স্বাস্থ্য

সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন কমাতে পারে হৃদরোগের ঝুঁকি

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। কার্ডিয়াক, থোরাসিক ও ভাসকুলার সার্জারীর রোগীর ৯৫ ভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এমনটি দাবি করেছেন দেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হৃদরোগে আক্রান্তদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমেছে। দেশের কার্ডিওলজিস্ট ও কার্ডিয়াক সার্জনরা এখন অনায়াসে হৃদরোগের বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যা চিহ্নিত করে মেডিসিন ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুচিকিৎসা প্রদান করছেন। নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত হাজারো রোগী। সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন হৃদরোগের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল অনুসারে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশের পেছনে দায়ী হৃদরোগ। সংখ্যার হিসেবে যা প্রায় পৌনে ২ লাখ। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের তথ্য বলছে, দেশে অসংক্রামক রোগে প্রাণ হারায় ৬৭ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এতে আক্রান্তের গড় আয়ু ৬০ বছর হলেও বাংলাদেশে তা ৫০ বছর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যার্নাজি  জানান, হৃদরোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে যদি কারো পরিবারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থাকে সেক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের করার তেমন কিছু থাকে না। হৃদপিণ্ডের মধ্যে চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয়। ডান ও বাম অলিন্দ একটি পর্দা দ্বারা পৃথক থাকে এবং ডান ও বাম নিলয়ও আরোও একটি পর্দা দ্বারা পৃথক। যদি দুই অলিন্দের মাঝখানের পর্দার কোনও ছিদ্র থাকে তাকে এএসডি বলে। আর যদি দুটি নিলয়ের মাঝখানে পর্দার মাঝে কোনও ছিদ্র থাকে, তখন তাকে ভিএসডি বলে। এ সমস্যায় অক্সিজেনযুক্ত রক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডযুক্ত রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সাধারণত শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

হৃদরোগের ঝুঁকির কারণসমূহ উল্লেখ করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মু. সালাউদ্দিন ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, কোনো সমস্যা বোধ করছেন না, বুকে ব্যথা করে না কখনো, অনেক পরিশ্রমও করতে পারেন, তার মানে কোনো দিন হার্ট অ্যাটাক হবে না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে ঝুঁকি কতটুকু আছে, তা জেনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে অকালমৃত্যু বা কঠিন পরিণতি এড়ানো যায়। ধূমপানের অভ্যাস, পরিবারে হার্ট অ্যাটাক বা অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি, কায়িক শ্রমবিহীন জীবন যাপন, স্থূল বা ওজন বেশি, প্রচণ্ড মানসিক চাপ ইত্যাদি সমস্যা যার যত বেশি থাকবে অ্যাটাকের ঝুঁকিও তত বেশি থাকে।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণসমূহ নিয়ে ডা. মু. সালাউদ্দিন ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, বেশির ভাগ সময় হার্ট এ্যাটাকে বুকের মধ্যে চাপ বোধ হয়, যা কয়েক মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকে। ব্যথাটা মাঝেমধ্যে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। একটা অস্বস্তিকর চাপ ও ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। অনেক সময় বাহু, পিঠ, ঘাড়, চোয়াল অথবা পাকস্থলীতেও অস্বস্তি অনুভূত হয়। অনেক সময় বুকে অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস ছোট হয়ে আসে। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে ঘাম দিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা হালকা মাথাব্যথা, পিঠে বা চোয়ালে ব্যথা হতে পারে।

ডা. মু. সালাউদ্দিন আরো বলেন, কারও হার্ট অ্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম এক ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার, অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসকের জরুরি চিকিৎসা নিতে পারলে রোগীর প্রাণ রক্ষা প্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব। হার্ট অ্যাটাক বা গ্যাসের কারণে বুকব্যথা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে অনেক সময় চলে যায়। বুকে ব্যথা চরমে উঠলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। রোগীর জীবনসংশয় দেখা দেয়। তারপরও চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন। যদি হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা কম হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো প্রাণ রক্ষা পায়। কিন্তু বাকি জীবন কষ্ট করে চলতে হয়। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপিণ্ডের কিছু অংশ অকেজো হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম ঝুঁকিতে পড়তে হয়। তাই একটু বেশি বয়সীরা বা যারা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের বুকে ব্যথা হলে অবহেলা না করে অন্তত একটা ইসিজি করে দেখতে পারেন।

হার্টের ধমনীতে ব্লক ও চিকিৎসার বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, আমাদের সারা দেহে ছড়িয়ে আছে দুই ধরনের রক্তনালি- ধমনী ও শিরা। ধমনীর কাজ হল অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়া। ধমনীর প্রবাহপথ কোনও কারণে সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, এই বাধাকে বলে ‘ব্লক’।হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর নাম ‘করোনারি ধমনী’। এ করোনারি ধমনীতে ব্লক সৃষ্টি হলে তাকে বলে ‘ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ’। ধমনীতে ব্লকের মূল কারণ কোলেস্টেরল যা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ধমনীর ভেতরের গায়ে জমা হয়ে ব্লকের সৃষ্টি করে।

কোলেস্টেরলই ব্লকের একমাত্র কারণ নয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং ধূমপানকেও বড় কারণগুলোর অন্যতম মনে করা হয়। করোনারি ধমনীতে ব্লক থাকলে এসব উপসর্গ দেখা যায়- বুকের বামপাশে বা মাঝখানে এক ধরনের ব্যথা বোধ হয়। অনেক সময় বাম হাতের ভেতরের দিকে অস্বস্তি বোধ হয়। নিচের চোয়ালে বা দাঁতের পাশেও এক ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। 

প্রাথমিক অবস্থায় কেবল শারীরিক পরিশ্রমের সময় এই ব্যাথা অনুভূত হয় এবং বিশ্রাম নিলে কমে যায়। মনে রাখতে হবে যে, ব্লক থাকলেই যেসব সময় ব্যাথা হবে, এমন নয়।  তিনি বলেন, ব্লক থাকলে নিয়মিত চিকিৎসা না নিলে তা হার্ট অ্যাটাকের দিকে মোড় নিতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপেশি মারা যেতে শুরু করে বলে বুকে তীব্র ব্যথার সঙ্গে বমি ও প্রচুর ঘাম হয়। হার্ট অ্যাটাক ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের খুবই মারাত্মক এক পরিণতি যা প্রায়ই রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  যারা দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বুকে তীব্র ব্যথা, ঘাম, বমি- এসব লক্ষণ ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। একে বলে ‘সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক’।

ব্লকের চিকিৎসার বিষয়ে ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার বলেন,  প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধের মাধ্যমে ব্লকের চিকিৎসা সম্ভব। মারাত্মক ব্লকের ক্ষেত্রে প্রথমে অ্যানজিওগ্রাম পরীক্ষা করে ব্লকের স্থান ও তীব্রতা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর সম্ভব হলে কাঁটাছেঁড়া ছাড়াই রিং বসিয়ে ব্লক দূর করার চেষ্টা করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ পদ্ধতির নাম পারকিউটেনিয়াস করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি সংক্ষেপে পিসিআই। ব্লক যদি সংখ্যায় বেশি হয়, রিং বসানো সুবিধাজনক নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের দেশে হার্ট অ্যাটাকের পরও অধিকাংশ রোগী দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। যদি দু’চার ঘণ্টার মধ্যেও রোগীকে হার্টের আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে আনা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যানজিওগ্রাম ও অ্যানজিওপ্লাস্টি করে ব্লক দূর করা যায়। এ পদ্ধতিকে বলে প্রাইমারি পিসিআই। প্রাইমারি পিসিআই করা গেলে হার্ট অ্যাটাকের কারণে হৃৎপেশির সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহবুব আলী বলেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন আন্তর্জাতিক মানের। দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। আগে চিকিৎসার জন্য শত শত রোগী দেশের বাইরে গেছেন। তখন বাইপাসসহ জটিল সার্জারিগুলো দেশে হতো না। বর্তমানে এই জটিল অপারেশনগুলো দেশেই হচ্ছে।

দেশের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ও ল্যাবএইড হাসপাতালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন ডা. লুতফর রহমান বলেন, বাইপাস সার্জারি, স্টেন্টিং এখন শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশে হচ্ছে। হার্টের কোনো সমস্যাই আমরা বড় ইস্যু মনে করি না।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন বলেন, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন হৃদরোগ হাসপাতালে কার্ডিয়াক, থোরাসিক ও ভাসকুলার সার্জারীর রোগীর ১০ হাজারেরও বেশি অস্ত্রোপচার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ ভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন হৃদরোগের ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস করাতে পারে।

আরো পড়ুন:

ভারতে ৭ বছরের শিশুরাও পাবে করোনার টিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *