দেবযানী দত্ত, ধূমকেতু বাংলা :
খেলাধুলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অংশ এবং বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বাংলাদেশে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক ধরনের খেলার প্রচলন আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ক্রীড়াঙ্গন বিভিন্ন সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে দেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ক্রিকেট, ফুটবল। বিশ্বকাপের মতা বড় আন্তর্জাতিক আসরে খেলায় ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আকর্ষণের জায়গা। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হচ্ছে কাবাডি। বাংলাদেশের সমস্ত ক্রীড়া ফেডারেশন এবং কাউন্সিল দেখাশোনা করে ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল। এবার দেখে নেয়া যাক, স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রগতি।
বাংলাদেশ গেমস :
বাংলাদেশে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, কাবাডি, দাবা, সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স এবং ব্যাডমিন্টন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। বর্তমানে আরও কিছু খেলা অনুষ্ঠিত হয় যেমন- গলফ, ভলিবল, বাস্কেটবল, শুটিং, সাইক্লিং, বক্সিং, কারাতে টেবিল টেনিস ইত্যাদি। তবে এই খেলাগুলোর অনেকগুলোই ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় নয়।
দেশের বেশিরভাগ পুরুষ ও নারী ক্রীড়াবিদ জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়, সশস্ত্র বাহিনী ও পাবলিক সেক্টরের রয়েছে ক্রীড়া দল। ক্রীড়া কার্যক্রমের প্রতি দেশের আগ্রহের ফলশ্রুতিতে বিপুল সংখ্যক ক্রীড়া ক্লাব গড়ে উঠেছে। কয়েকটি নামকরা ক্লাব হলো- ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আবাহনী ক্রীড়াচক্র, ঢাকা মোহামেডান, আরামবাগ, এজাক্স, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, আজাদ, দিলকুশা, জিএমসিসি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সূর্যতরুণ, কলাবাগান, ভিক্টোরিয়া এবং ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব।
ক্রিকেট
ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশের মানুষ এই খেলা খেলতে এবং দেখতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল ২০০০ সালে টেস্ট ক্রিকেট খেলার অনুমতি পায়। বর্তমানে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল সব ফরম্যাটের ক্রিকেট খেলে।
ব্রিটিশদের শাসন আমল থেকেই বাংলাদেশে ক্রিকেটের অস্তিত্ব ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলার প্রচলন করে। বাংলায় প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ রেকর্ড করা হয়েছিল ১৭৯২ সালে।
১৯৭২ সালে, দেশে ক্রিকেট প্রতিভা লালন ও বিকাশের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম সংগঠিত প্রতিযোগিতাটি ছিল ১৯৭৩ সালে ক্লাব-স্তরের ঢাকা মেট্রোপলিস নকআউট টুর্নামেন্ট। একটি জাতীয় ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে শুরু হয়েছিল এবং এটি ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত খেলা হয়েছিল। প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এমসিসির বিরুদ্ধে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। এমসিসির বিরুদ্ধে তাদের পারফরম্যান্সের পর, বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্য পদ লাভ করে।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস
বাংলাদেশ ২০০০ সালে আইসিসির পূর্ণ সদস্য হয় এবং দশম টেস্ট খেলার দেশ হয়ে ওঠে। তারা ২০০০ সালে ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে তাদের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে। বাংলাদেশ ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট তৈরি করে।
২০০৫ সালের জানুয়ারিতে, জিম্বাবুয়ে দুটি টেস্ট এবং পাঁচটি ওডিআই ম্যাচের জন্য বাংলাদেশ সফর করে এবং সেই সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টেস্ট জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ইমানুয়েল হক জুনিয়র, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ রফিক। বর্তমানে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে ৫ম স্থানে আছে।
ওডিআই ইতিহাস
ওডিআই বাংলাদেশে খেলা ক্রিকেটের প্রাচীনতম ফর্ম। আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পর, বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে টাইরোন ফার্নান্দো স্টেডিয়াম, মোরাতুওয়াতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম ওডিআই ম্যাচ খেলে। এটি ছিল জন প্লেয়ার গোল্ড লিফ ট্রফির ২য় ম্যাচ, যা এখন এশিয়া কাপ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফির ১৯৭৯, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ মৌসুমে অংশ নেয়। তারা ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতেছিল এবং অবশেষে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
তারপর থেকে, বাংলাদেশ অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছে এবং ওডিআই ক্রিকেটে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছে। সাকিব আল হাসান যখন আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হন, তখন বাংলাদেশ ওডিআই ক্রিকেটে তার শীর্ষে ছিল, তিনি এই তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র খেলোয়াড় ছিলেন। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ ২০১৫ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। বাংলাদেশ ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি ১ম স্থানে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
২০০৬ সালের নভেম্বরে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ তাদের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে এবং অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের কারণে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান মাশরাফি বিন মুর্তজা।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কৃতিত্বের সাথে খেলে আসছে।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পাশাপাশি বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল ওমেন এশিয়া কাপের বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ দেশের মাটিতে নিয়ে আসে।
ফুটবল
ফুটবল বাংলাদেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা। এই বাংলায় ফুটবল প্রেমী নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এটি ১৯৭৪ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন এবং ফিফার সদস্য হয়।
এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সবচেয়ে বড় জয় মালদ্বীপের সাথে ৮-০ গোলের ব্যবধানে, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে।
এছাড়া ফুটবল খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত রাখার জন্য বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (ফুটবল) অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ১২টি দল অংশগ্রহণ করে। সর্বশেষ ২০২০-২১ বর্ষের শিরোপা জিতে বসুন্ধরা কিংস।
হকি
নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯০৫ সালের দিকে ঢাকায় খেলাটি চালু হয়। তখন এই খেলাটি নবাব পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন’ গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় একটি স্টেডিয়াম তৈরি হয় যা মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম নামে পরিচিত।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক আমন্ত্রণমূলক হকি টুর্নামেন্টও আয়োজন করেছিলেন যেখানে ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা অংশগ্রহণ করেছিল।
হকি ফেডারেশন এখন নিয়মিতভাবে হকি লীগ, টুর্নামেন্ট এবং জাতীয় যুব ও সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করে।
কাবাডি
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন কম কিছু নয়। ২০০৬ সালে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে। ১৯৮০ ও ১৯৮৮ সালে এশিয়ান কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স আপ হয়।
এছাড়া দেশে-বিদেশে অনেক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ কাবাডি দল অংশগ্রহণ করে থাকে।
চেজ
বাংলাদেশ চেজ ফেডারেশন গঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। কাজী মোতাহার হোসেন এই ফেডারেশন গঠিত করেন এবং ১৯৮৫ সালে ফেডারেশন তার নামে আন্তর্জাতিক মাস্টার্স দাবা টুর্নামেন্ট শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে চেজ খেলা শুরু করেছে। এই আসরে বাংলাদেশের তিনটি আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার রয়েছে।
গলফ
বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত।এই ফেডারেশনে মোট ১৪টি গলফ ক্লাব যুক্ত আছে। সিদ্দিকুর রহমান প্রথম বাংলাদেশি গলফার যিনি এশিয়ান ট্যুর ইভেন্ট জিতেছেন।
এছাড়া বাংলাদেশে আরও অনেক খেলা রয়েছে যেমন ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল ইত্যাদি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই খেলাগুলার ফেডারেশন গঠিত হয়। বর্তমানে এসব ফেডারেশনের অধীনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজন করা হয় এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ অলিম্পিকসহ নানা ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে।
ক্রীড়াঙ্গনে বাংলার রত্ন
পুরুষ:
সোহাগ গাজী – প্রথম খেলোয়াড় যিনি একই টেস্ট ম্যাচে সেঞ্চুরি ও হ্যাট্রিক করেন।
মোহাম্মদ আশরাফুল – টেস্ট সেঞ্চুরি করা সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড়।
নাইম হাসান – টেস্ট অভিষেকের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী পাঁচ উইকেট নেন।
আলি জ্যাকো – প্রথম এশিয়ান যিনি বিস লাইটওয়েট কিকবক্সিং খেতাব জিতেছেন।
সাকিব আল হাসান – প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেটার যিনি আইসিসি দ্বারা সমস্ত ফরমেটে এক নম্বর অলরাউন্ডারের র্যাঙ্ক পেয়েছেন।
মুসফিকুর রহিম – প্রথম উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান যিনি দুটি টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন।
নিয়াজ মুরশেদ – দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জনকারী প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান।
নারী :
শিরিন আক্তার – বাংলাদেশি স্প্রিন্টার যিনি ২০১৬ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে খেলেছিলেন। ১০০ মিটার দৌড়ে একাধিক শিরোপা জিতেছেন। মোট ২৭টি স্বর্ণ এবং ৬টি রৌপ্য জিতেছেন।
সাবিনা খাতুন – বাংলাদেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক ফুটবলার। ২০০৯ সালে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং তার অসাধারণ খেলার জন্য ৪ বছরের মধ্যেই তিনি দলের অধিনায়ক হন।
মাবিয়া আক্তার – ২০১৬ সালে এশিয়ান গেমেসে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
সোনিয়া আক্তার টুম্পা – ২০১০ এবং ২০১৬ এসএ গেমসে দুটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন।
শ্যামলী রায় – তিনি জাতীয় পর্যায়ে আরচারিতে মোট ৬টি পদক জিতেন।
জবেরা রহমান নিলু – ১৯৭৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ১৬টি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপ জিতেছেন। তার অসাধারণ টেনিস দক্ষতা এবং কৃতিত্বের জন্য তাকে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় বাংলার মাটিতে অনেক বিখ্যাত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তাদের কৃতিত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে গর্বিত করেছেন। আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অর্জন এসেছে ক্রিকেট থেকে। তবে অন্যান্য শাখার ক্রীড়াবিদেরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে, যা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে সকলের সামনে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ সরকার ও তার মন্ত্রিসভা বাংলার ক্রীড়াঙ্গন উন্নত করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন স্বাগতিক দল হিসেবেও স্বগর্বে খেলে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট, ফুটবল ও নানা ধরনের খেলার মাঠসহ অনুশীলনের স্থানও তৈরি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করার জন্য নানা ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়। আশা করা যায় আগামীতে বাংলাদেশ আরও বিজয় ছিনিয়ে আনবে এই বাংলার মাটিতে।
আরো পড়ুন: