ইব্রাহীম খলিল জুয়েল ও নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: দেশের স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত করে মানুষের দোরগোড়ায় উন্নত চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে মতামত দিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব এবং ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম. এ. আজিজ।
স্বাস্থ্য প্রশাসনে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলে চিকিৎসকদের পদায়ন করার পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেন তিনি। স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির জন্য চিকিৎসকদের দায়ভার কম বলেও তার অভিমত।
ইতিবাচক ধারার অনলাইন গণমাধ্যম ‘ধূমকেতু বাংলা’ (dailydhumketu.com)-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. এম. এ. আজিজ এ কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে স্বাচিপ মহাসচিব বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি, সমস্যা, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য, সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি ধূমকেতু বাংলা’র পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো:
ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা গত এক যুগে কতটা এগিয়েছে এবং কোন কোন জায়গায় তুলনামূলক পিছিয়েছে, তার একটা চিত্র যদি তুলে ধরতেন।
ডা. এম. এ. আজিজ: আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গত এক যুগে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়টা যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখব, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেছিলেন, সেখানেই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের ধারাটা শুরু হয়েছিল। যেমন- একজন ডাক্তারকে (ডা. টি হোসেন) স্বাস্থ্য সচিব করা হয়েছিল। আজকের দিনে যে স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র তা সেই সময়েই পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং কাজ শুরু হয়েছিল। ডাক্তারদের যে চাকরির ধারাবাহিকতা, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং, ডাক্তারদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা করা, তা সে সময়েই করা হয়। এখন যে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি); সে সময়ের আইপিজিএমআর, মিটফোর্ডে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, এগুলো ওই সময়েই প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া পুষ্টি কাউন্সিল স্থাপন- এগুলো কিন্তু তখনই একইসাথে সব কাজ শুরু হয়েছিল। এ ধারাবাহিকতাতেই আমরা এগিয়ে গেছি। পরবর্তীতে আমরা যদি দেখি, পঁচাত্তরের পর একুশ বছর সামরিক সরকার, স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় থাকায় স্বাস্থ্য খাত আর বেশি আগায়নি। দেশের উন্নতি হয়নি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও উন্নতি হয়নি। আমরা কিন্তু বিএমএ’র পক্ষ থেকে একুশ দফা, তেইশ দফার যে আন্দোলনটা দেওয়া হয়েছিল, তার পুরোটা সময়ই আন্দোলন করেছি। ’৭৮-এ সকল পেশাজীবীদের আন্দোলন, ’৮৪-৮৫ সালে প্রকৃচি’র আন্দোলন, বিএমএ’র আন্দোলন এবং নব্বইয়ে তো গণঅভ্যুত্থান হলো- পুরোটা সময়ই কিন্তু আমরা আন্দোলনে ছিলাম। ’৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়নের সূচকগুলো আবার আগাতে শুরু করল। কীরকম? এই যে আমরা ২১ দফা, ২৩ দফা আন্দোলন করেছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বায়ত্তশাসিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, একটি স্বাস্থ্যনীতি চেয়েছিলাম। এরকম অনেক দাবি ছিল। এই দাবিগুলো ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবায়ন করে। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পেলাম। ২০০১ সালে স্বাস্থ্যনীতি করা হলো। ওই সরকার সে সময়ে দেশীয় ওষুধ শিল্পকে উৎসাহিত করার কারণেই আজকে আমরা ১৫১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করতে পারছি। আজকে বেসরকারি খাতে বড় বড় হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে, বাইপাস সার্জারি করার জন্য এখন দেশের বাইরে যেতে হয় না- এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি সমর্থন থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক এখন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এটা তখনকার সরকার করল। ২০০১ সালের পর কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তাররা বেকার হয়ে পড়লেন। একটা স্থবির ভাব বিরাজ করল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর আবার সব কিছু ঘুরে দাঁড়াল।
তাই আমি বলব, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে তখনই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন হয়েছে। এই মুহূর্তে যদি বলি, দেশে ১১২টি মেডিকেল কলেজ, ৫টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আর বিশেষায়িত হাসপাতাল একের পর এক হচ্ছে। কিডনি হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, ইএনটি হাসপাতাল, গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল। তারপর যেটা হলো- শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। ৫০০ বেডের এত বড় বার্ন ইনস্টিটিউট পৃথিবীর আর কোনো দেশে নাই। হংকংয়ে আছে ৪০০ বেডের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের প্রথম ১,০০০ শয্যাবিশিষ্ট সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের নির্মাণ কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেলে নতুন আঙ্গিকে ৫,০০০ বেডের হাসপাতালের কাজ পরিকল্পনা মাফিক আগাচ্ছে। মুগদা মেডিকেলের পাশে যে নার্সিং ইনস্টিটিউট করা হয়েছে, এটা এশিয়া মহাদেশে অন্যতম বড় নার্সিং ইনস্টিটিউট। এটাতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সও আছে। নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদা দান, ডেন্টাল কলেজ অনেকগুলো হয়েছে। বিএসসি নার্সিং কলেজ, ডিপ্লোমা নার্সিং কলেজ অনেকগুলো হয়েছে।
আপনি যদি সূচকগুলি দেখেন – মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। বাংলাদেশ এখন পোলিওমুক্ত। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ গ্যাভি, সাউথ-সাউথ-সহ বিভিন্ন সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রশংসা করা হচ্ছে।
কোভিড পরিস্থিতির কথা যদি বলেন, তাহলে বলব যে, কোভিড পরিস্থিতি সহজে মোকাবেলা করা গেছে, গত এক যুগে স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের ফলে শক্তিশালী যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, তারই কল্যাণে। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৌশলী হয়েছেন, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, কোনো সময়ে চালু করেছেন, কোনো সময়ে বন্ধ করেছেন; এভাবে একটা ভারসাম্য এনেছেন। তারপরে আছে প্রণোদনা। এই উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার প্রথমে নিয়েছে। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’- এই স্লোগানটি বাংলাদেশ সরকার প্রথম চালু করে।
বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা কোভিড চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ৮৫০ কোটি টাকা আলাদা দিয়েছে। হাজার হাজার ডাক্তার এবং নার্স নিয়োগ দিয়েছে। এখনো চার হাজার ডাক্তার ও আট হাজার নার্স নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আইসিইউ সার্ভিসের জন্য ৪০৯ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইতিমধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চীন থেকে টিম এসে আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই যে সাপোর্টটা আমরা পেয়েছি তার ফলেই করোনা পরিস্থিতি আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। টিকার ক্ষেত্রেও বলব যে, এশিয়ার মধ্যে আমরা প্রথম দিকেই টিকা পেয়েছি।
তাই বলব যে, গত এক যুগে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক সাফল্য আছে।
ধূমকেতু বাংলা: অনেক সাফল্য আছে এটা সত্য। তবে সাফল্যের অপর পিঠেই থাকে ব্যর্থতা। সে ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনার জায়গাটা কোথায়?
ডা. এম. এ. আজিজ: অবশ্যই। অনেক উন্নয়ন হয়েছে, আমাদের অনেক দাবি পূরণ হয়েছে, তারপরেও বলব যে, এখনো অনেক সমস্যা আছে স্বাস্থ্য খাতে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের যে কমিটমেন্ট, সংবিধানের যে কমিটমেন্ট- জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, সেটা করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট আরো বাড়ানো দরকার। আবার এটাও সত্য যে, যে বাজেট সরকার দিচ্ছে সেটাই আমরা খরচ করতে পারছি না। টাকা ফেরত যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এখানে ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। সংস্কার করতে হবে। তাহলে আমরা এর সুফলটা পাব। জনগণ ভালো সার্ভিস পাবে।
সেই প্রেক্ষাপটে আমি দুয়েকটি কথা বলতে চাই। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এসে আমাদের মেডিকেল সেক্টরটা চালান। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরেক ধরনের কর্মকর্তারা চালান। এখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক গ্যাপ আছে। যারা মন্ত্রণালয়ে আসেন, তাদের এই টেকনিক্যাল ক্যাডারের অভিজ্ঞতা থাকে না। একজন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চালান। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে টেকনিক্যাল মতামতের যে ব্যাপারগুলো থাকে, এটা তারা না জানার কারণে মাঠ পর্যায়ে তাদের সাথে আমাদের একটা গ্যাপ তৈরি হয়। এবং যেটাকে আমরা ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য’ বলি, সেখানে আমাদের কিছু সমস্যা আছে।
একটি হলো- এই যে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কথা বলে বিভিন্ন জায়গায়। এটা আসলে আমাদের ডাক্তারদের দোষ দিলে চলবে না। আজকে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসর, কালকে তাকে প্রিন্সিপাল বা ডাইরেক্টর বানিয়ে দেয়। আজকে একজন কনসালট্যান্ট, কালকে তাকে সিভিল সার্জন বানিয়ে দেয়, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর বানিয়ে দেয়। ফলে তারা যে চেয়ারগুলোতে বসেন সেটা সুনিপুণভাবে চালানোর জন্য তাদের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা বা প্রশাসনিক কোনো ট্রেনিং নাই। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এর টোটাল দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। এই যে ডিজি অফিসে ৩৫টি অপারেশন প্ল্যান আছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলো সব কন্ট্রোল করে মন্ত্রণালয়। এখানে আমাদের কারো ট্রেনিং দেওয়া হয় না। এখানে তারা প্রমাণ করতে চায় যে, চিকিৎসকরা প্রশাসন বোঝে না, তাদের ম্যানেজেরিয়াল ক্যাপাসিটি নাই, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আছে। কর্মকর্তারা এই পদগুলোতে আসতে চান।
কিন্তু এই জায়গাটাতে একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমরা চাই একটা ট্রেনিং হোক। আমরা আরো চাই, যেমন- বিসিএস স্বাস্থ্য আছে; সে রকম বিসিএস স্বাস্থ্য (প্রশাসন), বিসিএস স্বাস্থ্য (শিক্ষা) এ রকম বিভিন্ন স্টাইলে আমাদের স্বাস্থ্য প্রশাসনকে যদি ঢেলে সাজানো যায় এবং ট্রেনিং দেয়া হয়, তাহলে এই জটিলতা কেটে যাবে।
এখন এই যে দুর্নীতিটা হচ্ছে, টাকা ফেরত যাচ্ছে। কারণ আমাদের যারা যেখানে বসে তাদের প্রপার ট্রেনিং নাই। যারা যোগ্য ব্যক্তি তারা অনেক সময় নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে পারেন না। এ জায়গাগুলিতে চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো অ্যাড্রেস করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের তারা টেকনিক্যাল মতামত নেন না। সেই জায়গায় মনস্তাত্ত্বিক গ্যাপ আছে।
ধূমকেতু বাংলা: ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য’ দূর করার ক্ষেত্রে আপনাদের সুপারিশ কী?
ডা. এম. এ. আজিজ: দেখুন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একজন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য সচিব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আরো পাঁচ-ছয়টি মন্ত্রণালয়ে টেকনিক্যাল লোকদেরকে সচিব বানিয়েছিলেন। তখন আমাদের অনেক কাজ হয়েছিল সিস্টেমেটিক ওয়েতে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো উচিত, সংস্কার দরকার, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার সরকারে আসার পর একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একটা সিটিং হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটা আর আগায় নাই। আমার মনে হয় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য যদি দূর হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়, স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশাসনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের বসানো হয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাত অনেক গতি পাবে।
যেমন আমি একটা উদাহরণ দিই- প্রত্যেক দেশেই আছে, স্বাস্থ্য সেক্টরে যারা কাজ করেন (ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী) তাদের সুরক্ষা আইন আছে। আমরা সরকারকে আরো পাঁচ বছর আগে মতামত দিয়েছিলাম যে, ‘স্বাস্থ্যসেবা নিরাপত্তা আইন’ হওয়া উচিত। এই আইনটা শুধু চিকিৎসকদের জন্যই না, চিকিৎসায় অবহেলার কারণে সাধারণ নাগরিকেরও যদি অভিযোগ থাকে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। প্রতিকার পাবেন।
চিকিৎসক যদি মনে করেন, তাকে হয়রানি করা হয়েছে, তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অনেক সময় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ভাঙচুর করা হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মালিকও আইনের আশ্রয় পাবেন। অর্থাৎ সবার সুরক্ষা। কিন্তু এই আইনটা হচ্ছে না। এই আইনটা দ্রুত হওয়া উচিত। তাহলে ডাক্তারদের স্বাস্থ্যসেবা ডেলিভারিটা সহজ হবে। ডাক্তাররা নিরাপদ পরিবেশে থেকে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবেন।
ধূমকেতু বাংলা: স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণে মানুষের আস্থা কিভাবে গড়ে তোলা যায়? ছোটখাট অসুখের চিকিৎসা করাতেও মানুষ ঢাকামুখী হয়। একটি হাত ভাঙলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না গিয়ে চলে আসে ঢাকার হাসপাতালে। আমরা দেখেছি জেলা সদরে ভালো হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও করোনায় প্রায় সব রোগী ঢাকায় চলে এসেছিল। এতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য আনা যায় কিভাবে?
ডা. এম. এ. আজিজ: প্রতিটি হেলথ কমপ্লেক্সে আট/নয় জন কনসালট্যান্ট আছেন। মেডিকেল অফিসার দুই/তিন জন আছেন। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার নাই। এখানে এই ৮/৯ জন কনসালট্যান্টের চেয়ে যদি মেডিকেল অফিসার বাড়িয়ে দেয়া যেত, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার বাড়ানো হতো, তাহলে সার্ভিসটা ভালো পাওয়া যেত। আমরা চাই যে, প্রতিটি জেলার সদর হাসপাতালগুলোকে ‘ওয়েল ইকুইপড’ করা। সব বিভাগ থাকবে, সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকবে, চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা থাকবে, তাহলে এই রোগীরা রাজধানীমুখী হবে না।
সদর হাসপাতালগুলোকে জোরদার করাই আমাদের দাবি। সেখানে ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করা, অক্সিজেন সাপোর্ট রাখা, অপারেশন থিয়েটার রাখা- এটা যদি সব জেলায় দ্রুত করা যায় তাহলে রোগী সহজে আর ঢাকামুখী হবে না।
আগে একটা বদনাম ছিল যে, ডাক্তাররা মফস্বলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকেন না। এখন কিন্তু সেই সুযোগ নাই। সিস্টেমটা এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। এখন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে প্রতিদিনের রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে চলে আসে কে উপস্থিত আছে, কে নাই।
ধূমকেতু বাংলা: এসব ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ কী আর আপনাদের ভূমিকাই বা কী?
ডা. এম. এ. আজিজ: সরকারের এ রকম অনেক পলিসি আছে। আবার আমরাও আমাদের মতামত দিই। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক জিনিস আগায় না। যেমন- এই সরকার আসার পরে কিছু কমিটমেন্ট ছিল যে, এক বছরের শিশুদের পর্যন্ত বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা; ৬৫ বছরের উপরে নাগরিকদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া। এসব কিন্তু সরকার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু হচ্ছে কী? হয় না। কারণ সরকার ঘোষণা করে কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক জিনিস আগায় না। কিন্তু এই জিনিসগুলি করা লাগবে। তাহলে আমাদেরও লাভ। আমরা তখন সাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাটা দিতে পারব।
তবে হ্যাঁ এগুলি এই সরকারের দ্বারা বাস্তবায়ন সম্ভব। যেমন আপনি জানেন যে, জেলা পর্যায়ে ১০ শয্যার আইসিইউ, ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টারের জন্য ইতিমধ্যেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কাজ চলছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ কাজ আরো ত্বরান্বিত করতে হবে।
ধূমকেতু বাংলা: রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এই গ্যারান্টি দিতে পারি কিনা যে একজন মানুষও বিনা চিকিৎসায় থাকবে না।
ডা. এম. এ. আজিজ: দেখুন এটা তো সরকারের নীতিমালায় আছে। সংবিধানেও জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে বলা আছে। এটা সব দেশের সংবিধানেই আছে। কিন্তু সব সংবিধানের ‘রাইট’ সব দেশ সমানভাবে ইস্টাবলিশ করতে পারে না। সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকার, মাথাপিছু আয়; যেমন আমরা আগে স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম এখন মধ্যম আয়ের বা উন্নয়নশীল দেশে আসছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার যে পরিকল্পনা দিয়েছেন, দেশ সেভাবে আগাচ্ছে। এবং ২০৪১ সালের আগেই আমরা উন্নত দেশের কাতারে চলে আসব বলে আশা করি। এই যে আমরা আগাচ্ছি বিভিন্ন রূপকল্প নিয়ে, এই আগানোর পথেই এটা সম্ভব হবে।
ধূমকেতু বাংলা: এ ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক এবং চিকিৎসক নেতা বা সংগঠক হিসেবে আপনাদের কী ভূমিকা থাকবে?
ডা. এম. এ. আজিজ: আমি একজন চিকিৎসক, একজন চিকিৎসক নেতা, আমরা চিকিৎসকদের সংগঠন করি। আমি যে সংগঠনের মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, আমাদের একটা ডাইরেক্ট পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট আছে। সরকারের যে নির্বাচনী ইশতেহার আছে, অঙ্গীকার আছে সেটাকে আমরা ধারণ করি। তাই আমি প্রথমেই বলেছি যে, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন দেশের স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়। সেই প্রেক্ষাপটে বলব, সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব পলিসি দিচ্ছে, সরকারের যে কমিমেন্ট আছে, সংগঠন হিসেবে চিকিৎসকদের নিয়ে আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করি। আর সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করলে এর সুফল পায় জনগণ। সুতরাং আমাদের কাজটাই হলো সরকারের নীতিটাকে বাস্তবায়ন করা।
ধূমকেতু বাংলা: প্রান্তিক মানুষকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনতে কী পদক্ষেপ আছে?
ডা. এম. এ. আজিজ: কমিউনিটি ক্লিনিক একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। গ্রাম বা পাড়া পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতিদিন এক-দেড়শ রোগী আসে। তারা ওষুধও পাচ্ছে। সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করার এটাই সরকারের অঙ্গীকার যে, কেউ বিনা চিকিৎসায় থাকবে না।
ধূমকেতু বাংলা: স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি সাম্প্রতিক সময়ে একটি আলোচিত বিষয়। এ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
ডা. এম. এ. আজিজ: ধরেন ৩০ হাজার ডাক্তার যদি সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে, তার মধ্যে স্বাস্থ্য প্রশাসনে কিন্তু এর এক শতাংশও নেই। হাতে গোণা কয়েকশ ডাক্তার প্রশাসনে কাজ করেন। এর মধ্যে খুবই একটা কম ‘পোরশন’ দুর্নীতিতে জড়ায়। এখন প্রশ্ন হলো দুর্নীতি কেন হয়? আমি এক কথায় যদি বলি- দুর্নীতির প্রাণভোমরা হলো মন্ত্রণালয়। কারণ হলো, এই যে যত কেনাকাটা, এর বাজেটও মন্ত্রণালয় থেকে পাশ হয়, যেখানে দিবে সেখানেও তাদের কমিটি, তাদের প্রতিনিধি থাকে। দোষ হয় ডাক্তারদের। আরেকজনের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকারটা তারা করে। ডিজির বিরুদ্ধে চার্জশিট হলো, স্বাস্থ্য সচিব ছিলেন, তার বিরুদ্ধে হলো না কেন? সেই মিটিংয়ে তিনি ছিলেন না? তার পারমিশন ছিল না? তার স্বাক্ষর ছিল না? ডিজিকে ধমক দিয়ে করিয়েছে- আমরা যতটুকু জানি। অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। এখন দোষ আসে ডাক্তারদের। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। আমরা যদি বলি ডাক্তারদের ট্রেনিং দেন সেটা দিবে না। কারণ হলো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ডাক্তারদের অযোগ্য প্রমাণ করাই তাদের লক্ষ্য যে, ডাক্তাররা কাজ করতে পারে না।
যেমন দেখেন, এই যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, সেখানে আমাদের চিকিৎসকরা আছেন, তারা ঢুকেও মেডিকেল অফিসার হিসেবে, অবসরেও যান মেডিকেল অফিসার হিসেবে। সেখানে ডিজি থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিক্টের ডাইরেক্টর সবাই ডেপুটি সেক্রেটারি, সবাই প্রশাসনের লোক। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট-টাতো আমাদের। নার্সিংয়ের ডাইরেক্টর সবাই আমলা। নার্সিংয়ে অনেক এমএসসি করা, পিএইচডি করা যোগ্য লোক আছেন কিন্তু তাদের দেয়া হয় না। ক্যাডাররা এখানে ‘রুল’ করেন।
আমাদের প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজে যান, যেমন বরিশাল মেডিকেল কলেজে সেদিন সচিব গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন যে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের উপরে কেউ নাই। নতুন অনেক মেডিকেল কলেজ হয়েছে কিন্তু সেখানে পদ সৃষ্টি হয়নি। পদ সৃষ্টির কাজ মন্ত্রণালয়ের। এখন বিষয়টা দেখেন, এই যে নতুন মেডিকেল কলেজগুলি হলো, পদ সৃষ্টি হয়নি, সেখানে ছাত্র আছে ক্লাস করাতে হয়, হাসপাতাল আছে রোগীর সেবা দিতে হয়, আমাদের স্পেশালিস্ট আছে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করা ডাক্তার আছে। আপনি পদও সৃষ্টি করেন না, পোস্টিংও দেন না। আবার চলতি দায়িত্বে দিবেন সেটাও দেন না।
ধূমকেতু বাংলা: অনেক মানুষ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যান…।
ডা. এম. এ. আজিজ: দেখুন, আমাদের দেশের চিকিৎসার মান কিন্তু অনেক উন্নত হয়েছে। যেমন- বাইপাস সার্জারি, চোখের জটিল সার্জারি, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, কক্লিয়ার ট্রান্সপ্লান্ট- এসব চিকিৎসার জন্য আগে মানুষ বিদেশে যেত। এখন দেশেই চিকিৎসা হচ্ছে। এসব বিশেষায়িত চিকিৎসার পেছনে সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করছে।
এখন সরকার নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার দিকে জোর দিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রেসার, ডায়াবেটিস, এসবের দিকে জোর দিয়েছে। অর্থাৎ উন্নত দেশ যে সব নিয়ে কাজ করে, আমরা সেই লেভেলে কাজ করছি।
আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ছিল- কলেরা, ডায়রিয়া, পোলিও, বসন্ত এগুলি ছিল। এখন এগুলি ভালো অবস্থায় আছে। এখন উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিও এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কমিটমেন্টগুলোও বাস্তবায়ন হচ্ছে।
ধূমকেতু বাংলা: কোভিড মোকাবিলায় সংগঠন হিসেবে স্বাচিপের কোনো বিশেষ ভূমিকা ছিল কি?
ডা. এম. এ. আজিজ: স্বাচিপ-এর পক্ষ থেকে সরকারের কমিটমেন্টগুলো বাস্তবায়নে আমরা সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছি। প্রত্যেকটি হাসপাতালে আমাদের যারা সদস্য আছে তাদেরকে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করার জন্য সহযোগিতা করছি। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করছি। বিভাগীয় পর্যায়ে, জেলা পর্যায়ে জুমের মাধ্যমে মিটিং করে তাদের উৎসাহিত করছি। লেটেস্ট ইনফরমেশন দিচ্ছি, প্রশাসনিকভাবে সমন্বয়ের অভাব থাকলে সেগুলো সমাধান করে দিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। কোথাও ডাক্তারের সংখ্যা বেশি থাকলে সেখান থেকে কয়েক জনকে কোভিড হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আমরা স্বাচিপের পক্ষ থেকে ৫০০ ডাক্তারের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দিয়েছি যে, কোভিড চিকিৎসায় যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে তারা বিনা পয়সায় কাজ করবে। সাংগঠনিকভাবে এই কাজগুলি আমরা এই সময়টাতে করেছি।
আরো পড়ুন:
ভয় নেই, কার্যকর ওষুধ আসছে, নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে করোনা : ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নিল