মধ্যরাতে সাংবাদিককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সহকারী কমিশনার) রিন্টু বিকাশ চাকমার তিন বছর বেতন বাড়বে না।
‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী তাকে এ লঘুদণ্ড দিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
এর আগে গত ১০ আগস্ট এ ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকেও লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। তার দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত) রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলায় ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী আনা ‘অসদাচরণ’র অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে একই বিধিমালার ৪(২)(খ) বিধি অনুযায়ী তার পরবর্তী বেতন বৃদ্ধির প্রাপ্যতার তারিখ থেকে তিন বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হলো। ভবিষ্যতে তিনি এর জন্য কোনো বকেয়া বেতন-ভাতা প্রাপ্য হবেন না।
প্রজ্ঞাপনে ওইদিনের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, রিন্টু বিকাশ চাকমা গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুই-তিনজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫-১৬ জন আনসার সদস্য নিয়ে দরজা ভেঙে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাসায় প্রবেশ করেন। এসময় আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে বলে দাবি করেন তিনি। পরে আরিফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের জেল দেন।
এতে বলা হয়, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ভ্রাম্যমাণ আদালত/অভিযান রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের যথেচ্ছভাবে পরিচালিত হওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে এবং পরবর্তী সময়ে রিন্টু চাকমা, সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। অভিযান পরিচালনাকালে আরিফুল ইসলামকে আটক করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং শাস্তি দেওয়ার পর গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ/অন্য কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বিধায় অভিযান সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
‘প্রসিকিউশন পক্ষ তথা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও রিন্টু চাকমা গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং অভিযান পরিচালনা সম্পন্ন হওয়ার দীর্ঘ প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর আগের তারিখ দিয়ে অভিযোগনামায় প্রসিকিউশন পক্ষের স্বাক্ষর গ্রহণ করেন। ফলে তার এ ধরনের কার্যক্রম এ অভিযান পরিচালনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং গৃহীত কার্যক্রম আইনসম্মত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়।’
‘প্রসিকিউশন পক্ষের অনুপস্থিতির পরও রিন্টু চাকমা টাস্কফোর্স পরিচালনা করেন এবং পরবর্তীকালে নিয়োগ করা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আরিফুল ইসলামকে সাজা দেন। এক্ষেত্রে টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকলে নিয়মিত মামলা দায়ের হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। পক্ষান্তরে গভীর রাতে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা বিধিসম্মত হয়নি, যার দায়-দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রিন্টু বিকাশ চাকমার এ কর্মকাণ্ড সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৩ এর (খ) বিধি মোতাবেক অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী তার কাছে পাঠানো হয়।’
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, রিন্টু চাকমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। তিনি লিখিত জবাব দেন এবং ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নেন। ব্যক্তিগত শুনানি শেষে অভিযোগ তদন্তে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তিন জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত বোর্ড গঠন করা হয়। তদন্ত বোর্ড তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কথা জানানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিন্টু চাকমাকে চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ বা অন্য যথোপযুক্ত গুরুদণ্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এজন্য একই বিধিমালা অনুযায়ী তাকে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তার জবাব পর্যালোচনার পর ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী চাকরি থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরামর্শ নেওয়া হয়। পিএসসি রিন্টু বিকাশ চাকমাকে ‘চাকরি হতে বরখাস্তকরণ’ গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে পরামর্শ দেয়’ বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও জানানো হয়, চাকরি থেকে বরখাস্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রিন্টু বিকাশ চাকমার চাকরির বয়স, নবীন কর্মকর্তার বিষয় বিবেচনা করে তাকে শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী প্রস্তাবিত চাকরি হতে বরখাস্ত করার গুরুদণ্ডের পরিবর্তে তিন বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ১৩ মার্চ মধ্যরাতে বাড়িতে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ঘরে কোনো তল্লাশি চালানো না হলেও পরে ডিসি অফিসে নেওয়ার পর তারা দাবি করেন, আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
আরিফুলের পরিবারের দাবি, কুড়িগ্রামের ডিসি মোছা. সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তিনি এসব করিয়েছেন।
এ অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন রিন্টু বিকাশ চাকমা। অভিযোগ আছে এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার এস এম রাহাতুল ইসলামও সঙ্গে ছিলেন।
পরে ডিসি সুলতানা পারভীনকে সরিয়ে দেওয়া হয়, প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় অন্য অভিযুক্ত কর্মকর্তাদেরও। মুক্ত হন সাংবাদিক আরিফুল ইসলামও।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত শেষে নাজিম উদ্দিনের পদাবনতির সুপারিশ করা হয়েছে। আর রাহাতুল ইসলামকে তিন বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে তাদের শাস্তি চূড়ান্ত করে এখনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
/জেড এইচ