অভিমত

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মানুষের জীবিকা- উভয় সংকট নিয়েই এগুচ্ছে সরকার

ধূমকেতু বিশ্লেষণ:

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির মুখে লকডাউন শিথিল করে গার্মেন্টস কারখানা চালু করার পর এখন শপিংমলও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা ।

সংক্রমণের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে নাকি অর্থনৈতিক চাপের কারণে সরকার এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে- বিশেষজ্ঞদের অনেকে এই প্রশ্ন তুলেছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, গার্মেন্টস চালু করা এবং মার্কেট খোলার কারণে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।

সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ বলেছেন, মানুষের জীবিকার প্রশ্ন এবং অর্থনীতি যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে- এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকার বাধ্য হয়ে সীমিত পরিসরে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে।

যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশে লকডাউন কতদিন থাকবে, সেটা নির্ভর করবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শের ওপর। এই কমিটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সেই পরামর্শ বা সুপারিশ তৈরি করবে।

কিন্তু একইসাথে এরই মাঝে গার্মেন্টস কারখানাগুলো চালু করার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের ঢাকায় ফেরার দৃশ্য দেখা গেছে। এখন আবার ১০ই মে থেকে শপিংমলগুলো খোলারও অনুমতি দেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন দেশে বাড়ছে, তখন সরকারের এই পদক্ষেপ বিজ্ঞানভিত্তিক বা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে নেয়া হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে যে টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির একজন সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, দেশে সংক্রমণের পরিস্থিতি নিয়ে এখনও কোনো বিশ্লেষণ হয়নি এবং বিজ্ঞান বিবেচনা করে সরকার এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেছেন, “পরিস্থিতির বিশ্লেষণ নাই। এটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে করা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর ওপর তো অনেক চাপ। আমরা স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে বলছি লকডাউন করতে। আবার যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে, তারা চাপ দিচ্ছে যে, না খুলে দিলে আমাদের ক্ষতি হবে। এনিয়ে সব মিলিয়ে উনি একটা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।”

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেছেন, “গার্মেন্টস কারখানা যে খুলে দিলো, আর এই যে দোকানপাট খুলে দিচ্ছে, এখন এগুলো খুলে দেয়ার পর সরকার হয়তো এর প্রভাব দেখবে।”

লকডাউনের মাঝে কাঁচা বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। এতদিন লকডাউন কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়েই প্রশ্ন ছিল। এখন দোকান পর্যন্ত খুলে দেয়ার বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও মন্তব্য করেছেন।

টেকনিক্যাল কমিটির সাথে বৈঠকের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, গার্মেন্টস খুলে দেয়া এবং দোকানপাটে মানুষের আনাগোনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।

সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে কোনো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার এসব সিদ্ধান্ত হয়নি। এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি অর্থনৈতিক বাস্তবতার কথা তুলে ধরেন।

“তেমন বিজ্ঞানসম্মত কোনো বিশ্লেষণ আছে বলে আমি মনে করি না। এটা মূলত অনেকদিন হয়ে গেছে। যারা বেসরকারি বা ইনফরমাল খাতে কাজ করে, তাদের সংখ্যা তো অনেক। সরকারি চাকরি করে এবং মাস গেলেই বেতন পাবে- এই সংখ্যার মানুষ খুবই কম। এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।”

ড: রাজ্জাক আরও বলেছেন, “দোকানে সেলসম্যানসহ নানান পেশার মানুষ আছে। দোকানগুলোর সামনে ঈদও রয়েছে। এসব নানা দিক বিবেচনা করে পরিবহন বা স্কুল কলেজ না খুলে, সরকার বাধ্য হচ্ছে মানুষের জীবিকার বিষয়গুলোতে কিছুটা শিথিল করতে।”

তিনি আরও বলেছেন, একদিকে সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে, অন্যদিকে মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতি- এই উভয় সংকট নিয়ে সরকারকে এগুতে হচ্ছে।

ঢাকার রাস্তাগুলোতেও এখন যানবাহন এবং মানুষের চলাচল বাড়ছে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শিল্পমালিকসহ বিভিন্ন মহলের চাপের কারণেই সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল করছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির বক্তব্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক চাপের কারণে সীমিত পরিসরে কিছু খাত চালুর অনুমতি দেয়া হয়েছে।

“স্বল্প আকারে খোলার চিন্তা করা হয়েছে। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। খুব করে বলা হচ্ছে, সবাই সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন কাজ করে।”

তিনি বলেছেন, “এখন সাধারণ মানুষ এবং দোকানদার থেকে শুরু করে সবার প্রয়োজনতো রয়েছে। যাহোক, কারখানা যেটা খোলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তা খুলতে বলা হয়েছে এবং সেটা মনিটরিং করা হচ্ছে। এখন কোনো অবস্থাতে তো স্বাভাবিক জীবনের দিকে যেতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি তো মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই একটা ব্যালেন্স করে চেষ্টা করা হচ্ছে, সীমিত আকারে হলেও অর্থনীতি যেন সচল রাখা যায়।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গার্মেন্টস কারখানাগুলো চালু হওয়ার ১৪দিন হবে আগামী ১২ই মে। সেখানে কোনো সংক্রমণ হলো কিনা- তা বিশ্লেষণ করা হবে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, শপিংমল বা অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলার পরে সেই পরিস্থিতিরও বিশ্লেষণ করা হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করার পর এসব চালু রাখা না রাখার প্রশ্নে স্বাস্থ্য বিভাগের সুপারিশ সরকারকে দেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *