পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জনশক্তির দক্ষতা সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা স্বাস্থ্য সেবা কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে মানসম্মত প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা: মো: শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। কারণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, আরো বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর বর্তমান সরকারের ইতোমধ্যে গৃহিত ও চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য সেক্টরের বাজেট বৃদ্ধি করা দরকার। আর তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করবেন, তাদের জন্য উৎসাহ ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন বিএমএ’র সাবেক মহাসচিব।
স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোনো জাতীয় দিকনির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোনও ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও স্বাস্থ্য সেক্টরে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে মারাত্মক পানিজনিত সমস্যা বিদ্যমান। আর জলবায়ুর পরিবর্তন এ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য দারিদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কমানো এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রায় সকল পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় চূড়ান্তভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। জলবায়ু পরিবর্তন এ অঞ্চলের সকল দেশের উপর প্রভাব ফেলবে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতার কারণে সৃষ্ট ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথেষ্ঠ সক্ষম নয়। নগর পরিকল্পনা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং খাদ্য উৎপাদন ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে আন্তঃসেক্টর পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো সম্ভব।
ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বিদ্যমান জনস্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্টি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ। চলমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওই অবস্থার জন্য থাকতে হবে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু ওই ধরনের প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের।
বর্তমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। যেখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন রশিদী-ই মাহবুব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: খন্দকার মো: সিফায়েত উল্লাহ বলেন, থানা ও জেলা পর্যায়ে কম খরচে জটিল রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে দরিদ্র মানুষ উপকৃত হতো। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার জন্য ব্যয় করতে হতো না। মানসম্মত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সেবাদানকারীদের মন-মানসিকতার উপর নির্ভর করে। মানসম্মত সেবাদানের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা না থাকলে ভালো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব না। স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়নে বর্তমান সরকার বহুমুখী কমূসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছে। জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: