স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: করোনার ভয় কেটে দেশে বিরাজ করছে স্বাভাবিক অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত কয়েকদিন ধরে দেশের দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দেশের মানুষ যেন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র চলছে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার প্রতিযোগিতা। পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা, মুখে মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠছে অনেকে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে পরামর্শদানকারীর উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

রাজধানীর মগবাজার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের গলি সামনে বেশ কয়েকটি ভাসমান চা দোকান বসে। বিকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে এই এলাকা। কারো মুখে মাস্ক নেই। গা ঘেঁষে  দাঁড়িয়ে দলবদ্ধভাবে চলে আড্ডা। শারীরিক দূরত্বের কোনো বালাই নাই।

চা দোকানদার মো. ফারুক ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। দুই মাস আগেও চায়ের কাপ গরম পানিতে ভালোভাবে ধোঁয়ার অনেক আবদার ছিল। এখন আর তা নেই। কাউকে মাস্ক পরতেও দেখি না, আমি নিজেও মাস্ক পরা বন্ধ  করে দিয়েছি  বলে জানান মো. ফারুক।

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার চিত্র আরও ভয়াবহ। সিট ভর্তি হওয়ার পরও মাঝখানে দুই সারিতে গাদাগাদি। করে যাত্রী তোলা হয়। সিটে বসা যাত্রীদের মুখের সংস্পর্শে চলে যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মুখ। ঘটছে পারস্পরিক শ্বাস প্রশ্বাসের বিনিময়। খুব সহজেই একজনের শরীরের জীবাণু অন্যদের শরীরে প্রবেশ করে করোনা ভা্ইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। বাসের যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকি একটু বেশি রয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিক্রেতা ও ক্রেতা -অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। মাছের বাজারের অবস্থা আরও করুণ। স্বাস্থ্যবিধি  তোয়াক্কা করে না কেউ। বিক্রেতার খুব কাছে গিয়ে দর-দাম করছে ক্রেতারা। মাছ বিক্রেতা মো. মনসুর ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা ভাইরাসের কথা আর বলবেন না। অনেক আগেই করোনা ভাইরাস চলে গেছে। করোনা ভাইরাসের ভয় থাকলে  নানা নিষেধাজ্ঞা দিত সরকার । করোনা নাই বলেই সরকারও চুপচাপ। করোনা কমে যাওয়ায় দেশের মানুষ মাস্ক পরা বন্ধ করে দিচ্ছে বলে দাবি করেন মো. মনসুর।

সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলে প্রতদিনই ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনায় মুখরিত; কিন্তু ক্রেতা বা বিক্রেতাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। মাস্ক পরা বা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি বেমালুম উধাও। অবস্থাদৃষ্টে যে কারোরই মনে হবে দেশে করোনা নামক কোনো ভাইরাসের উপস্থিতি নেই! এর আগে রাজধানীর মার্কেট বা শপিংমলের সামনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও এখন সেটা নেই। এসব নিয়ে কোনো তদারকিও দেখা যায়নি। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে- যা অত্যন্ত শঙ্কাজনক।

শুধু শপিংমল নয়, জনসমাগম হয় এমন স্থান, হাসপাতাল, গণপরিবহণ সবখানেই যেন স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার প্রতিযোগিতা চলছে! ফলে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। লঞ্চ এবং ফেরিতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই গাদাগাদি করে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহার এবং দূরত্ব রেখে যাত্রীদের বহনের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাস্ক পরার আগ্রহও নেই। সরকারি-বেসরকারি অফিসেও ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়টি সামনে আসছে।

গত কয়েক মাস ধরে চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণায় বিশেষ করে সভা, সমাবেশ ও মিছিলে গাদাগাদি করে অংশ নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেখানে স্বল্প জায়গায় মিলন ঘটছে বিপুল সংখ্যক মানুষের। সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। অর্থাৎ সারাদেশে চলছে স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার প্রতিযোগিতা।

এদিকে, স্বস্তিদায়ক হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা ইতোমধ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশে বিস্তারলাভ করেছে। বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের অনেক দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা ভাবার সময় আসেনি। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় সংক্রমণের ভয়াবহ রূপ ফিরে আসতেও সময় লাগবে না। তাই বাইরে বের হলে ন্যূনতম মুখে মাস্ক পরতেই হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে সতর্কতাবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রত্যেক মানুষকে হতে হবে সচেতন এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশের স্থানগুলোতে রোগ শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন  ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন ভেরিয়েন্ট আসার জন্য বসে থাকা উচিত হবে না। সময় নষ্ট না করে স্বাস্থ্য বিভাগকে মাঠে নামতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের(আইইডিসিআর)  উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনার নতন  ভেরিয়েন্ট নিয়ে পর্যবেক্ষণ চলছে। দেশে করোনার সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। চিকিৎসা সেবার অবকাঠামোও সাজানো রয়েছে। তবে নতুন ভেরিয়েন্ট যাতে আমাদের দেশে ভয়াবহ রূপ নিতে না পারে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। করোনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আমরা সকলেই কম বেশি অবগত আছি। তাই সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি  মেনে চললে নতুন ভেরিয়েন্ট বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারবে না বলে জানান ড. মুশতাক হোসেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলেছে :

২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, নতুন ভেরিয়েন্টটি নিয়ে এ পর্যন্ত মূল্যায়নে দেখা যায় আগের ধরনগুলোর চেয়ে নতুন ধরনটির ছড়িয়ে পড়ার গতি দ্রুততর। এর অর্থ হচ্ছে নতুন ধরনের মাধ্যমে সংক্রমণ ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা আছে।  এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্যদেশগুলোকে চারটি পদক্ষেপ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে: নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি নতুন ভেরিয়েন্টটি সম্পর্কে জানতে জিন বিশ্লেষণ করতে হবে; পূর্ণাঙ্গ জিন বিশ্লেষণের তথ্য সর্বসাধারণের জানার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে; নতুন রোগী শনাক্ত হলে বা সংক্রমণ গুচ্ছ আকার ধারণ করলে তা বিশ্ব সংস্থাকে জানাতে হবে এবং নতুন ভেরিয়েন্ট এর  সংক্রমণের তীব্রতা, রোগনির্ণয় পদ্ধতিসহ বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক উদ্যোগের কার্যকারিতা বোঝার জন্য কাজে সমন্বয় বাড়াতে হবে।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলেছে, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলার পাশাপাশি টিকা নেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

আরো পড়ুন:

স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করার কোনো সুযোগ নেই : হু-র প্রধান বিজ্ঞানী

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *