নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: স্বাস্থ্য বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সেক্টরের এসডিজি অর্জনের অনেক ইতিবাচক উপসর্গ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক।

এমন মজবুত অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহিত এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করা অন্যতম। এসডিজির ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছর এ স্কোর ছিল ৬৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে যখন এসডিজি গৃহীত হয়, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, দেশব্যাপী একটি ব্যাপক-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। একটি সুস্থ জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। এসব ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ। রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। আর চালু করা হয়েছে ই-হেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম।

স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কের স্তরগুলো উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রাইমারী, সেকেন্ডারী, টারসিয়ারী ও বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং উভয়মুখী রেফারেন্স পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি। যা বিশ্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে কর্মপরিকল্পনায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেশে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার মজবুত অবকাঠামো।

স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে দেশের জনগণের প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার পূরণ করছে বর্তমান সরকার। আর সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে নিজেদের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও সরকার সব সময় আন্তরিক।

তিনি আরও জানান, দেশের সাধারণ মানুষ আজ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলদেশ এখন আর শুধু শ্লোগান নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর সুবিধা পৌঁছে গেছে।  দেশের সকল পর্যায়ের হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। নির্মাণ করেছি নতুন নতুন জেনারেল হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল।

সরকার নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, নার্সিং কলেজ এবং নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। আর ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যখাতের প্রতিটি বিভাগেই জনবল বাড়ানো হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পরিকল্পিত পরিবার নিশ্চিত করতে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি।

নারী ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং জীবনমান সহায়ক নানামুখী সেবা ও সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। জাতিসংঘের মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশ্ব কৌশলপত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা দেশব্যাপী মা ও শিশুর নিবিড় পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ‘কমিশন অন ইনফরমেশন এন্ড এ্যাকাউন্টেবিলিটি অন উইমেন’স এন্ড চিল্ড্রেন’স হেলথ’ এর ১১টি সূচক ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের নিম্ন হার বজায় রয়েছে। শতকরা ৪৫ ভাগ এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ এআরভি পাচ্ছে। ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানীয় জল পাচ্ছে এবং ৮০ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবহার করছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্ত্র, জনবল ও রোগীশয্যার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

মা শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস:

মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। প্রতি হাজার জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে মরণশীলতার হার দাঁড়িয়েছে ২১ জনে, যা ২০১৫ সালে ছিল হাজারে ২৯ জন। আর ২০১৫ সালে হাজারে মৃত্যুহার ছিল ১ দশমিক ৮১, যা ২০২০ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৩ শতাংশে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক:

পুরোদমে এগিয়ে চলছে স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম। মাঠ পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট কম্পিউটার। গ্রাম এলাকার প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের সব পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে। দেশের ৬৪টি জেলা এবং ৪১৮টি উপজেলা হাসপাতালে ইতোমধ্যে একটি করে মোবাইল ফোন দেয়া হয়েছে।

ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক এবং জেলা সিভিল সার্জনের অফিসে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চালু করা হয়েছে টেলিমেডিসিন সুবিধা। স্বাস্থ্যসেবায় থাকছে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম এবং কম্পিউটারাইজড অটোমেশন ব্যবস্থা। ঘরে বসেই স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে চিকিৎসকদের পরামর্শসহ কোথায়, কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় তার পুরো গাইডলাইন তৈরি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। দেয়া হয়েছে সেবা প্রদানকারীদের নাম ও মোবাইল নম্বরসমূহ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে (www.dghs.gov.bd) প্রবেশ করে ‘ই-হেলথ’ এ ক্লিক করলেই বেরিয়ে আসবে স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ক্ষেত্র। তাৎক্ষণিক ডাক্তারী পরামর্শ গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এতে সময় ও আর্থিক খরচ বাঁচানোর পাশাপাশি দুর্ভোগ থেকেও রেহাই পাচ্ছে সেবাগ্রহিতারা।

পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ:  

পোলিও মুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। ভারতের মুম্বাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই-কমিশনার সামিনা নাজ ২০১৪ সালের মে মাসে  মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের গভর্নর কে. শংকরনারায়নন-এর কাছ থেকে এ সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন।

ধনুষ্টংকার মুক্ত বাংলাদেশ:

২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের ৬৯তম সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ধনুষ্টংকারমুক্ত সনদ গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

শিশু স্বাস্থ্য পরিসেবা:

দেশে অনুর্ধ ১২ মাস বয়সের শিশুদের সকল টিকা প্রাপ্তির হার ৮২ ভাগ। এক্ষেত্রে হাম ৮৫ ভাগ, ওপিভি ৯৩ ভাগ, বিসিজি ৯৯ ভাগ  ও  ডিপিট ৩/ পেন্টা ৩ সফলতা পেয়েছে ৮৯ ভাগ।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার :

বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে। এছাড়াও ২০০৯ ও ২০১২ সালে ২ বার গ্যাভি পদক পেয়েছে। শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের অঙ্গীকার এ সাফল্যের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ফ্রি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস:

অবশেষে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ফ্রি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের বাস্তবায়ন শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দেশের প্রতিটি হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সকলকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে একটি জরুরি নির্দেশা প্রেরণ করা হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক :

প্রতিদিন প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে ৩৮ জন সেবাগ্রহীতা আসছেন। ২৯  প্রকারের ওষুধ বিনামূলে প্রদান করা হচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে গর্ভবতী মায়েদের স্বাভাবিক ডেলিভারি হচ্ছে। এ পর্যন্ত স্বাভাবিক ডেলিভারি লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সারাদেশে প্রায় ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার(সিএইচসিপি) স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।

চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন :

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি ঘটেছে। ‍সব ধরনের জটিলরোগের উন্নত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে নানা আলোচনা হতে পারে। নামমাত্র খরচে বিভিন্ন জটিলরোগে আক্রান্ত দেশের বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি, বারডেম হাসপাতালের অভিভাবক অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, দেশের চিকিৎসাসেবায় প্রশংসনীয় উন্নতি হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক অত্যাধুনিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল গণি মোল্লা ধূমকেতু ডটকমকে জানান, গত এক যুগে দেশের চিকিৎসাসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। বিদেশগামী রোগীর সংখ্যাও কমে গেছে। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *